শিরোনাম
◈ শেখ হাসিনার পতনের পর ঐক্যে ভাঙন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র নিয়ে সন্দিহান মাহাথির; ড. ইউনূসকে বললেন ‘বড় মাপের মানুষ’ ◈ লালমনিরহাটে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে নাপিত পিতা-পুত্র আটক, কী ঘটেছে সেখানে? ◈ ভোলা ছাত্রদল নেত্রী ইপ্সিতার নদীতে লাশ উদ্ধার: আত্মহত্যা নাকি পরিকল্পিত হত্যা, রহস্য ঘিরে ধোঁয়াশা ◈ ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ভেঙে পড়ায় হতাশ ট্রাম্প, প্রকাশ্যে ক্ষোভ ঝাড়লেন অশ্রাব্য ভাষায় (ভিডিও) ◈ ন্যাটো সম্মেলনের আগে ট্রাম্পকে মহাসচিব রুটের ‘অসাধারণ’ বার্তা ফাঁস, প্রশংসায় ভরপুর চ্যাট ঘিরে বিতর্ক ◈ ইসরায়েলের সর্বশেষ হামলায় নিহত ইরানের শীর্ষ পরমাণুবিজ্ঞানী ও পরিবার ◈ নগর ভবনের সংঘর্ষে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার আসিফ মাহমুদের: “কিছু হলেই আমাকেই দায় দাও” ◈ বিদেশিরা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়, রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে বোঝার চেষ্টা করছেন ◈ রাশিয়ায় দালালের খপ্পরে পড়ে যুদ্ধে প্রাণ গেল নরসিংদীর সোহানের ◈ ইরানে আক্রমণের লক্ষ্য অর্জন নিয়ে প্রশ্ন, ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতির দাবি হাস্যকর

প্রকাশিত : ২৯ মার্চ, ২০২৪, ০৫:১৯ সকাল
আপডেট : ২৯ মার্চ, ২০২৪, ০৫:১৯ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

কিছুদিনের কষ্ট, ফোকাস, গড়ে দিতে পারে জীবনকে

রাগিব হাসান

রাগিব হাসান: বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে আসলে আমার খুব ইন্টারেস্টিং স্মৃতিচারণ করার উপায়  নেই। আজ থেকে বহু বহু কাল আগে নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে আমি ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম [ফলাফল বলতে ইতস্তত বোধ করছি। কিন্তু পোস্টের কনটেক্সটে বলতেই হচ্ছে] আদনানের মতোই সেবারে আমি প্রথম স্থান পেয়েছিলাম। সাক্ষাৎকারে এবারে বুয়েটে প্রথম আদনান পরীক্ষার আগে ঘাড় গুজে পড়েছে বলে কেউ কেউ বিশাল নিন্দা করে তাকে অসামাজিক বলেছে, সে কনসার্ট দেখেনি, সিনেমা দেখেনি বলে তাকে একমুখী বলেছে। আমার গত পোস্টে কয়েকজন এসে লিখে গেছেন, এভাবে পড়াশোনা করাটা নাকি অস্বাভাবিক, আর সে প্রস্তুতির কথা শুনে অন্যরা অসামাজিক হয়ে যেতে পারে। তাই আমার পরীক্ষার অভিজ্ঞতাটা বলতে চাই। আমার গল্প খুবই বোরিং। পরীক্ষার আগের রাতে ঘুম আসেনি, পরীক্ষা দিতে গেছি না পড়ে, কোচিং করিনি, ১০০ নম্বর ছেড়ে এসেছি এগুলোর কোনোটাই আমার ক্ষেত্রে খাটে না, আর সারারাত দিব্যি ঘুমিয়েছি, ভালো প্রিপারেশন নিয়ে পুরা ৬০০ নম্বরের জবাব দিয়ে রিভিশন দিয়েছি, অথবা ফলাফল কী হবে তা নিয়ে তেমন টেনশন ছিল না, এসব বললে ঢিল একটাও মনে হয় মাটিতে পড়বে না [মাটিতে পড়া উচিতও নয়] বরং আমি অন্য গল্প বলি। ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত আমি কখনো বাড়ির বাইরে থাকিনি, বাবা-মায়ের অন্তত একজন থেকে কখনো দূরে যাইনি। ভর্তি কোচিংয়ের জন্য চট্টগ্রামের না থেকে শেষে ঢাকায় যাবার হলো দরকার।
কিন্তু থাকবো কোথায়? শুরুতেই কিছু আত্মীয়ের গোমড়া মুখ আর বাবা মায়ের মাথা হেট হয়ে যাওয়া দেখতে হলো, ত্রাতা হয়ে এলেন আমার  শ্রদ্ধেয় মরহুম ছোট মামা, তার বাসায় মামা-মামীর আর আমার মামাতো ভাই-বোনদের অনেক আদরযত্নে অনেকটা দিন কাটালাম, সে ঋণ কখনো শোধ হওয়ার না। ঢাকার কিছুই আমি চিনি না। সিদ্ধেশ্বরী ইস্টার্ন হাউজিং থেকে হেঁটে হেঁটে সানরাইজে যাই। ম্যানেজার পাপন ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করি। ঘাড় গুঁজে কোচিং করি। চিল করি না, চিল করার জায়গাও চিনি না। ঢাকার বাইরের মানুষদের পাত্তা কম। ‘ফরেনার’ নামে বাঁকানজরে এলিয়েন দেখার দৃষ্টি গায়ে পড়লে বোঝা যায়। অনেক অনেক দিন ধরে চলছে কোচিং। সে জুন মাসের শেষে এইচএসসি শেষ, আর কোচিং চলেছে মনে হয় ফেব্রুয়ারি অবধি। মাঝে সাঝে কার্ড ফোন থেকে বাসায় কথা বলি, মোবাইলের আগের যুগ সেটা। সহপাঠী ঢাকার ছেলেপেলে কোচিং করে বেজায় ফুর্তি নিয়ে, সবাই পরিচিত বন্ধ-বান্ধব, আর আমরা বাহিরের অল্প কয়জনা। আমার চট্টগ্রামের বন্ধুরা খিলগাঁওয়ে মেস করে আছে আমার চাইতেও অনেক কষ্টে, তাদের ওখানে মাঝে মাঝে গেলে প্রাণ ফিরে পাই। কিন্তু আমার যে জগৎ, টিভি বই, সবকিছু থেকেই তো দূরে বহু দূরে, প্রিয় চট্টগ্রাম, প্রিয় মানুষ সবার থেকেই। সেসময়ে ইন্টারনেট বলে কিছু দেশে নেই। 
ত্রাতা হয়ে এলো আমার ক্যালকুলেটরটা আক্ষরিক অর্থেই। বোরিং সময় কাটাবার জন্য প্রাকটিস শুরু করলাম কত দ্রুত হিসাব করতে পারি সেটা দিয়ে এক সময় দেখলাম, চোখ বুঁজে রাতের আঁধারেও যেকোনো হিসাব মোটামুটি ৪/৫ সেকেণ্ডে করে ফেলতে পারছি। প্রশ্নপ্রতি ৩ মিনিট, এর জন্য অন্যেরা কতক্ষণ প্রাকটিস করেছে জানি না, আমি একাকীত্বের বিশাল সময় কাটাবার জন্য ঘড়ির কাঁটা ধরে প্রাকটিস করেছি কত দ্রুত একটা হিসাব করা যায়, সেটা। জাপানি কাইজেন সিস্টেম জানতাম না।