শিরোনাম
◈ সোহেল তাজকে বিমানবন্দরে আটকে দেওয়ার বিষয়ে যা বললেন তার বোন ◈ তৃতীয় দফায় রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোর থেকে দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ ◈ গাজা যুদ্ধ বন্ধে প্রতিশ্রুতি দিলেন ট্রাম্প: সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ◈ ভারত নাকা‌নিচুবা‌নি খে‌য়ে সুপার ওভারে শ্রীলঙ্কার বিরু‌দ্ধে জয় পে‌লো ◈ রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা  ◈ জাতিসংঘে প্রধান উপদেষ্টার পুরো ভাষণ ◈ বাংলাদেশ আর কখনো স্বৈরশাসনের পথে ফিরবে না : জাতিসংঘে প্রধান উপদেষ্টা  ◈ ইইউ’র কঠোর অভিবাসন নীতি: বাংলাদেশিদের ফেরত আসার প্রবণতা বাড়ছে ◈ জাতিসংঘে নেতানিয়াহুর ভাষণের সময় বেশিরভাগ দেশের ‘ওয়াক আউট’ ◈ প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গীর সংখ্যা নিয়ে টিআইবির দাবি ‘ভিত্তিহীন’: প্রেস সচিব

প্রকাশিত : ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ১২:০১ রাত
আপডেট : ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৩:০০ রাত

প্রতিবেদক : মনিরুল ইসলাম

জাতিসংঘে প্রধান উপদেষ্টার পুরো ভাষণ

মনিরুল ইসলাম: জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনের বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

বাংলাদেশ সময় শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) রাত সাড়ে ৯টায় দেওয়া ভাষণটি বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি), বিটিভি নিউজ ও বাংলাদেশ বেতার সরাসরি সম্প্রচার করে।

প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগ, ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের অঙ্গীকার, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং রোহিঙ্গা সংকট তুলে ধরেন।

প্রধান উপদেষ্টার পুরো ভাষণ তুলে ধরা হলো-

বিসমিল্লাহির রাহ্মানির রাহিম


মাননীয় সভাপতি,

আসসালামু আলাইকুম ও শুভ অপরাহ্ণ!

জাতিসংঘের ইতিহাসে পঞ্চম নারী হিসেবে সাধারণ পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের জন্য প্রথমেই আপনাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। এ দায়িত্ব পালনকালে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল আপনাকে পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা প্রদান করবে।

একই সাথে জাতিসংঘ সনদের আট দশক পূর্তি উপলক্ষ্যে এই মহান পরিষদে উপস্থিত সকল সদস্য রাষ্ট্রকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। এবারের অধিবেশন অতীত দর্শন ও ভবিষ্যতের রূপরেখা তৈরি— উভয়ের জন্যই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

গত আট দশক ধরে জাতিসংঘ ধারাবাহিকভাবে তার কর্মপরিধি সম্প্রসারিত করেছে এবং নানা ক্ষেত্রে আরো গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়েছে। বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা, মানবাধিকার, বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন, ন্যায়বিচার, ন্যায্যতা ও সমতা প্রসারে জাতিসংঘ অনস্বীকার্য ভূমিকা রেখেছে। জাতিসংঘের কারণেই আজ বিশ্বের ১২০ টি দেশের প্রায় ১৩ কোটি বিপদাপন্ন মানুষকে জরুরি খাদ্য ও মৌলিক মানবিক সহায়তা, এবং ৪৫ শতাংশ শিশু-কে টিকা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে।

জাতিসংঘের সংস্থাগুলো বহুপাক্ষিক সহযোগিতায় বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশন, টিকা এবং অন্যান্য জীবনরক্ষাকারী সেবা ও সরঞ্জামের যোগান দিয়ে দুর্দশাগ্রস্থ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে।

পাশাপাশি, গত কয়েক দশকে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংঘাত নিরসন এবং বহু বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জাতিসংঘের সীমাবদ্ধতাও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। তবু সামগ্রিকভাবে জাতিসংঘের ভূমিকা মানবজাতির জন্য ইতিবাচক  ও কল্যাণকর।

মাননীয় সভাপতি,

গত বছর, আপনাদের এই মহান সভায় আমি দাঁড়িয়েছিলাম সদ্য গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত একটি দেশের রূপান্তরের আকাঙ্ক্ষা আপনাদের শোনানোর জন্য। আজ আমি এই রূপান্তরের অগ্রযাত্রায় আমরা কতটুকু অগ্রসর হতে পেরেছি তা বলবো।

