মঈন চৌধুরী: সেই আদি-গুহামানবের যুগ থেকেই নারীর শ্রেণিমর্যাদার উগ্র বিচ্যুতি ঘটে, পুরুষের স্থান হয় নারীর উপরে, তৈরি হয় ‘পুরুষ/নারী’ যুগ্ম-বৈপরীত্যটির। এই যুগ্ম-বৈপরীত্য গ্রাহ্য করে ভাষায় ক্রমাগতভাবে আরো অনেক কাঠামোগত যুগ্ম-বৈপরীত্য স্থান করে নেয় এবং প্রতিটি যুগ্ম-বৈপরীত্যে নারী হয় অবহেলিত। সূর্য পুরুষ হলে নারী চাঁদ; আলো যদি হয় পুরুষ, তবে নারী অন্ধকার; পুরুষের স্থান যদি হয় উপরে, নারী থাকবে নিচে; বাহির যদি হয় পুরুষের তবে ঘর হবে নারীর, এমন সব ভাষাকেন্দ্রিক যুগ্ম-বৈপরীত্য নারীকে অবহেলা করছে বারবার।
আমরা যে আদি-সাম্যবাদী সমাজের চিন্তা করি, যেখানে ছিল সম্পদের সুষম বণ্টন, সেখানেও ‘নারী’ হয়ে গিয়েছিল ‘প্রথম সম্পদ’; কারণ যে পুরুষের শক্তি ছিল বেশি, তার নারীকে স্পর্শ করার ক্ষমতা অন্য কারো ছিল না। আসলে নারী সম্পদ হয়েছিল মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি যৌনতাকে কেন্দ্র করে। যৌন ক্রিয়ার সময় নারীর অবস্থান, পুরুষাঙ্গ দিয়ে নারীকে বিদ্ধ করার ক্ষমতা ইত্যাদি ছিল প্রাথমিকভাবে নারীর শ্রেণিমর্যাদা পতনের প্রধান কারণ। ভাষার বিবর্তনের সাথে সাথে, সেই আদিম যুগ্ম-বৈপরীত্যগুলোর প্রসার ঘটে এবং নারী আর কখনো তার সামাজিক মর্যাদা উদ্ধার করতে পারেনি। কখনো কখনো নারী দেবী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বটে, কিন্তু তা হয়েছে আদিম যাদু-বাস্তবতার ফলে।
আমাদের পূর্বপুরুষেরা যখন একটি নারীর গর্ভ থেকে অন্য এক নারী বা পুরুষের জন্মগ্রহণের বিচিত্র চিত্র দেখত, তখন তা তাদের জন্য এক ধরনের জাদুবিদ্যাজাত উপলব্ধি নিয়ে আসত এবং পরবর্তীকালে নারীকে তারা গ্রহণ করত একজন জীবনরক্ষাকারী সত্তা হিসেবে, মা হিসেবে। কখনো যৌন উত্তেজনায় তারা নারীকে আনত স্বপ্নের চরিত্র হিসেবে, দেবী হিসেবে। আমরা দেবী হিসেবে ভেনাস, আফ্রোদিতি, দুর্গা, কালী এবং অন্য যে সত্তাগুলোকে চিহ্নিত করেছি, তা আসলে এক ধরনের কামনা/বাসনা কিংবা জাদুবিদ্যাজাত উপলব্ধির ফসল।
বিশ শতকে এসে নারীবাদী দর্শন ও তত্ত্বের প্রসার ঘটে। সিমন দ্যা বোভেয়া, বেটি ফ্রাইডেন, কেট মিলেট, জুডিথ ফেটারলি, এলিন শোওয়াল্টার, সান্ড্রা গিলার্ট সুসানগুবার, জুলিয়া ক্রিস্টিভা, টরিল মোই, কেলি অলিভার প্রমুখ হলেন আধুনিক নারীবাদের প্রবক্তা। মূলত পুরুষের সমান অধিকার চেয়ে নারীবাদী দর্শন তত্ত্বের প্রসার ঘটলেও, পরবর্তী পর্যায়ে নারীবাদ সমাজ আর সাহিত্যের বিভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়। ফরাসি নারী-বাদে, নারীর অবমূল্যায়নের প্রেক্ষাপটে অবস্থানরত মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলোর ওপর জোর দেয়া হয়। এ তত্ত্বে ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্লেষণ করা হয় এবং সিদ্ধান্ত আসে যে, ভাষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও দর্শন আসলে প্রকাশের সময়ই পুরুষতন্ত্রের পক্ষে উপস্থাপিত হয়েছিল।
নারীবাদের একটি শাখা, যাকে আল্ট্রা ফেমিনিজম বলা হয়, তারা নারীদের অধিকার আদায়ের তত্ত্ব উপস্থাপন করার সাথে সাথে জরায়ুর স্বাধীনতা, অবাধ যৌন সম্ভোগের অধিকার এবং নারী সমকামিতার পক্ষেও বক্তব্য রেখেছে। বাংলা সাহিত্যেও নারীবাদকেন্দ্রিক চিন্তা-চেতনা এসেছে বিশ শতকের প্রথম থেকেই। প্রথম দিকে নারী-স্বাধীনতার বক্তব্য/বিবরণ সীমাবদ্ধ ছিল ঘর ও পরিবারকে কেন্দ্র করে, কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে নারী বাদী চিন্তা-চেতনার ঘর ও পারিবারিক গণ্ডি পেরিয়ে সামাজিক আন্দোলন হিসেবেই উপস্থাপিত হয়। নারীবাদের ভুল বিশ্লেষণ আর প্রয়োগ আমাদের দেশে দেখা যায়। কিছু কিছু নারী নারীবাদকে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাড় না করে পুরুষদের গালিগালাজ করে শান্তি পাচ্ছে। লম্পট আর দুশ্চরিত্রের পুরুষদের বিরুদ্ধে আছে সমাজ, আইন, নারী, পুরুষ সবাই। নারীদের সোচ্চার হতে হবে পুরুষতান্ত্রিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে, পুরুষদের বিরুদ্ধে নয়। পুরুষদেরও উচিত হবে নারীদের সাথে থেকে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা। ২৩-৪-২৪। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :