রবিউল আলম: যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গঠনে, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনেকটা গর্ব করে বলতে শুনেছিÑ চা, চামড়া, পাট আমার জাতীয় সম্পদ, যার মাধ্যমে একদিন বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। চায়ের অবস্থান আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে, সিলেটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পঞ্চগড়, পার্বত্যঞ্চলের অনাবাদী জমি। পাটের সেই সোনালী আশকে ধ্বংস করেছে, আদমজীর মতো বৃহৎ শিল্পকে বন্ধ করে দিয়ে। বিশ্বব্যাংকের চাপের অজুহাত, নাকি জমির ভাগবাটোয়ারা? রাজনৈতিক অপরিণামদর্শিতার জন্য? হিসাব মিলাতে পারছি না। দেশ ধ্বংস করার কোনো পরিকল্পনা বাদ রাখেনি, বিগত সরকার। জাতিকে ভালোবাসলে, জাতীয় সম্পদ এভাবে বিনষ্ট করতে পারে না। এশিয়ার বৃহৎ শিল্প আর একটি আদমজী আমরা কল্পনা করতে পারি না।
চামড়া শিল্পকে বলা হয় দেশে দ্বিতীয় রপ্তানি খাত, চামড়া আমাদের অনেক স্বপ্নপূরণ করেছে। বিশ্ব পরিচয়ের বাহক বলা যায়, বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যকে। এখনো বহিঃর্বিশ্বে মেড-ইন বাংলাদেশের নাম থাকতে হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন ছিলো মিলিয়ন-বিলিয়ন মার্কিন ডলার এই খাত থেকে আয় করার। সেই লক্ষ্য নিয়ে চামড়া শিল্পকে আধুনিকায়নের জন্য সাভারের হেমায়েতপুর শিল্পনগরী গড়ে তুলেন। কাঁচা চামড়া রপ্তানি বন্ধের পরে, শিল্পের মালিকদের আধুনিকায়নের জন্য ব্যাংক ঋণ ছিলো অবমুক্ত। অনেকেই সরকারের মহৎ পরিকল্পনা কাজে লাগিয়ে শিল্পকে আধুনিক করে বৃহৎ শিল্পপতি হয়েছেন, দেশ ও জাতিকে অনেক কিছু দিয়েছেন। অধিকাংশ শিল্পপতি সরকারের উদারতার সুযোগ নিয়ে ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করে নিজে ফকির হয়েছেন, জেল খেটেছেন, মামলা-মোকদ্দমার শিকার হয়েছেন, দেশ ও জাতিকে নিঃশেষ করে। আধুনিক শিল্পনগরী এ থেকে আলাদা হতে পারেনি।
হাজারীবাগ থেকে চামড়া শিল্পনগরী স্থানান্তর হওয়ার পর থেকে চামড়াকে রাহুরদশায় পেয়েছে। কোরবানির কাঁচা চামড়ার মূল্য নির্ধারণী সভা ছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আর কোনো বিষয় অবগত নই। প্রতিবার সভায় কিছু সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়, সমাধানের কোনো লক্ষণ পরিলক্ষিত হয় না। করোনার জন্য বিগত তিনবছর আলোচনায় ডাকা হয়নি। কাঁচা চামড়ার শতভাগ যোগানদাতা মাংস ব্যবসায়ীরা, তাদের প্রশিক্ষণের উপর নির্ভর করে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড। সরকারের একাধিক বিভাগ এই প্রশিক্ষণের জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে। কীভাবে করে, কাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়? মাংস ব্যবসায়ী ও মাংস শ্রমিকরা থাকে অন্ধকারে। কোরবানির পশুর চামড়া রক্ষা করার জন্য শত-শত কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ দেওয়া হয়, কাঁচা চামড়া রক্ষা করার জন্য, মন্ত্রণালয় তদারকি করেন। প্রশ্ন হচ্ছে, ট্যানারির মালিকরা কাঁচা চামড়া কিনছে কি-না? কাঁচা চামড়ার বেপারীদের মাংস ব্যবসায়ীদের ও আড়ৎদারদের, মাদ্রাসা এতিমখানার বকেয়া ঋণের টাকা পরিশোধ করছে কি না? এই প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর মাঠ পর্যবেক্ষক টিমের কাছে নেই। এককোটি বিশ লক্ষ কোরবানির চামড়া রক্ষা করার মূল বিষয় পুঁজি। মাঠ পর্যায় পুঁজির অভাবে চামড়া নষ্ট হয়, তারা কী যে পর্যবেক্ষণ করেন! শুধু নিরাপত্তা ছাড়া। পশুর বর্জ্য এখন রপ্তানির কোন পর্যায়ে এসে নেমেছে? আর কতটা নামলে হুশ ফিরবে প্রশাসনে?
কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি, কারণ এই পেশার সঙ্গে সুদীর্ঘ ৫৪ বছর জড়িত। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের অর্থনীতি উন্নয়নের সঙ্গে বাঙালির ভাগ্য সংযুক্ত। চোখের সামনে ডলার এখন কুকুরে খাচ্ছে, পশুর বর্জ্য রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে। একটি ছাগলের চামড়ার দাম ২০ টাকা থেকে শুরু হয়, লবণ লাগে ৩০ টাকার, কারিগরের খরচ, আড়ৎদারি, গাড়ি ও গুদামঘরে ভাড়ায় না পোষানোর জন্য, ২০ টাকায় কিনেও ফেলে দিতে হয়। পরিবেশের বারোটা বাজে, সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়িতে, দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি। সিটি কর্পোরেশনের এই একটি কাজের প্রশংসা করতেই হয়। কোরবানির ২৪ বা ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে নগর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নের জন্য। কোরবানিদাতার পশুর চামড়া বিনেপয়সাতে দিতে চাইলেও নেওয়ার মানুষ পাওয়া যাচ্ছে না। গরুর চামড়া দুইশ থেকে শুরু হচ্ছে, সাত আটশ উপরে উঠে না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বেধে দেওয়া দামের তোয়াক্কা করে না। বাস্তবায়ন করার জন্য আইনের কোনো সহযোগিতা নেই। কতো পারসেন্ট চলে, আমার জানা নেই। অথচ ২০১২-১৩ সালেও তিন থেকে চার হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। ছাগলের চামড়া তিন থেকে চারশ টাকায়। মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের চিক্কার, মাদ্রাসা, এতিমখানা, লিল্লাহ বেডিং, চামড়া শিল্পের মালিকদের কাছে জিম্মি দশা থেকে মুক্ত করতে কেউ এগিয়ে আসছে না। অথচ কোরবানির এক কোটি বিশ লক্ষ চামড়া মৌসুমি ব্যবসায়ী ছাড়া রক্ষা করা সম্ভব না।
ঈদের সারাদিন মিডিয়ায় বসে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের বিষোদাগার ছাড়া শিল্পের মালিকদের আর কোনো কাজ আছে বলে আমার মনে হয় না। যেই শিল্পের মালিকরা দেশ, জাতি ও শিল্পের উন্নয়নে কাজ করেন, তাদের মিডিয়াতে দেখা যায় না। মিডিয়া ডেকেও আনতে পারে না। চামড়াশিল্প উন্নয়নে, উন্নত আলোচনা হয় না। প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিত করতে পারলেও সমাধানের পথে এগোচ্ছে না। হয়তো ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভেঙে যাওয়া ভয়ে, স্বার্থ বিনষ্টের অজুহাতে লক্ষ্য অর্জনের প্রতিবন্ধকতা কাটছে না। কোরবানির ঈদের বাকি আছে মাত্র একমাস। এখনো জাতির জন্য মন্ত্রণালয়ের কোনো বার্তা নেই। কোরবানির চামড়ার কী হবে? কোরবানিদাতার বিষয়টা বাদ দিলেও দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ও অর্থনীতির হিসেবেটা মিলানোর দায়িত্বকে নিবেন? কার উপর অর্পিত? আপনাদের হুলুস্থুল কী ঈদের দিন সকাল থেকে পরেরদিন সকালে ফুস? মিডিয়া চলবে মাসব্যাপি। কাঁচা ও ফিনিক্স চামড়া রপ্তানির সুরাহা না হলেও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বিশ্বব্যাপী।
বাংলাদেশে চামড়াজাত পণ্যের ব্যবহার বেড়েছে। তবু কেন চামড়া রক্ষায় এতোটা অনীহা। একজোড়া জুতোর দাম, একটি মানিবব্যাগের হিসাব মিলাতে পারছি না। মৌসুমি ব্যবসায়ী, এতিমখানা মাদ্রাসা সহ চামড়ার সঙ্গে যুক্তদের সঙ্গে যেই আচরণ করা হচ্ছে। মাত্র ২৫০ জন ট্যানারির মালিক ও পোস্তার দুইশ নব্বই জন আড়ৎদার কোরবানির এককোটি বিশ লক্ষ চামড়া রক্ষা করতে পারবেন না। আজ দুর্দিনে কোরবানির চামড়া নষ্ট হচ্ছে। কাল সুদিনে জনবলের অভাবে নষ্ট হবে। কাঁচা চামড়ার অভাবে আপনাদের শিল্প বন্ধ হয়ে যেতে পারে। দুইকোটি তিরিশ চল্লিশ লক্ষ চামড়ার জন্য একশত ট্যানারি হলে চলে। সেখানে দুইশ নব্বইটি ট্যানারি। অথচ চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনে শিল্পের সংখ্যা কম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাকতে আপনারা শিল্প উন্নয়নে কাজে লাগাতে চাইলেন না এবং পারলেন না। শেখ হাসিনা যেই দিন থাকবেন না, এই সমস্যার অন্তঃসার খুঁজে পাবেন না। সিন্ডিকেটে টাকা কামানো যায়, বিদেশে পাঠানো যায়, নিজের জন্য কাজে আসে না। আমার অনেক বন্ধুকে দেখছি। ছেলে, বৌ, মেয়ে জামাই বিদেশ, তাদের কামানো টাকা বিদেশ। এখন বৃদ্ধাশ্রমে, বিশাল ফাঁকা বাড়িতে সঙ্গিহীন জীবন নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে কাঁদে। এই তালিকায় অনেক চামড়া শিল্পের মালিকের নাম আছে, জীবনের শেষ সময় হাসপাতালে হাতকড়ায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। দেশ বাঁচলে আপনি বাঁচতে পারবেন, এই কথা মৃত্যুর আগে বুঝলে কী আর হবে? যাদের প্রতিভা ছিলো দেশ গঠনের, তারা নিজেরা গঠিত হয়েছেন, এখন ফুস। এখনো সময় আছে, চামড়াকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করুন।
লেখক: মহাসচিব, বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি