অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন: একেকটা অস্বচ্ছ ও কারচুপির নির্বাচনের ইমপ্যাক্ট কী তা কি আমরা জানি? একেকটা কারচুপির নির্বাচন মানে অসংখ্য মানুষকে অন্যায় করতে বাধ্য করা, অসৎ হতে বাধ্য করা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত যতো নির্বাচন হয়েছে সবগুলোই ছিল কমবেশি কারচুপিপূর্ণ। বাংলাদেশের প্রশাসন থেকে শুরু করে নির্বাচনের সঙ্গে দূরতমভাবেও যারা সংশ্লিষ্ট তাদের সবার নষ্ট হওয়ার পেছনে নির্বাচন দায়ী। মানুষ একবার অসৎ হয়ে গেলে এরপর সততার পথে ফিরে আসা কঠিন। তাহলে কারা এই দেশটাকে নষ্ট করেছে?
রাজনীতিবিদরা। এরাই দেশ গড়ার স্থপতি। আবার এরাই দেশ ধ্বংসের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। এদের ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার লোভই আজকের বাংলাদেশে দুর্নীতি এপিডেমিক আকারে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ক্ষমতায় থাকার লিপ্সায় রাজনীতিবিদরা শিক্ষায় শয়তানি রাজনীতি ঢুকিয়েছে, প্রশাসনে শয়তানি রাজনীতি ঢুকিয়েছে। ইনফ্যাক্ট সর্বত্র। শিক্ষায় রাজনীতি ঢুকানোর ফলে শিক্ষকরা নষ্ট হয়েছে। আর শিক্ষক নষ্ট হলে বাকিদের নষ্ট হওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার। শিক্ষকদের নষ্ট করার জন্য শিক্ষকদের কম বেতন দিয়ে uvlnerable করে রাজনীতির বিষ ঢুকিয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষ সবচেয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখেছে ১৯৭০ সালে। তারপরে স্বাধীন বাংলাদেশে যে আমরা অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারি না এতে কী আমাদের রাজনীতিবিদরা লজ্জাবোধ করে? ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়ী হওয়াটাই ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার বীজ। সেখান থেকেই অসন্তোষ আর রাগের চারা গজিয়ে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশ। এরপর প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চে। সেই নির্বাচন যে একদম সুষ্ঠু হয়েছে বলা যাবে না। সেই নির্বাচনে বাতিল ভোটের সংখ্যা ছিল ৪৭৭,৮৭৫টি, যা নির্বাচনটি কেমন ছিল তার একটা ছোটখাটো লিটমাস টেস্ট। এতো ভোট বাতিল হওয়া অস্বাভাবিক। বলা হয় বিরোধী দলের প্রার্থীকে হারানোর জন্য তাদের ভোটই বাতিল করা হয়। এরপর ১৯৭৭ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম হ্যাঁ/না ভোট হয়। এই নির্বাচনে জিয়াউর রহমান একাই প্রার্থী ছিলেন যা নির্বাচনের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এই হ্যাঁ/না ভোট ছিল প্রশাসনকে ব্যবহার করে নির্বাচনে ইঞ্জিনিয়ারিং করার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। তারপর থেকে যতো নির্বাচন হয়েছে প্রশাসনকে ব্যবহার করে নানা ইঞ্জিনিয়ারিং হয়েছে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে কয়টা নির্বাচন হয়েছে সেগুলো তুলনামূলক অনেক কম কারচুপি হয়েছে এবং নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি ছিল। তারপর ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে এসে নির্বাচনে কারচুপির মাত্রা সীমাহীনভাবে বেড়েছে। এই নির্বাচনের গল্প কারচুপির নির্বাচনের উদাহরণ হিসাবে বাংলাদেশে আলোচিত হতে থাকবে। হ্যাঁ/না ভোটের কারণে জিয়াউর রহমান যেমন আলোচিত হয় ঠিক তেমনি কিংবা তারও বেশি ২০১৪ এবং ১৮ এর নির্বাচনের জন্য শেখ হাসিনাও ইতিহাসে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন।
আর কতো? ভিয়েতনাম আমাদের পরে স্বাধীন হয়ে তর তর করে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা শিক্ষা, পরিবেশ, গবেষণা অর্থনীতিতে কতো পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ আমাদের রাজনীতিবিদরা দেশের চেয়ে দলকে বড় করে দেখছে। দেশটাকে আগামীর প্রজন্মের জন্য অবাসযোগ্য করে তুলছে। নতুন প্রজন্ম বড় হচ্ছে বিদেশে স্থায়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখে। এর ফল কী আমরা টের পাচ্ছি? রাজনীতিবিদরা জেনে বুঝেই এসব করছে। সুতরাং তাদের টের পাওয়ার কথা আমি বলছি না। বড় বড় রাজনীতিবিদদের ছেলেমেয়েরা তো এই দেশে থাকে না। অনেকেই বিদেশের নাগরিক। আমরা যারা সাধারণ নাগরিক আমাদের কী হবে? এই দেশের অধিকাংশ মানুষের হয় ডান চোখ অথবা বাম চোখ কানা। সবাই এক চোখে দেখে। সবাই তাদের নিজ নিজ দলের ন্যারেটিভ বিশ্বাস করে। কেউ সত্যটা দেখতেই পারে না। লেখক: শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়