ফাহাদ খান : [১] ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপিকা ড. সুরাইয়া খানম। সেরকম রূপবতী, সুন্দরের সব বিশেষণ দিয়েও সুরাইয়া খানমকে সাজানো যাবে না, এমনই সুন্দর। যখনই করিডোরে দেখেছি অপলক তাকিয়ে রয়েছি, কতদিন শুধু সুরাইয়া খানমকে দেখতে দলবেঁধে ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের সামনে অকারণে ঘুরতে গিয়েছি। আমরা সব্বাই সুরাইয়া খানমকে ভালোবাসতাম। আর সুরাইয়া খানম ভালোবাসতেন কবি আবুল হাসানকে। আবুল হাসান ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র, সত্তর দশকের সেরা রোমান্টিক কবি। ভালোবাসার কবিতা নির্মাণে হাসানের জুড়ি নেই। কবিতা ভালোবেসে কবির প্রেমে পড়েছেন সুরাইয়া খানম।
[২] আমরা সবাই বসে লাইব্রেরীতে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছি। সুরাইয়া খানম এলেন, হাসান ভাইকে উঠিয়ে নিয়ে লং ড্রাইভ, দারুণ রসায়ন। এটা ভালোবাসা, বন্ধুত্ব সব মিলিয়ে একটা রহস্য, একটা ঘোরলাগা ভালোবাসা। একদিন সবাই বসে আছি। এলো রূপবতীর গাড়ি, খোলাচুলে এলোকেশী, বটল গ্রীন শাড়ির জমিন, স্লিভলেস ব্লাউজ, গাড়ি থেকে যখন নামছেন আমরা বিমোহিত। হাসান ভাইয়ের পকেট খালি। আমাদের মাঝে কবি মাকিদ হায়দার তখন সদ্য চাকরি পেয়েছে। একটু আড়াল করে মাকিদকে ইশারা করলাম। মাকিদ গোপনে হাতে দশ টাকা গুজে দিয়ে বললো, ঘুরে এসো হাসান, মন ভালো হয়ে যাবে।
[৩] আবুল হাসান বেশ কয়েক দিন অসুস্থ। হঠাৎ বুকে ব্যথা। ডাক্তার বলেছেন হার্ট এনলার্জ। হাসান দারুণ চাপা স্বভাবের, সব কিছু গোপন করেন, আমরা বেশ চিন্তিত। গুণ’দা বললেন, ‘হাসান তোমার কী হয়েছে, ডাক্তার কী বলেছে?’ হাসান আগের মতো হাসি দিয়ে বললেন, ‘নির্মল, আমার হৃদয় বড় হয়েছে।’ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কবিকে জার্মানি পাঠানো হলো উন্নত চিকিৎসার জন্য। ফিরে এসে লিখলেন সুরাইয়া খানমকে। ‘তুমি আমার কাছে নতজানু হও, তুমি ছাড়া আমি/আর কোনো ভূগোল জানি না/আর কোনো ইতিহাস কোথাও পড়িনি/আমার একা থাকার পাশে তোমার একাকার হাহাকার নিয়ে দাঁড়াও/হে মেয়ে ম্লান মেয়ে তুমি তোমার হাহাকার নিয়ে দাঁড়াও’।
[৪] ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা পৌঁছে আবুল হাসান তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। হাসানের সাময়িক সুস্থতা দেখে তাঁর বন্ধুরা কিছুটা আশ্বস্ত হন। এ অবস্থায় আবুল হাসান চাকরির চেষ্টা করতে থাকেন। অনেকেই তাঁকে আশ্বাস দেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউই তা রক্ষা করেননি। হাসানের অসুস্থতার কথা বিবেচনা করেই কেউ তাঁকে চাকরি দেননি, কেননা, তাহলে পরিশ্রমজনিত ক্লান্তিতে তাঁর অসুস্থতা আরো বৃদ্ধি পাবে- এই ছিল তাঁদের ধারণা। এ সময় চাকরির সন্ধানে তিনি একবার বরিশাল শহরেও যান, কিন্তু ওখানেও কোনো সুবিধা হয়নি। একদিকে অসুস্থতা, অন্যদিকে বেকার-জীবন মাথার ওপর ভাই-বোনদের পড়ালেখার খরচ যোগানোর দায়িত্ব সব কিছু মিলিয়ে আবুল হাসান তখন এক অস্থির জীবন যাপন করেছেন। ক্রমে তিনি পুনরায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে পি.জি. হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পি.জি. হাসপাতালে তিনি ভর্তি হন ১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর। হাসপতালের বেডে শুয়ে বুকের অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করেও তিনি লিখেছেন বেশ কিছু কবিতা। অবশেষে ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর আবুল হাসান মৃত্যুবরণ করেন। দুর্দান্ত এক আত্মসংহারী জীবন ছিল তার, মাত্র ২৮ বছরের।