কিন্তু কোনো টেকনিকে কী করলে অল্প একটু সময় বাঁচে, সেটা বের করে নিয়েছিলাম। মেডিকেলের কোচিং এও ভর্তি হয়েছিলাম। তিন চার দিন ক্লাস করলাম। বুঝলাম এ লাইনে আমাকে দিয়ে হবে না। কাজেই গাইডবইটা জোগাড় করে কেটে পড়লাম। ফর্ম নিতে জীবনে প্রথম বারের মতো বুয়েটে গেলাম। খুব বেশি কাউকে চিনি না, ঢাকাবোর্ডে এসএসসিতে ভালো ফল করা কয়েকজনকে সংবর্ধনার অনুষ্ঠানে দেখার সুবাদে চিনি, এই যা। নেওয়া, জমা দেওয়া, আর তার পর ৩য় বারের মতো পরীক্ষা দেওয়ার জন্য গেলাম বুয়েটে। আমার সিট পড়েছিলো লাইব্রেরিতে এইচএসসিতে বিজ্ঞানের সাবজেক্টের নম্বরের ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষার সিরিয়াল ছিলো ৪। একই টেবিলে পড়েছিলো যারা তাদের দুই জনকে চিনি, কুমিল্লা বোর্ডের শাহেদ কামাল, আর ঢাকা বোর্ডের রাশেদ। অন্যজনের নাম মনে নেই, তার সিরিয়াল ১, তবে তিনি আসলে আগের বছরে এইচএসসি। 
প্রশ্ন পাওয়ার পরের সময়টা একটা ব্লার এর মতো, কিছুই মনে নেই। অনেকদিনের ক্যালকুলেটর চালাবার অভ্যাসটা কাজে লেগেছে, সময়ের অনেকক্ষণ আগে পরীক্ষা দিয়ে রিভিশনও দিতে পেরেছিলাম, যা উত্তর দিয়েছি তার মাঝে মনে হয় ৫টা ভুল হয়েছিলো। ফলাফল বেরুবার পর আমার টেবিলের ৩ জনই একসঙ্গে পড়েছি কিছুদিন সিএসই বিভাগে, শাহেদ/রাশেদ জাপানে চলে গেছে ১ টার্ম পরেই। কিন্তু সে ভর্তির সিরিয়াল ১ ভাইকে কখনো দেখিনি, সম্ভবত তিনি ওয়েটিং এও ছিলেন না। কোথায় পড়েছেন, কে জানে। পরীক্ষার আগের সারারাত আরামে ঘুমিয়েছি। না, কনফিডেন্সের জোয়ারে নয়, বরং এ আনন্দে যে টুমরো ইট উইল বি ওভার। ফটিকের মতো আমিও বলতে পারবো, মা, আমি বাড়ি যাচ্ছি। পরীক্ষার আগের সন্ধ্যায় পড়া বাদ দিয়ে কার্টুন দেখেছিলাম তখনকার নতুন চ্যানেল কার্টুন নেটওয়ার্কে। অথচ আমি টেনশনের ডিপো এইচএসসির সময়ে ঘুমাতে পারতাম না পরীক্ষার আগে, আমাদের  প্রতিবেশী  ছিলেন এখনকার নামকরা কিন্তু তখনকার উঠতি  ডাক্তার মোহিত কামাল, তাঁর পরামর্শে মাথা ঠাণ্ডা করার কায়দা শিখেছিলাম। বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষার আগের রাতে সেগুলা প্রয়োগের সুযোগ হয়নি, তার আগেই ঘুমে রাত কাবার। আমার জীবনের সেটাই শেষ ভর্তি পরীক্ষা। পরীক্ষার স্মৃতি ম্লান হয়ে গেছিলো ফলাফলের টেনশনে নয়, বরং বাড়ি যেতে পারছি সে আনন্দে। মেডিকেলের ফর্ম নেওয়া হলেও আলসেমিতে পরীক্ষা দেইনি। তবে আমার প্রিয়তমা জারিয়া আমাদের বছরেই ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিল প্রথম দিকের মেধা তালিকায় স্থান পেয়ে। সেজন্য বুয়েটে পড়ার সময়ে ঢাকা মেডিকেলের ক্যাম্পাসে প্রায় প্রতিদিনই যেতাম। ঢাবির ধারে কাছে তখনো আর যাইনি, গেছি বহু পরে বুয়েটে পড়ার সময়ে। ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে এটাই মনে আছে, বের হয়ে উত্তর টুত্তর না মিলিয়ে বরং দ্রুত কোন ট্রেনে যেতে পারবো প্রিয় চট্টলায়, সেটারই দিন গুনেছি। 
