শিরোনাম
◈ অর্থনীতিতে ইতিবাচক ইঙ্গিত: রেকর্ডসংখ্যক কোটিপতি ব্যাংক হিসাব ◈ কাতার ও ফিলিস্তিনের প্রতি অবিচল সমর্থন জানালো বাংলাদেশ ◈ দুবাইয়ে বিকৃত যৌ.নাচার ব্যবসার চক্রের মুখোশ উন্মোচন এবার বিবিসির অনুসন্ধানে! ◈ জনপ্রশাসনের ১৭ কর্মকর্তাকে বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে বদলি ◈ ‘আমার নাম স্বস্তিকা, বুড়িমা নই’ ক্ষোভ ঝাড়লেন স্বস্তিকা ◈ তিন জেলার ডিসিকে প্রত্যাহার ◈ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ আবার বাড়ল ◈ আর্থিক সুবিধা নেওয়ায় কর কর্মকর্তা বরখাস্ত ◈ লড়াই ক‌রে‌ছে হংকং, শেষ দি‌কে হাসারাঙ্গার দাপ‌টে জয় পে‌লো শ্রীলঙ্কা ◈ দুর্গাপূজায় মণ্ডপ পরিদর্শনে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসকে আমন্ত্রণ হিন্দু ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের

প্রকাশিত : ০৫ ডিসেম্বর, ২০২২, ০১:৫৯ রাত
আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর, ২০২২, ০১:৫৯ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

এবার আর বাড়ি ফেরানো  যাবে ‘পদ্মানদীর মাঝি’কে?