[৫] সকালে ক্লাসে যাওয়ার পথে খবর পাওয়া গেলো, তরুণ কবি আবুল হাসান প্রয়াত। তাঁর কবিতা আমার প্রিয়। প্রিয় কবির মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ক্লাস করতে যাওয়া যায় না। পি জি হাসপাতালে পৌঁছে দেখলাম উদভ্রান্ত সুরাইয়া আপাকে, প্রয়াত কবির বিছানার পাশে দাঁড়ানো। তাঁকে অমন করুণ ও অসহায় আগে কোনোদিন দেখিনি। কিছু কিছু ছবি চিরকালের মতো হৃদয়কন্দরে জেগে থাকে, তাঁরে সেই মুখ আজও ভোলা হয়নি। আবুল হাসান দীর্ঘকাল অসুস্থ ছিলেন, সরকারি উদ্যোগে চিকিৎসার জন্যে তাঁকে পাঠানো হয়েছিলো বার্লিনে। যতোদূর জানি, একজন কবির চিকিৎসার জন্যে সরকারি তৎপরতা ও সহায়তার ঘটনা বাংলাদেশে সেই প্রথম। ফিরে আসার পর হাসান অল্প কিছুদিনই ভালো ছিলেন। চিকিৎসকরা আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন, সুরাইয়া আপা ছাড়েননি। হাসানের অকাল মৃত্যুর পর সুরাইয়া লিখেছিলেন, ‘হাসান ছিল এক আহত ক্ষুধার্ত সিংহ, আমি ছাড়া আর ওকে কে বুঝত?’
[৬] কবির বন্ধু-আত্মীয়-ভক্তরা তখন ধীরে ধীরে সমবেত হচ্ছেন পি জি হাসপাতালে কবির অন্তিম শয্যাটিকে ঘিরে। অতো মানুষের সংকুলান সেই ছোট্টো কক্ষে হওয়ার কথা নয়, আমরা কেউ কেউ বাইরে বারান্দায় দাঁড়ানো। সুরাইয়া আপা হঠাৎ বেরিয়ে এলেন। কী ভেবে কে জানে, আমার হাত ধরে বললেন, ‘ওরা হাসানের লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে চায়। তা কিছুতেই হতে পারে না, হাসানের খুব ইচ্ছে ছিলো তার কবর হবে রেসকোর্সের একপাশে। সে বলে গেছে। আমার কথা কেউ শুনছে না, তুমি একটু বুঝিয়ে বলবে ওদের?’ বুঝতে পারি, অনেকের কাছে প্রত্যাখ্যাত ও উপেক্ষিত হয়ে সবাইকে তিনি একই অনুরোধ করে যাচ্ছেন, হাসানের কবর যেন ঢাকায় হয়। হঠাৎ রাহাত খানকে দেখতে পাই। আমি সুরাইয়া আপাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাই। বলি, ‘রাহাত ভাই কিছু একটা করতে পারবেন হয়তো।’ নিজের অসহায়ত্ব নিয়ে সরে এসেছিলাম সেদিন। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া আর কোনোদিন হয়নি। আমি পেরে উঠিনি। সুরাইয়া আপা একটিমাত্র অনুরোধ করেছিলেন, যা রক্ষা করার ক্ষমতা আমার ছিলো না।
[৭] আবুল হাসানকে নিঃসঙ্গতার কবি বলা কতটুক সত্য হবে জানি না। তবু এই ভীষণ ছোট্ট একটা জীবনে দারুণ কিছু কষ্ট চেপে রেখেছিলেন হাসান। চাপা স্বভাবের কবি হাসান লিখেছিলেন, ‘অপরিচিতি’Ñ‘যেখানেই যাই আমি সেখানেই রাত/স্টেডিয়ামে খোলা আকাশের নিচে রেস্তোরাঁয়/অসীমা যেখানে তার অত নীল চোখের ভিতর/ধরেছে নিটোল দিন নিটোল দুপুর/সেখানে গেলেও তবু আমার কেবলই রাত/আমার কেবলই শুধু রাত হয়ে যায়’।
কৃতজ্ঞতা : ১-৩ (রুম নাম্বার ১৪৬ - শওকত আহসান ফারুক)। ৪ (আবুল হাসান: জীবনে ও কবিতায় - এম জে ফেরদৌস, বাংলাদেশ সময়)। ৫-৬ (আমাদের সুরাইয়া খানম - মুহম্মদ জুবায়ের)