আর ফলাফল? সেটা নিজের চোখে অনেক পরে দেখেছি, রেজাল্ট বেরুবার পরেও দেখতে যাইনি, দুই দিন চট্টগ্রামে বসে থেকে তার পর ঢাকায় এসে নিজের চোখে দেখে তবেই শান্তি। তো, এত বিশাল বোরিং গল্পটা বলার কারণ কী? কারণটা হলো এ বলা যে, এবারে প্রথম হওয়া আদনানের গল্পটা ইউনিক না। যেকোনো কঠিন পরীক্ষাতে পাস করার জন্য অন্য অনেক কিছুকে স্যাক্রিফাইস করে ফোকাস করতে হয় আসল লক্ষ্যে। সবকিছুর জন্যই একটা সময় আছে সামনে যদি তিন মাস পরে কঠিন একটা পরীক্ষা থাকে, সেইস ময়ে অন্যকিছুতে সময় না দিয়ে সে পরীক্ষার প্রস্তুতিতেই মন দেওয়া  উচিত। এমন না যে আমি বুয়েটের পরীক্ষার প্রস্তুতির আগে বা পরে বই পড়িনি, সিনেমা দেখিনি। কিন্তু সে প্রস্তুতির সময়টাতে আমার যেটা করার দরকার ছিল, সেটাই করেছি। আমার পিএইচডির ডিফেন্সের আগে এবং থিসিস লেখার সময়ের কথা বলতে পারি দরজা বন্ধ করে দিনে ১৬ ঘণ্টা কাজ করেছি সেসময়ে, কারণ সেটাই ছিল সময়ের দাবী। নিন্দুকেরা যারা আদনানের সমালোচনা করছেন, তাকে একমুখী চিন্তার মানুষ বলে, তারা হিপোক্র্যাসি করছেন, কারণ তারা প্রত্যেকেই  জীবনের কোনো না কোনো সময়ে অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে একটা কাজে মন দিয়েছেন। সেটা হতে পারে খেলা, হতে পারে পড়াশোনা অথবা সঙ্গীতচর্চা। 
এ আদনান অথবা তার সঙ্গে ভর্তি হওয়া যারা পরীক্ষার জন্য ঘাড় গুজে পড়েছে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে এসে আস্তে আস্তে বিকশিত হবে। তাদের অনেকেই পড়াশোনা করবে, তার পাশাপাশি নিজেদের ভালো লাগার বিষয়ে সময় দিবে। সে ভালো লাগার বিষয়টা হতে পারে আরও বই পড়া, অথবা সিনেমা দেখা, অথবা হতে পারে গান শোনা। কার কোন বিষয় ভালো লাগতে হবে, তার রায় দেওয়ার অধিকার এ নিন্দুকদের নেই। অথচ অনলাইনে নিন্দুকদের কথা পড়ে মনে হয়, তাদের বাতলে দেওয়া জীবনবিধান না মানলে যেন কেউ ‘অসামাজিক,’ ‘অস্বাভাবিক’ হবে। তারাই মানুষ, তাদের পছন্দের সিনেমা না দেখলে বা পপ সিঙ্গারের গান না শুনলে কেউ আর ‘স্বাভাবিক’ থাকবে না যেন। এ হিপোক্র্যাট নিন্দুকদের কথা শোনার দরকার  নেই কারও। কিছু পেতে হলে কষ্টটা করতে হবে। আমরা যারা সোনার চামচ মুখে করে জন্মাইনি, যাদের প্রতিটা সুযোগ প্রতিযোগিতা করে অর্জন করতে হয়েছে, তারা যদি অন্য বিলাসিতা বাদ দিয়ে কিছুদিনের জন্য চরম ফোকাসড জীবন কাটাই, তাতে কি কারও কিছু বলার থাকতে পারে? না। নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য কষ্ট করে খাইট্যা খাওয়া সবার অভিযাত্রায় রইল শুভেচ্ছা। সবুরে মেওয়া ফলে, কিছুদিনের কষ্ট, ফোকাস, গড়ে দিতে পারে জীবনকে। লেখক: শিক্ষক ও গবেষক। ২৮-৩-২৪। ফেসবুক থেকে 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়