মনজুরুল হক

মনজুরুল হক: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি বরাবরই ‘মাণিক বাড়ুজ্জে’ লিখে স্বচ্ছন্দ পাই। খুব কাছের মনে হয়। মনে হয় যেন ক্যাটক্যাটা হলুদ চটা-ওঠা কোনো দালানের রোয়াকে বসে কথা কইছি। এই তো, যেন সেদিনের কথা, অথচ কী অদ্ভুত বাস্তবতা- ডিসেম্বরের ৩ তারিখ এলেই তাঁর মৃত্যু নিয়ে লিখতে হয়, স্মরণ করতে হয়। জগতসংসারের কী এমন ক্ষতি হতো যদি বাড়ুজ্জে আর আমরা মিলে দুমুঠো অন্ন যোগানোর পরাবাস্তবতা নিয়ে তুমুল বিতর্ক করতাম? ঘরে মোটে একটি চেয়ার। দুজন মানুষ এলে বসতে দেওয়া যায় না। একবার কজন বন্ধু এলে আতিথেয়তা দেখাতে গিয়ে মানিক বললেন- তোমরা বসো, গরম-গরম সিঙ্গাড়া নিয়ে আসি। দোকান থেকে সিঙ্গাড়া কেনার পর মনে পড়ল পকেটে টাকা নেই। দোকানিকে বললেন; একটু সবুর করো ভাই, কাগজঅলারা টাকা দিলেই দেনা শোধ করে দেব। ওদিকে ১৯৫০ সালে যখন কমিউনিস্টদের ওপর নেমে এল চূড়ান্ত সরকারি দমননীতি, তখন বহু পত্রপত্রিকায় মানিকের লেখা ছাপানো বন্ধ করে দেওয়া হল। আরও ভয়ংকর সঙ্কট। গোটা পরিবারের হাঁ মুখের দিকে তাকিয়ে আর যেন সহ্য হত না কিছু। এক এক সময় ধিক্কার লাগত নিজের প্রতি। মদ বাড়ছিল আর বাড়ছিল ক্ষয়। মদ ছাড়তে চেষ্টা করেও পেরে উঠছিলেন না। দাদাকে আবার চিঠি লিখলেন, কিছু টাকা ধার চেয়ে। দাদা কানা কড়িও দিল না। ঘনঘন অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, হাসপাতালে ভর্তি, লিভার নষ্ট হতে থাকা মানিক পুরোপুরি বিপর্যস্ত। তার সঙ্গে চূড়ান্ত অনটন। একদিন ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় পুজো সংখ্যার লেখা দিতে যাচ্ছেন রাস্তায় দেখা হল অধ্যাপক বন্ধু দেবীপদ ভট্টাচার্যর সঙ্গে। 
মানিকের ভেঙে যাওয়া শরীর, মলিন জামাকাপড় দেখে খুব খারাপ লাগল দেবীপদর। জোর করে সে দিন নিয়ে গেলেন নিজের বাড়িতে। ক্লান্ত মানিককে খেতে দিলেন দেবীপদর মা। বড় তৃপ্তি করে ওই খাবারটুকু খেলেন মানিক। তারপর, যে মানিক একদিন সদর্পে ঘোষণা করেছিলেন আমি শুধু সাহিত্যিকই হব, সেই মানিকই অস্ফুটে বলে উঠলেন, ‘দেখো, দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না যায়। ৩০ নভেম্বর, মানিক আবার জ্ঞান হারালেন। ২ ডিসেম্বর, সম্পূর্ণ অচেতন অবস্থায় আবার ভর্তি করা হল নীলরতন হাসপাতালে। এমন অসুস্থতার খবর পেয়ে ছুটে এলেন কবি, কমরেড সুভাষ মুখোপাধ্যায়। আর একটু পরেই অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হবে মানিককে। এবার আর বাড়ি ফেরানো যাবে ‘পদ্মানদীর মাঝি’কে? তাই নিয়ে সকলেই সংশয়ে। সুভাষ অনুযোগ করলেন লেখকপত্নীকে, ‘বৌদি এমন অবস্থা, আগে টেলিফোন করেননি কেন?’  ম্লান হেসে কমলা উত্তর দিলেন, ‘তাতে যে পাঁচ আনা পয়সা লাগে ভাই। সেটুকুও নেই যে ঘরে!’ ৩ ডিসেম্বর। ভোর চারটে। পৃথিবীতে একটি নতুন দিন সবে শুরু হচ্ছে তখন, বহু দিন অনন্ত লড়াইয়ের পর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল এক আটচল্লিশ বছরের জীবন। বিকেল চারটের সময় বের হল বিশাল শোকমিছিল। নিমতলা ঘাটের দিকে এগোতে থাকল শববাহী গাড়ি। বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখলেন ‘ফুলগুলো সরিয়ে নাও আমার লাগছে। মালা জমে-জমে পাহাড় হয় ফুল জমতে-জমতে পাথর।
 পাথরটা সরিয়ে নাও আমার লাগছে।’ সেই ফুলের ভারে সেদিন সত্যিই দামি পালঙ্কের একটি পায়ায় চিড় ধরে গিয়েছিল। মানিকের মাত্র দুটি উদ্ধৃতি তুলে দেয়া হল। ‘কী ক্ষতি মুসলমানের রান্না খাইলে? ডাঙার গ্রামে যারা মাটি ছানিয়া জীবিকা অর্জন করে তাহাদের ধর্মের পার্থক্য থাকে, পদ্মানদীর মাঝিরা সকলে একর্ধমী’।‘সব মানুষের মধ্যে একটি খোকা থাকে যে মনের কবিত্ব, মনের কল্পনা, মনের সৃষ্টিছাড়া অবাস্তবতা, মনের পাগলামীকে লইয়া সময়-অসময়ে এমনিভাবে খেলা করিতে ভালোবাসে’। মানিকের দেখবার দৃষ্টি ও দৃষ্ট-সত্য ভিন্ন প্রকারের। তিনি অত্যাচারিত শ্রেণির মধ্যে শক্তির ঊন্মেষ লক্ষ্য করেছেন এবং সেই ঊন্মেষকে সাহিত্যে চিত্রিত করেছেন। এ শক্তির একমাত্র উৎস হচ্ছে উৎপীড়িত শ্রেণির চেতনা এবং একতা। আর রয়েছে এই তথ্যটি যে, জাগতিক পরিস্থিতিই মানুষের চালক এবং শক্তিদায়ক। অথচ এই মানিকই মার্কসবাদের সহচর্য পাবার আগে সিগমণ্ড ফ্রয়েড দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তাঁর ‘প্রাগৈতিহাসিক’ সেই সাক্ষ্য দেয়। মানিক ভাববাদ এবং বস্তুবাদের সংঘাতে মাঝে মাঝে বিব্রত হয়েছেন, বিচলিত হয়েছেন। আবার পরক্ষণেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, অর্থনীতি মানুষের জীবনের সবচেয়ে শক্তিশালী নিয়ামক। মানিক অন্য অনেক ঔপন্যাসিকের  মতো আপোষকামী রাজনীতির পথ বেছে নেননি। তার কাছে দেশের মুক্তি মানে অর্থহীন স্বাধীনতা নয়, যে স্বাধীনতা শুধু অল্প সংখ্যক লোককে স্বস্তি দেবে, সুখ দেবে। তাঁর কাছে চূড়ান্ত মুক্তি মানে শোষণমুক্তি। 
মানিক বিশ্বাস করতেন, এ সমাজ গড়ে উঠবে মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির সহায়তায় নয়, বরং শ্রমজীবী শ্রেণি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এবং শ্রেণিচ্যুত মানুষের সাহায্যে। শ্রেণিচ্যুত মানুষরা যে সাধারণ মানুষের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হবে সে ঐক্যের কোনো তুলনা নেই। তিনি বিশ্বাস করতেন বলেই তার ‘জীয়ন্ত’ উপন্যাসের সংগ্রামী কিশোর পাঁচুর উপলব্ধি এরকম-‘সাধারণ বন্ধুত্ব সুযোগ-সুবিধার ব্যাপার। বিপ্লব বন্ধুত্ব গড়ে অন্যরকম। নতুবা জগতে বিপ্লবী হত কে?’ আজকে সিনেপ্লেক্সে বসে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ দেখে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করা, মানিকের বিপ্লবীপনা নিয়ে কাব্য করা, মানিকের উপন্যাস নিয়ে খুঁটে খুঁটে সাহিত্যরস বার করা যখন চলতে থাকে। তখনও মানিকের স্ত্রী বলতে থাকেন, তাতে যে পাঁচ আনা পয়সা লাগে ভাই... সেটুকুও নেই যে ঘরে। [ঈষৎ পরিমার্জিত]। লেখক ও ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়