মারুফ রসূল: সুখহীন নিশিদিন জীবনের বিষাদরঙা উঠোনে পঁচিশে বৈশাখ নেমে আসে সেমিকোলনের মতো ‘এই তো আলো, এই তো আলো’ লিরিক্যাল বিধুরতার সকল অলিগলি পেরিয়ে বেজে ওঠে প্রভাতী বিউগল ‘আনন্দগান উঠুক তবে বাজি’। ফ্লাইওভারের নৈশপ্রহরায় আমাদের ঘুম পায় অথচ, ‘নাহি নাহি নিদ্রা আঁখিপাতে’। রাতপেরোনো ভৈরবীর লেন্সে পঁচিশে বৈশাখের হাত ধরে তখন তাঁর দুর্জেয় ফ্রেম-ইন তিনি সংলাপ ছুঁড়ে দেন কী আনায়াসে। আমার পানে চেয়ে চেয়ে খুশি থাকো তাঁর নক্ষত্রনন্দিত পদবিক্ষেপে আমরা ছড়িয়ে দেই আমাদের যাবতীয় ব্যর্থ প্রতি সংলাপমালা এবং অভিমান, ফিরিয়ে দেই তাঁর কাছ থেকেই শিখে নেওয়া ঔদ্ধত্য কার মিলন চাও বিরহী। তিনি স্পষ্ট হন যেমন তাপহরণ স্নেহকালে নয়নসলিলে ফুটে হাসি আমাদের অনাদরের ক্ষতগুলো তিনি ঢেকে দেন, এমনকি ঢেকেও নেন যেহেতু আমাদের সঙ্গে একই আগুনে দগ্ধ হওয়াই তাঁর স্বেচ্ছা-নিয়তি।
কেবল অশোকে কিংশুকে নয়, আমাদের যুদ্ধ, মৃত্যু আর বিপুল রক্তপাতের রোজনামচায় তাঁর অলক্ষ্য রঙ লাগে অকারণের সুখে। শেষমৃত্যুর আগে তড়িতাহতের মতো আমরা পুনর্বার জেগে উঠি, আবিষ্কার করি আমাদের আলংকারিক রবীন্দ্রনাথ কার্যত অ্যানার্কিস্ট সেমিনার-বান্ধবতায় কিংবা রাবীন্দ্রিক উপমার চৌহদ্দিতে যাঁকে আমরা পাই তিনি মায়া, স্বপনছায়া এমনকি ছলনাও। প্রকৃতপ্রস্তাবে তিনি নেই এখানে, এমনকি ছিলেনও না কোনোদিন। জালিয়ানওয়ালাবাগ থেকে তিনি তো হেঁটে গেছেন সাতচল্লিশের উদ্বাস্তু মিছিলে, ক্ষুধার মতো তীব্রতায় তিনি তো দাঁড়িয়েছিলেন একাত্তরের শরণার্থী শিবিরে। তিনি তো দেখা না-দেখায় মেশা সেই বিদ্যুৎলতা পবিত্র অহংকারে যিনি নিঃশঙ্কচিত্তে বলতে পারেন আমাকে যে বাঁধবে ধরে, এই হবে যার সাধন, সে কি অমনি হবে। ১৯১৫ সালে যে রবীন্দ্রনাথ অলৌকিক প্রেমের উচ্ছ্বাসে লিখেছিলেন, ‘আমার একটি কথা বাঁশি জানে, বাঁশিই জানে’, দশ বছর পর, ১৯২৫ সালে সেই তিনিই কাতর বৌদ্ধভিক্ষুর মতো জানতে চেয়েছিলেন, ‘বাঁশি তোমায় দিয়ে যাব কাহার হাতে’। রাত পোহালে ভয়টুকুও যে ভালোবাসাজাত এটা রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কেইবা শেখাতে পারেন আমাদের? শুভ জন্মদিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিরবন্ধু চিরনির্ভর চিরশান্তি। লেখক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট