বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও নির্বাহী বিভাগের বিভিন্ন পদে থাকার সুযোগ চান অধস্তন আদালতের বিচারকেরা। এমন বিধান রেখে 'সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ-২০২৫'-এর খসড়া সরকারের কাছে পাঠিয়েছেন হাইকোর্ট।
অধস্তন আদালতের ওপর সুপ্রিম কোর্টের সর্বেসর্বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করার প্রস্তাব সংবলিত এ খসড়া অধ্যাদেশের কয়েকটি ধারার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে সেগুলো পুনর্বিবেচনার পরামর্শ দিয়েছে সরকার।
গত ১৩ অক্টোবর হাইকোর্টের পাঠানো এ সংক্রান্ত অধ্যাদেশের খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়। ১৪ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আইন পরীক্ষা-নিরীক্ষা সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি ১৮টি বিষয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ দিয়ে সেগুলো বিবেচনার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠিয়েছে।
খসড়া অধ্যাদেশে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়কে সরকারের মন্ত্রণালয়ের সমমর্যাদাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি প্রকল্প পরিকল্পনা, প্রকল্প প্রণয়ন,বাজেট ব্যবস্থাপনা, অর্থ ব্যয় ও ব্যয় অনুমোদনের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিম কোর্টের কর্তৃত্বে পরিচালিত হওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধস্তন আদালত, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল, বিচার বিভাগীয় কর্মচারী এবং জুডিশিয়াল সার্ভিস সদস্যদের শৃঙ্খলা, নিয়ন্ত্রণ ও পদায়ন, বিধি প্রণয়নের ক্ষমতাসহ সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করবে বলেও খসড়া অধ্যাদেশে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা হলে সরকারের যে কোনো মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারবে, একইভাবে সরকারের যেকোনো প্রতিষ্ঠান সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে। বর্তমানে এ ধরনের যোগাযোগ আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
সরকারের পর্যবেক্ষণ
অধ্যাদেশের ৭(৩) ধারায় আইন ও বিচার বিভাগসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষের দপ্তরে নিম্ন আদালতের বিচারকদের পদায়ন সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ অনুযায়ী করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এই ধারা সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মত দিয়েছে আইনের খসড়া নিরীক্ষা কমিটি। এতে বলা হয়েছে, 'রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গগুলো থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে।'
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, বিচারকরা বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ চেয়ে আবার সরকারের মন্ত্রণালয় বা অন্য প্রতিষ্ঠানের পদে থাকতে চাওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। একদিকে সরকার থেকে পৃথক হতে চাইবেন অন্যদিকে সরকারের পদেও থাকতে চাইবেন, এটাকে দ্বিচারিতা হিসেবে দেখছেন নির্বাহী বিভাগের সংশ্লিষ্টরা।
উদাহরণ দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক যুগ্মসচিব নাম প্রকাশ না করে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, আইন মন্ত্রণালয় সরকারের প্রতিষ্ঠান হলেও সেখানে নিম্ন আদালতের বিচারকরা কাজ করছেন। এখন বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তারা কেন আইন বিভাগে কাজ করবেন? এটা তো বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের নীতি সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
'সরকারের কোনো অফিসার কি আদালতের বিচারক হতে পারেন'— এমন প্রশ্ন রাখেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক অতিরিক্ত সচিব।
প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের ৭(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় জুডিশিয়াল সার্ভিস সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধান সংক্রান্ত কাজে রাষ্ট্রপতির পক্ষে প্রয়োজনীয় সব প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করবে।'
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রস্তাবিত ৭(২) উপ-ধারাটি সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না, তা আইন মন্ত্রণালয়কে যাচাই করে দেখার পরামর্শ দিয়েছে। সংবিধানের এ অনুচ্ছেদে নিম্ন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলাজনিত বিষয়গুলো সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত আছে।
গত ২ সেপ্টেম্বর এক রিটের শুনানি শেষে সংবিধানের বিদ্যমান ১১৬ অনুচ্ছেদকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের অনুচ্ছেদটি প্রতিস্থাপনের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। '৭২ সালের সংবিধানের এই অনুচ্ছেদে নিম্ন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি, পদায়ন ও শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিষয়াদি শুধুমাত্র সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত ছিল।
ওইদিন বিচারপতি আহমেদ সোহেল ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ উল্লিখিত রায়ের পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের জন্য তিন মাসের মধ্যে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতেও নির্দেশ দেন। এরপর থেকে অধ্যাদেশ প্রণয়নে সরকারের উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়েছে।
প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের ৯ নম্বর ধারায় বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত প্রকল্প পরিকল্পনা, প্রকল্প গ্রহণ ও প্রকল্প বাস্তবায়নে আপিল বিভাগের সর্বজ্যেষ্ঠ বিচারপতির সভাপতিত্বে ৮ সদস্যের একটি কমিটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
আইনের খসড়া নিরীক্ষা কমিটি এ ধরনের কাজ সম্পাদনের জন্য সরকারের সুনির্দিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ থাকার অধ্যাদেশের এই ধারাটি বাদ দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে।
খসড়ার ১২ (৪) ধারায় প্রধান বিচারপতির পরামর্শ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের প্রস্তাবিত ব্যয়সীমা কাটছাঁট না করার বিষয়টি উল্লেখ করার পরিপ্রেক্ষিতে আইন নিরীক্ষার কমিটি এই বিধান বাতিল করার পরামর্শ দিয়েছে।
১২ (৭) ও (৮) ধারায় সুপ্রিম কোর্টের জন্য বরাদ্দ হওয়া বাজেট ব্যয়, উপযোজন সংক্রান্ত প্রধান বিচারপতির হাতে রাখার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বিপরীতে আইন নিরীক্ষা কমিটি এই বিষয়গুলোতে অর্থ বিভাগের মতামত নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
অধ্যাদেশটির খসড়ার বিভিন্ন ধারায় 'কর্মকর্তা' ও 'কর্মচারী' শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আইন নিরীক্ষা সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি সব ক্ষেত্রে 'কর্মচারী' শব্দটি ব্যবহার করার পক্ষে মত দিয়েছে।
প্রজাতন্ত্রে নিয়োজিতদের সংবিধানে 'কর্মচারী' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন আইন-বিধিসহ প্রাত্যহিক কাজকর্মে কর্মকর্তা শব্দটি ব্যবহার করা হয়, যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ ছাড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আইন নিরীক্ষা কমিটি আইন বিভাগকে সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদকে বিবেচনায় নেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছে। এ অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতে নিয়োগের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির কাছে ন্যস্ত করা হয়েছে।
সম্প্রতি আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল একাধিক অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠার আশা প্রকাশ করেছেন।
গত ১৫ অক্টোবর সচিবালয়ে আইন উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে 'সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ-২০২৫' উপদেষ্টা পরিষদে পেশ করা হবে। উৎস: ডেইলি স্টার।