শরিফুল হাসান: বাংলাদেশ থেকে অবৈধ পন্থায় অর্থ নিয়ে যারা যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদ গড়েছেন তাদের সেইসব সম্পদ বাজেয়াপ্ত হবে, এরপর ওই সম্পদ বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণে ফিরিয়ে দেওয়া হবে; এমন কোনো ঘোষণা এলে খুব খুশি হতাম। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, কানাডা, ইউরোপ, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া সবাই এমন ঘোষণা দিলে খুব খুশি হতাম। জানি এমনটা হবে না, তারপরও কথাটা বলার কারণ, বাংলাদেশে লুটপাট করে বিদেশে সম্পদ গড়া লোকের সংখ্যা তো কম নয়।
আজকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সঙ্কটের একটা বড় কারণ বিদেশে এই টাকা পাচার। বাংলাদেশে অনিয়ম দুর্নীতি আর লুটপাট করে তারা বিদেশে এই টাকা পাচার করেছে। আমলা থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ সবাই এই তালিকায় আছেন। এ কারণেই মাঝে মধ্যে ভাবি পাচার হওয়া সব টাকা দেখা যদি কোনোভাবে দেশে ফেরত আনা যেতো। আচ্ছা ভিসা নিষেধাজ্ঞার পর যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদ গড়া লোকজন নিশ্চয়ই কিছুটা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। কারণ আমেরিকার ভিসা না পেলে ওই সম্পদ দেখভাল করবেন কীভাবে? পরিবারের সদস্যদের কাছে যাবেন কীভাবে? সে কারণেই বলছি, খুব খুশি হতাম আমেরিকা যদি বলতো বৈধ আয়ের উৎস দেখাতে না পারলে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত হবে। এরপর বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণে সরকারকে ওই সম্পদ দিয়ে দেওয়া হবে।
শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, কানাডা ইউরোপ মালয়েশিয়া সবাই যদি এমনটা করতো তাহলে এই বাংলাদেশে সম্পদের অভাব হতো না। যতোই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলুক পৃথিবীর কোনো দেশ এই কাজ করবে না। কারণ সিঙ্গাপুর বা সুইজারল্যান্ডের মতো দেশ যারা এতো নিয়ম কানুনের কথা বলে তারাও যেনোতেনোভাবে তাদের দেশে সম্পদ আনাকে উৎসাহিত করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার পর এই কথাগুলো মাথায় এলো। ভিসা নিষেধাজ্ঞা সুদূরপ্রসারী হবে বলেই আশঙ্কা করছি। অন্তত আগামী চার-পাঁচ মাস। রাজনীতিবিদরা বিষয়টিকে যতোটা আমলে নেবেন তার চেয়ে বেশি আমলে নেবেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য বা সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীরা। আর কারণটা স্রেফ ব্যক্তিস্বার্থ। আবারও বলছি ব্যক্তিস্বার্থ। আমার ধারণা, সরকারি যে কর্মকর্তারা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যারা এই সরকারের আমলেই নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন মানুষকে নিপীড়ন করেছেন সেই একই লোক নির্বাচনকে সামনে রেখে কৌশলী ও সতর্ক হবেন। এখানে যুক্তরাষ্ট্রে যার স্বার্থ যতো বেশি সে বিষয়টিকে ততো গুরুত্ব দেবে। এক্ষেত্রে যে প্রথমবার যুক্তরাষ্ট্রে যাবার কথা ভাবছে তার ক্ষেত্রে একরকম আবার যার স্ত্রী পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে আছেন তার জন্য ভাবনাটা আরেকরকম।
উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করি। সেই সব তরুণ বা মধ্য বয়সী সরকারি কর্মকর্তা যারা অন্যায় জেনেও সব আমলে সব সরকারের সব কাজকর্ম সমর্থন করেন, যারা দেশেও স্বার্থ চান আবার বিদেশেও স্বার্থ চান তারা এখন চাইবেন একটু নিরাপদ দূরত্বে থাকতে। কারণ তিনি বা বা তার পরিবারের সদস্যরা আমেরিকায় পড়তে যাওয়া, থাকতে যাওয়া, নানা ট্যুর বা বেড়াতে যাওয়া কোনোভাবেই মিস করতে চান না। কাজেই আগামী নির্বাচনে তারা কেমন ভূমিকা পালন করবেন তা নিয়ে দ্বিধায় আছেন। পরিস্থিতি বুঝে এরা সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে সেই সিদ্ধান্তে অবশ্যই ব্যক্তিস্বার্থ প্রাধান্য পাবে। অন্যদিকে সেইসব লোকেরা যারা বাংলাদেশে বৈধ বা অবৈধ উপায়ে গড়া সম্পদ আমেরিকায় পাঠিয়ে সেখানে বাড়ি গাড়ি সম্পদ করেছেন, সেখানে তাদের ছেলেমেয়েরা পড়ছে, স্ত্রী পরিবারের সদস্যরা থাকছে তারা এখন মহাসঙ্কটে পড়েছেন। ভিসা না পেলে কী হবে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে এমন যে কোনো কাজ যেমন ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, সহিংসতা, লোকজনকে তাদের সংগঠনের স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার প্রয়োগ থেকে বিরত রাখা এবং রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজকে পরিকল্পিতভাবে প্রতিরোধ করা বা গণমাধ্যমে তাদের মতামত প্রচারে বাধা প্রদান করলে তার ও তার পরিবারের সদস্যদের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা জারি হবে।
এগুলোর প্রায় সবগুলো সরকারি দল বা সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিরুদ্ধে গেলেও বিরোধী দলের কথাও বলছে যুক্তরাষ্ট্র। আমার ধারণা এসব আমলে নিলে নির্বাচনে সহিংসতা কম হবে। কারণ যে যাই বলুক যুক্তরাষ্ট্র বেশ ক্ষমতাশালী দেশ। অকারণে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞায় পড়তে চাইবেন না। আমি মনে করি আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যদি সৎ হতেন যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতেন যদি দেশ ও জনগণের স্বার্থ প্রাধান্য দিতেন তাহলে বহু সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো। আশা করছি সবার বোধ ফিরবে। গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা ও সুশাসনকে সবাই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবেন। মানুষ খুন, গুম ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন এমন অনেক অপচর্চা বন্ধ হবে। সবাই মিলে একটা সুন্দর বাংলাদেশ গড়বেন। এতো এতো সঙ্কটের পরেও আমি খুব করে চাই একটা সুন্দর বাংলাদেশ যেই বাংলাদেশের স্বপ্নে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। আমি আজীবন আমৃত্যু সেই সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে যাবো। আজীবন। লেখক: কলামিস্ট