দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বাংলাদেশে গুম, গোপন আটক ও নির্যাতনের অভিযোগে ৯ অক্টোবর ২৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছে আদালত। এতে সন্তোষ প্রকাশ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানসহ সাবেক ও বর্তমান কিছু সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার পর সংস্থাটি এক প্রতিবেদনে প্রতিক্রিয়া জানায়। এ নিয়ে সংস্থাটির এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলী একটি প্রতিবেদন লেখেন। যার শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘ন্যায়বিচারের পথে এক ধাপ এগোল বাংলাদেশ।’
প্রতিবেদনের শুরুতে ২০১৭ সালে এইচআরডব্লিউ প্রকাশিত অন্য একটি প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ টেনে আনা হয়। বাংলাদেশে গোপনে আটক রাখা ও গুম করা নিয়ে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছিল উল্লেখ করে এইচআরডব্লিউ বলেছে, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সেই প্রতিবেদনকে ‘অপপ্রচার’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বেশির ভাগ ‘নিখোঁজ’ ব্যক্তি সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, তারা গ্রেফতারের হাত থেকে পালিয়ে বেড়ানো অপরাধী, ঋণখেলাপি কিংবা প্রতারক।
মীনাক্ষী গাঙ্গুলী বলেন, ওই সময় তার জোর দাবির কারণে আসাদুজ্জামান তদন্তের আশ্বাস দিলেও শেষ পর্যন্ত কোনো তদন্ত হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার শাসনামলে বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন ও বাক্স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের ঘটনা বেড়েছে। সরকার সাধারণত এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে বা মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছে।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে তিন সপ্তাহের টানা আন্দোলনে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হন এবং হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। পরে শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। গুমের ঘটনা তদন্তে একটি কমিশন গঠন করা হয়, যেখানে ১ হাজার ৮৫০টিরও বেশি অভিযোগ জমা পড়ে। এ নিয়ে তদন্ত হয়। তিন শতাধিক ব্যক্তি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নিহত হয়েছেন বলে ধারণা করা হয়। কমিশন সম্প্রতি ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্র–থ’ শিরোনামে একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করেছে, যাতে গুম ও নির্যাতনের ভয়াবহ বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগ আমলের এসব গুমের ঘটনার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার সিদ্ধান্ত নেয়। বৃহস্পতিবার শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খানসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের পর ট্রাইব্যুনাল তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করেন।
মীনাক্ষী বলেন, অভিযোগ ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন সেইসব পরিবারের সদস্য, যাদের ঘটনা আমরা নথিভুক্ত করেছিলাম। তাদের মধ্যে একজন হলেন মীর আহমদ বিন কাসেম (আরমান নামে পরিচিত)। ২০১৬ সালে নিখোঁজ হওয়ার মাত্র কয়েক দিন আগে তিনি আমাকে উদ্বেগ জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। তাকে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার গোপন আটককেন্দ্রে আট বছর আটকে রাখা হয়। হাসিনার সরকার পতনের পরই তিনি মুক্তি পান।
ওই প্রতিবেদনে মীনাক্ষী আরও বলেন, এই দীর্ঘ বছরগুলোতে তার স্ত্রী বারবার আমার কাছে ফোন করতেন, খবরের জন্য আকুল হয়ে যেতেন, গুম হওয়া বহু পরিবারের সেই দীর্ঘ প্রতীক্ষার এক করুণ চিত্র। সম্প্রতি আরমান আমাকে জানিয়েছেন যে তিনি সুস্থ আছেন এবং একটি বইও লিখেছেন। মানবাধিকার কর্মী হিসাবে আমরাও এমন অলৌকিক ঘটনার অপেক্ষায় থাকি। তবে প্রায়শই মানবাধিকার লঙ্ঘন চলতে থাকে। অভিযুক্তদের বিচার বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হবে। তবে, সুষ্ঠু বিচারের মানদণ্ড নিশ্চিত করা এবং মৃত্যুদণ্ডের ব্যবহার নিয়ে এখনো উদ্বেগ রয়ে গেছে।