আহসান হাবিব: আমরা ‘সভ্য’ হয়ে উঠি কথাটার মানে কী? সভ্যের বিপরীত শব্দ যদি হয় অসভ্য বা আদিমতা, তাহলে এটা নিশ্চিত, আমরা এখনো আদিম। আমরা শনাক্ত করেছি আদিমতা একটি মন্দ প্রবৃত্তি, তাই সভ্য হতে হবে আর সভ্য হওয়া মানে আমাদের আদিমতা পরিহার করতে হবে। এটি একটি লড়াই, আমাদের নিজ আদিমতার বিরুদ্ধে। আমাদের আদিম প্রকৃতি একটি অর্জিত বৈশিষ্ট্য, এটা আমাদের জৈবিক সত্ত্বায় যুক্ত হয়েছে প্রকৃতিতে অন্য প্রাণিদের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকার স্বার্থে। বিবর্তনের ধারায় যখন আমরা পেয়ে যাই এমন একটি মস্তিষ্ক, যেখানে আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্নেই জমা হতে থাকে মানবিকতার উপাদান। ক্রমেই আমরা একটা অলিখিত চুক্তি করি সামাজিক হয়ে ওঠার যেখানে অন্যদের উপর আমরা আদিমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাবো না বলে প্রতিশ্রুতি দিই।
কিন্তু দিলেই কি হয়? আমরা প্রতিদিন অন্যের উপর নানাভাবে নৃশংস হয়ে উঠি। আমাদের এই আদিম প্রবৃত্তি চেতনার একটি স্তরে জমা হয়ে আছে, সামান্য ট্রিগারেই তা চাগিয়ে উঠে, এই ট্রিগার আর কিছুই নয়, মোটা দাগে আমাদের অস্তিত্ব এবং সেটিকে অন্যের চেয়ে সুখকর করে তোলার জন্য। সভ্য হতে গিয়ে আমরা গড়ে তুলেছি অসংখ্য ব্যবস্থা। আমরা আইন তৈরি করেছি, রাষ্ট্র তৈরি করেছি, আরও কত কি। সভ্য হয়ে উঠার পরিক্রমা আমাদের শেষ হয়নি। কেন শেষ হয়নি?
হত্যা একটি আদিম প্রবৃত্তি। কেন এই হত্যা? হত্যার বদলে আমরা কি লাভ করি? এক কথায় এর মাধ্যমে আমাদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার চেষ্টা করি, হয়, কিন্তু মিমাংসা হয়না, এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই এই হত্যার মত আদিম কাজটি হয়ে চলেছে। দখল করা একটি আদিম প্রবৃত্তি। আমরা কি এই প্রবৃত্তি থেকে মুক্ত হতে পেরেছি, পারিনি, বরং দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। কেন এই দখল? ওই একই কথা নিজের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করা, দখল কি চিরকালীন হয়? হয় না, তাই এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে, সভ্য হওয়ার মানে যদি হয় শান্তি প্রতিষ্ঠা, তবে এই দখল তার বিপরীত কর্ম।
ধ্বংস করা একটি আদিম প্রবৃত্তি। আমরা কি একে পরিহার করতে পেরেছি? পারিনি, প্রায় প্রতিদিন আমরা কিছু না কিছু ধ্বংস করছি, হয় প্রকৃতি, নদী কিংবা অরণ্য, কিংবা মানুষ সৃষ্ট কোনো শিল্প কিংবা স্থাপনা। এখানেও এই একই আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নের চেষ্টা, নিজেকে ক্ষমতাবান প্রমাণ করা।
শোষণ একটি আদিম প্রবৃত্তি। আমরা তাকে আঁকড়ে ধরেছি, আমাদের নির্মিত সব ব্যবস্থা এমন, যেখানে শোষণ অবধারিত। আমরা ছলে বলে কৌশলে প্রতি মুহূর্তে অন্যদের শোষণ করে চলেছি, সৃষ্টি করে চলেছি বৈষম্য, একদিকে দারিদ্র, অন্যদিকে প্রাচুর্য। এটিও ক্ষমতা প্রয়োগের একটি কাঠামোগত রুপ।
তাহলে দেখা যাচ্ছে ক্ষমতা প্রয়োগ এমন একটি আদিম প্রবৃত্তি যা আমরা একদম ত্যাগ করতে পারিনি। তবে কি আমরা সভ্য হইনি? হয়েছি, খুব সামান্য, তবে সেটা শুধু আমাদের বহিঃস্থ আচরণের ক্ষেত্রে। ভেতরে বয়ে চলেছে আদিমতার নৃশংস নদীর প্রবাহ। লেখক: ঔপন্যাসিক