মাসুদ রানা: আজ বাংলাদেশের বিখ্যাত পত্রিকা প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রখ্যাত নাট্যকার মামুনুর রশীদের নীচের কথাগুলো পড়লাম, একবার, দু’বার, তিনবারঃ ‘মুক্ত চিন্তার জন্য হুমায়ূন আজাদ প্রাণ দিয়েছিলেন। মুক্তচিন্তার আরও অনেক মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের মিডিয়া মুক্ত হওয়ার ফলে আমরা একটা রুচির দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়ে গেছি। সেখান থেকে হিরো আলমের মতো একটা লোকের উত্থান হয়েছে। যে উত্থান কুরুচি, কুশিক্ষা ও অপসংস্কৃতি দ্বারা উত্থান।’
মামুনুর রশীদের কথাগুলো পড়ে আমি স্তম্ভিত! কারণ, তাঁর নাট্যকর্মের মাধ্যমে যে-রকমটি জানি, তাতে আমি তাঁকে সমাজের পশ্চাৎপদ শ্রেণীর প্রতি দরদী মনে করতাম। কিন্তু এখন দেখছি তিনি পশ্চাৎপদ অঞ্চলের, প্রান্তিক শ্রেণীর অন্তর্গত ও উচ্চশিক্ষাবঞ্চিত এক হিরো আলমের ‘উত্থান’কে বাঙালী জাতির রুচির সঙ্কটের ফল হিসেবে দেখছেন! যাহোক, প্রত্যেকেরই সমাজ ও সংস্কৃতিকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার ও তা প্রকাশ অধিকার আছে। তবে, সে-প্রকাশ নিয়ে প্রশ্ন ও সমালোচনা করারও অধিকার অন্যদের রয়েছে। সুতরাং আমি মামুনুর রশীদের কাছে কতিপয় প্রশ্ন করছি।
(১) হুমায়ুন আজাদকে মৃত পাওয়া গেলো জার্মানীর মিউনিখে তাঁর এ্যাপার্টমেণ্টে ২০০৪ সালের ১২ই অগাস্টে। আর, ১৩ই অগাস্ট বিবিসি জানায়, ‘German officials in Dhaka told the family that Humayan Azad, 57, had died in his sleep in his flat in Munich’. তো, জার্মানীর মতো মুক্ত চিন্তার দেশে কীভাবে মুক্তচিন্তার জন্যে হুমায়ুন আজাদ ঘুমের মধ্যে প্রাণ দিলেন? জার্মানীতে একজন বিদেশী মুক্তচিন্তার জন্যে প্রাণ দেবেন, অথচ এটি আনএ্যাকাউণ্টেড থেকে যাবে, এর সম্ভাবনা কতোটুকু? আমি আশাকরি, আপনি আপনার দাবীর পক্ষে প্রমাণ হাজির করবেন। আমি জানি আমার এ-প্রশ্নটি আজাদ-ভক্তকূলের কাছে ভালো লাগবে না। কিন্তু লক্ষ করবেন, আমি কোনো জাজমেণ্ট দিইনি, প্রশ্ন করেছি প্রমাণ চেয়ে।
(২) আপনার দাবী ‘কিন্তু আমাদের মিডিয়া মুক্ত হওয়ার ফলে আমরা একটা রুচির দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়ে গেছি’। বলেছেন তো? তো, দয়াকরে বলুন বাংলাদেশে যেখানে নতুন করে নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন করে মিডিয়াকে রূপতঃ বাকরুদ্ধ করা হয়েছে এবং ব্যাপক সংখ্যক মতপ্রকাশককে গ্রেফতার ও কারান্তরীণ করে নির্যাতন করা হয়েছে ও হচ্ছে, সেখানে আপনি "মিডিয়া মুক্ত হওয়া" দেখলেন কীভাবে? আপনার দাবীর পক্ষে প্রমাণ দিন।
(৩) মুক্ত মিডিয়ার মুক্ত হওয়ার ফলে যে রুচির দুর্ভিক্ষ অর্থাৎ রুচির অবনমন ঘটে, বা ঘটেছে, তার কার্য-কারণ কোন তত্ত্বের বলে আপনি এমনটি দাবী করতে পারেন? আপনি কি দয়াকরে এর তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিতে পারেন? এবিষয়ে প্রতিষ্ঠিত কোনো তত্ত্ব কিংবা আপনার নিজের বিকশিত কোনো তত্ত্ব থাকলে আমাদের সামনে কি তার ব্যাখ্যা দিতে পারবেন?
(৪) ‘সেখান থেকে হিরো আলমের মতো একটা লোকের উত্থান হয়েছে" বলে যে আপনি আপনার পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করলেন, তো, "হিরো আলমের মতো" বলতে আপনি কী বুঝাচ্ছেন? দেখতে খারাপ? দরিদ্র? আপনার মতো ডিগ্রী নেই? অর্থাৎ, কোন সাধারণ প্রকারগত বৈশিষ্ট্যকে আপনি "হিরু আলমের মতো" বলে নির্দেশ করছেন?
(৫) আপনার ‘যে উত্থান কুরুচি, কুশিক্ষা ও অপসংস্কৃতি দ্বারা উত্থান’। বাক্যটি আমার কাছে গাঠনিকভাবে অসম্পূর্ণ ও দুর্বোধ্য। তবে ধারণা করি, আপনি হিরো আলমের উত্থানকে সমাজের কুরুচি, কুশিক্ষা ও অপসংস্কৃতির উত্থানের ফল হিসেবে বুঝেছেন এবং বুঝাতে চাইছেন। যদি তাই হয়, দয়াকরে সুনির্দিষ্ট করে বলুন কোন রুচিকে কুরুচি, কোন শিক্ষাকে কুশিক্ষা এবং কোন সংস্কৃতিকে অপসংস্কৃতি বলছেন। আশাকরি, আমার প্রশ্নগুলো আপনাকে বুঝাতে পেরেছি। এবার দয়াকরে উত্তর দিন। আর, যদি কোথাও কোনো অস্পষ্টতা লক্ষ করে থাকুন, স্পষ্টতার লক্ষ্যে নির্দ্বিধায় প্রশ্ন করুন। লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড
আপনার মতামত লিখুন :