শিরোনাম

প্রকাশিত : ২৬ জানুয়ারী, ২০২৩, ০৭:০৪ সকাল
আপডেট : ২৭ জানুয়ারী, ২০২৩, ০৩:২৩ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

দ্য ডিপ্লোমেট নিবন্ধ

বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারে মরিয়া তিন পরাশক্তি 

সালেহ্ বিপ্লব: যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীন এই তিন দেশের নাম উল্লেখ করে নিবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বিশ্বের পরাশক্তিদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। নিবন্ধটি লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শাফী মো. মোস্তফা। 

নিবন্ধে বলা হয়েছে, বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত জায়গায় বাংলাদেশের অবস্থান দেশটিকে ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব দিয়েছে। ভূ-রাজনীতির অন্যতম প্রধান বিশেষজ্ঞ রবার্ট কাপলান আগেই বলে রেখেছেন, ভারত মহাসাগর হবে বিশ্বব্যাপী সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু। কারণ বিশ্ব অর্থনীতিতে শিপিং রুট হিসেবে এটি গুরুত্বপূর্ণ। 

ভারত মহাসাগরের উপকূলীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া এবং ভারত মহাসাগরে পরাশক্তিগুলোর নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। আবার ভারত মহাসাগরে চীনের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের কথাও সারাবিশ্ব জানে। ভারত মহাসাগর এবং এর বিভিন্ন উপসাগর দিয়ে আফ্রিকার সাথে চীনের বেশিরভাগ বাণিজ্য হয়ে থাকে। এছাড়াও বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে এই অঞ্চলে উপস্থিতি বাড়ানোর চেষ্টাও করছে চীন। এর যথেষ্ট অগ্রগতিও হয়েছে।

বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানের কারণেই ‘বন্ধু’ হতে চাইছে সবাই। একের পর দূত আসা শুরু হয়েছে। গত ১৪ জানুয়ারি দক্ষিণ ও মধ্য-এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ঢাকা সফর করেন। তিনি রাজনৈতিক দল, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং সুশীল সমাজের নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। যদিও বিএনপির সঙ্গে কথা হয়নি তার।

এর আগের সপ্তাহে হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের দক্ষিণ এশিয়ার সিনিয়র পরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল আইলিন লাউবাচার চার দিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন। ৯ জানুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। একদিন পর চীনের নবনিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতিতে শাহজালাল (রহ.) বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। সেখানেই তিনি মধ্যরাতে বৈঠক করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এটাই ছিল তার প্রথম বিদেশ সফর।

নিবন্ধে বলা হয়েছে, নবনিযুক্ত চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং ঢাকায় সংক্ষিপ্ত সফরের মধ্যদিয়ে চীনের কূটনৈতিক ঐতিহ্য ভেঙ্গে দিয়েছেন। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা নিযুক্ত হওয়ার পর প্রথমেই যান আফ্রিকার কোনো দেশে। দীর্ঘদিনের প্রথা ভেঙ্গে তিনি প্রথমে ঢাকায় আসেন। যদিও তিনি সে সময় আফ্রিকার দিকেই যাচ্ছিলেন, আর ড. মোমেনের সঙ্গে তার বৈঠকটি কোনো সরকারি সিডিউলে ছিলো না। তবু চীনের নয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশের আসা এবং মাঝরাতে ড. মোমেনের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ছিলো তাৎপর্যপূর্ণ। বিষয়টি দেশবিদেশে কূটনৈতিক মহলের ভাবনা বাড়িয়েছে। 

পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিনের সফরের পরপরই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিভাগের উপ-প্রধান চেন ঝো’র নেতৃত্বে পার্টির উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসে। 

দ্য ডিপ্লোম্যাটের নিবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’। এই কৌশল ভালো কাজও করেছে। তবে যতোই দিন যাচ্ছে, বিশে^র মোড়ল দেশগুলোর প্রত্যেকেই চাইছে, ঢাকা তার সঙ্গে থাকুক। আর সঙ্গে থাকবে, সেই ঘোষণা পেতে সাম্প্রতিক সময়ে পরাশক্তিরা বেশ চাপ সৃষ্টি করছে। 

২০২০ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেট স্টিফেন ই বিগান বাংলাদেশকে চার দেশের জোট কোয়াডে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেসময় তিনি বলেন, বাংলাদেশ এই অঞ্চলে আমাদের কাজের কেন্দ্রবিন্দু হবে। 

