রাজিক হাসান: ভারতবর্ষের ‘সনাতন ধর্মের মূল কথাই হলো ‘ধর্ম’, ‘অর্থ’, ‘কাম’ এবং ‘মোক্ষ’। এই চারের সম্মিলনে ‘পুরুষার্থ’ অর্জন করা। যা কিছু ‘অশুভ’ আছে তাকে বিনাশ করা। যা ‘কল্যাণকর’ তাকে গ্রহণ করা। যে উপলক্ষে সাধু মহাত্মাদের উপদেশ বাণী দ্বারা সাধারণ মানুষ সমৃদ্ধ হয় তাই ‘কুম্ভ’। ‘ঋগ্বেদে’ বলা হয়েছে, যেমন ধারালো কুঠার দিয়ে গাছ কাটা হয় তেমনি ‘কুম্ভে’ যোগ দিলে যে ‘পুণ্যফল’ লাভ হয়, যুগ যুগ ধরে জমে থাকা পাপকে তা মুহূর্তে বিনষ্ট করে।
‘কুম্ভ’ অর্থাৎ ‘পাত্র’। যে পাত্রে ‘অমৃত’ ধারণ করা হয়। আর ‘মেলা’ অর্থ ‘মিলন’। ‘কুম্ভমেলা’ প্রকৃতই মানুষের মিলন। সংস্কৃতে কুম্ভের একাধিক অর্থ রয়েছে। প্রথমত, যা সকল অকল্যাণ দূর করে বিশ্বের মঙ্গল সাধন করে তাই ‘কুম্ভ’। দ্বিতীয়ত,‘কুম্ভ’ ‘শুভবোধ’ জাগ্রত করে সকলের কল্যাণ করে। বৈদিক সংহিতা’ মতে মহামুনি কাশ্যপ ‘হিরণ্যবর্ণ ব্রহ্মা’ থেকে জন্মলাভ করেছিলেন। তাঁর দুই স্ত্রী ছিলেন, ‘দিতি’ ও ‘অদিতি’। ‘অদিতির গর্ভে’ জন্ম নিয়েছিলেন ‘বিশ্বের সব দেবতা, ঋষি-মুনিরা’। আর ‘দিতির গর্ভ’ থেকে জন্ম হয়েছিল ‘দৈত্য আর দানবদের’। এক পিতার ঔরসে জন্ম হলেও দুই মায়ের সন্তানদের মধ্যে কোনও দিনই সদ্ভাব ছিলো না। যুদ্ধবিগ্রহ মারামারি লেগেই থাকত। যার ফলশ্রুতি রূপে রোগ-ব্যাধি, মহামারি, দুর্ভিক্ষ, জরা, মৃত্যু - দেব দানব দু’পক্ষেরই ছিলো নিত্যসঙ্গী। সকলের ভাবনা ছিলো, এর থেকে কী করে মুক্তি পাওয়া যায়?
জানা গিয়েছিল একমাত্র ‘অমৃত’ই পারে জরা ব্যাধি মৃত্যুকে জয় করে অমরত্ব দিতে। আর সেই ‘অমৃত’ ছিলো সমুদ্র গর্ভে। তাকে মন্থন করে তুলে নিয়ে আসার দরকার ছিলো। এরপরে শুরু হয়েছিল শুরু হল ‘সমুদ্রমন্থন’। একদিকে ছিলেন দেবতারা, আর অন্যদিকে ছিলেন দানবরা। সেই মন্থন করতে করতে একসময় সমুদ্র থেকে উঠে এসেছিল বিষ। তার প্রভাবে জগৎ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে দেখে এগিয়ে এসেছিলেন স্বয়ং ‘মহাদেব’। তিনি সমুদ্র থেকে উঠে আসা বিষ পান করে হয়েছিলেন ‘নীলকণ্ঠ’। একে একে সমুদ্র থেকে উঠে এসেছিল কত সব ধন-সম্পদ। সব শেষে পাওয়া গিয়েছিল ‘অমৃত’।
দেব ও দানব, দু’দলই অমৃত পেয়ে অমর হতে চেয়েছিলেন। তখন সেই ‘অমৃতেরই অধিকার’ নিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছিল যুদ্ধ। বারো বছর ধরে চলেছিল সেই ভয়ংকর যুদ্ধ (দেবতাদের কাছে বারো দিন)। যুদ্ধের সুযোগে ‘দেবরাজ ইন্দ্রের পুত্র জয়ন্ত’ ‘অমৃত পাত্র’ নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। দানবরাও তাঁকে তাড়া করেছিলেন। পথে ক্লান্ত হয়ে ‘জয়ন্ত’ চার জায়গায় বিশ্রাম নিয়েছিলেন। সেই চার ক্ষেত্রেই ‘অমৃত পাত্র’ মাটিতে নামিয়ে রাখার সময় ‘এক ফোঁটা করে অমৃত’ গড়িয়ে পড়েছিলো। সেই জায়গাগুলো হল ‘গোদাবরী’র তীরে ‘নাসিক’, ‘শিপ্রা’ নদীর তীরে ‘উজ্জয়নী’, ‘গঙ্গা’র তীরে ‘হরিদ্বার’ আর ‘প্রয়াগ’। সেই চার ক্ষেত্র হল ‘মহাতীর্থ’। প্রতি বারো বছর অন্তর তিথি নক্ষত্র গ্রহ অনুসারে সেখানে ‘স্নানপর্ব’ হয়। বলা হয় সেই সময়ে যিনি সেই ‘মহাতীর্থে’ স্নান করেন তাঁর সব পাপ মুছে যায় বা তিনি পাপের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হন। তাই যুগ যুগ ধরে ‘কুম্ভমেলা’ ভারতবাসীর কাছে পরম পবিত্র এক উৎসব।
‘রামায়ণ মহাভারতে’ ‘সমুদ্রমন্থন’ করে যে ‘অমৃত কুম্ভ’ পাওয়া গিয়েছিল তার বিবরণ রয়েছে। স্বয়ং ‘ব্রহ্মা’ সকল মানুষকে বলেছিলেন, তোমার প্রয়োজন পূর্ণ করবার জন্যে ‘চারিটি পাত্র’ স্থাপন কর। এতে তোমার জীবন সুখের হবে। সেই ‘চার পাত্রের অর্থ’ ‘মানব জীবনের চার অংশ’। আবার ‘জ্যোতিষশাস্ত্র’ অনুসারে সেই ‘চারটি পাত্র’ হল, ‘চন্দ্র’, ‘সূর্য’, ‘বৃহস্পতি’ ও ‘শনি’। বলা হয় ‘জয়ন্ত’ যখন ‘অমৃত ভাণ্ডার’ নিয়ে পালাচ্ছিল তখন এই চারজন তাঁকে রক্ষা করেছিলেন। যখন এই ‘চার গ্রহ নক্ষত্র’ নির্দিষ্ট ‘রাশিচক্রে’ মিলিত হয় তখন হয় ‘কুম্ভ’। ‘চারটি কুম্ভ’র ‘প্রধান দুটি কুম্ভ’ হয় ‘হরিদ্বার’ আর ‘প্রয়াগে’। বহু প্রাচীনকাল থেকে এই দুই পুণ্যক্ষেত্রে ‘কুম্ভমেলা’ হয়ে আসছে। ফেসবুক থেকে