বাংলাদেশকে মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিকে টানতে যুক্তরাষ্ট্রের সেই প্রচেষ্টার কড়া প্রতিক্রিয়া জানায় চীন। ২০২১ সালের মে মাসে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং স্পষ্ট বলে দেন, বাংলাদেশ কোয়াডে যোগ দিলে বেইজিং-এর সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

নিবন্ধে বলা হয়, চীন বরাবরই বৃহৎ শক্তিগুলোর দ্বন্দ্বে বাংলাদেশকে নিরপেক্ষ থাকার আহ্বান জানিয়েছে। এরপরও নিজের পাল্লা ভারি করার চেষ্টা সবসময়েই করে আসছে চীন। দেশটি চায়, তার গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই) এবং গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভে (জিএসআই) বাংলাদেশ যোগ দিক।

বিভিন্নভাবে তারা প্রস্তাবও দিয়েছে। নিবন্ধের এরপর এসেছে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার বাকযুদ্ধের প্রসঙ্গ। গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা মস্কোতে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দা করেন। তিনি বলেন, ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়াগুলোকে প্রভাবিত করার ক্রমাগত চেষ্টা চালাচ্ছেন। 

ওয়াশিংটন মস্কোর বাকযুদ্ধ ঢাকাতেও প্রভাব ফেলে। মারিয়া জাখারোভার ব্রিফিং-এর আগে ঢাকাসস্থ রাশিয়ান দূতাবাস একটি বিবৃতি দেয়, যেখানে স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্রকে নিশানা করে হয়েছে। বিবৃতিতে নিজেদের ‘উন্নত গণতন্ত্র’ বলে দাবি করা দেশগুলোর ‘আধিপত্যবাদী উচ্চাকাক্সক্ষার’ সমালোচনা করা হয়। এতে বলা হয়, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষার অজুহাতে যারা নিজেদের ‘বিশ্বের শাসক’ বলে মনে করে, সেই রাষ্ট্রগুলো অন্যদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার কাজ করে চলেছে।

এই বিবৃতিরও বিষয়বস্তু ছিলেন পিটার হাস, যিনি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নানাভাবে ঢুকে পড়ছিলেন। নির্বাচন ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথাবার্তার পর সর্বশেষ তিনি এক দশক ধরে নিখোঁজ, বিরোধী দলের নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের পরিবারকে দেখতে গিয়ে বড়োসড়ো বিতর্কের জন্ম দেন। 

হাস-কাণ্ডের প্রেক্ষাপটেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সমালোচনার জবাবে সরব হয় যুক্তরাষ্ট্রও। ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস এক টুইট বার্তায় বলে, যুক্তরাষ্ট্র সবসময় অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে।

রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া এবং বিবৃতিযুদ্ধ সরকারকেও কথা বলতে বাধ্য করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড.মোমেন সাফ সাফ বলে দেন, বাংলাদেশ চায় না রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশ আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করুক।

ডিপ্লোমেটের নিবন্ধে র‌্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গটিও এসেছে, যে বিষয়টি বাংলাদেশের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টিরই নামান্তর। 

নিবন্ধকার ড. শাফী মো. মোস্তফা বলেছেন,  বড় পরাশক্তি দেশগুলোর এই কাছে টানার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশ আরো দৃঢ় ভূমিকা পালন করতে পারত। কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক সংকট, সরকারের বৈধতা নিয়ে সংকট, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে দেশটির স্বাধীন ও যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।

দ্য ডিপ্লোম্যাট বলছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল; বাংলাদেশি পণ্যের একক বৃহত্তম বাজার যুক্তরাষ্ট্র। এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি মার্কিন সাহায্য পেয়ে থাকে যে সব দেশ, বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। 

অন্যদিকে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে দৃঢ় অর্থনৈতিক বন্ধন। বাংলাদেশে বেইজিংয়ের বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং ঋণের পরিমাণ প্রায় ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা কোনো একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বেশি।

নিবন্ধে বলা হয়, পরাশক্তিধর দেশগুলোর ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতা বাংলাদেশের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে সীমিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের সবক দিয়ে বাংলাদেশকে নিজেদের দিকে টানছে। আর চীন ও রাশিয়া আওয়ামী লীগ সরকারকে আর্থিক সহায়তাসহ নিঃশর্ত সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। এটি আরও শক্তিশালী করার প্রক্রিয়াও তারা অব্যাহত রেখেছে।

এসবি/এসএ

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়