পৃথিবীর প্রতি ১০০ জনের মধ্যে তিনজনের মতো বাংলাদেশে বাস করে। কিন্তু সেকারণে অথবা ভূ-রাজনৈতিকভাবে বিশ্বের একটি গুরুত্ব্বপূর্ণ অবস্থানে বাংলাদেশ রয়েছে বলে আমাদের এ ইতিহাস জানার দরকার, তা কিন্তু নয়। বরং এ কারণে বাংলাদেশের এই বর্ণনাটি গুরুত্বপূর্ণ যে তা সাধারণ মানুষের অসাধারণ ক্ষমতার উপর আস্থা তৈরি করবে, এ কারণে বর্ণনাটি গুরুত্বপূর্ণ যে তা বিশ্বের সকল দেশের মধ্যে আশার সঞ্চার করবে, যে সংকট যত গভীরই হোক না কেন বা তার নিরসন যত অসম্ভবই মনে হোক না কেন, কখনই তা থেকে উত্তরণের পথ হারিয়ে যায় না।

মাননীয় সভাপতি,

সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের দাবিতে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ জন্ম লাভ করে। কিন্তু যে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা বিশাল আত্নত্যাগ করেছিলাম তা গত পাঁচ দশকে বার বার বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। বারবার আমাদের ছেলেমেয়েদের নেতৃত্বে আমাদের জনগণকে অসংখ্য ত্যাগ স্বীকার করে সে অধিকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছে।

এই বছর আমরা ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’-এর প্রথম বার্ষিকী পালন করেছি—যে অভ্যুত্থানে আমাদের তরুণসমাজ স্বৈরাচারকে পরাভূত করেছিল, যার ফলে আমরা বৈষম্যমুক্ত ও ন্যায়বিচার ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের অভিযাত্রা নতুনভাবে শুরু করতে পেরেছি। সেই বৈষম্যমুক্ত ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে ও আমার সহকর্মীদের। ভেঙেপড়া রাষ্ট্র কাঠামোকে পুনর্গঠন করে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য প্রয়োজন ছিল ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের। যে বিপুল জনসমর্থনের মাধ্যমে আমরা দায়িত্ব পেয়েছিলাম, তার প্রেক্ষাপটে আমাদের জন্যে সহজ পথ ছিল নির্বাহী আদেশে সংস্কার কাজগুলো করা। কিন্তু আমরা বেছে নেই কঠিন পথ—অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই পথ।

আমাদের লক্ষ্য ছিল ক্ষমতার ভারসাম্যপূর্ণ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলা—যেখানে আর কোনো স্বৈরশাসকের আবির্ভাব হবে না, কোনো নির্বাচিত নেতা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক স্বরূপকে ক্ষুণ্ন করতে পারবে না, কিংবা রাষ্ট্র ও জনগণের রক্ষকরা ভক্ষকে পরিণত হতে পারবে না।

শাসনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম, নারী অধিকারসহ সকল জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার করার জন্য আমরা ১১টি স্বাধীন সংস্কার কমিশন প্রতিষ্ঠা করি। কমিশনগুলো জনমত যাচাই ও গভীর পর্যালোচনা করে বিস্তারিত সংস্কার কার্যক্রম সুপারিশ করে।

এ সংস্কার সুপারিশগুলো টেকসইভাবে বাস্তবায়নের জন্য আমরা একটি জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন গঠন করি যারা ৩০টিরও বেশি রাজনৈতিক দল ও জোটকে নিয়ে আলোচনায় বসে। এ কমিশনের লক্ষ্য ছিল সংস্কার প্রস্তাবগুলোর প্রতি দলমত নির্বিশেষে একটি টেকসই সামাজিক অঙ্গীকার তৈরি করা। আমাদের এই অন্তর্ভুক্তিমূলক পদক্ষেপ সফল হয়। আমরা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে সকলে মিলে “জুলাই ঘোষণা”-র মাধ্যমে এই সংস্কার কার্যক্রমের প্রতি আমাদের সময়াবদ্ধ অঙ্গীকার ব্যক্ত করি। অর্থাৎ আগামী নির্বাচনে যেই দলই জনগণের সমর্থন পাক না কেন, সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে আর কোনো অনিশ্চয়তার অবকাশ থাকবে না।

আপনারা জানেন যে, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছি। পাশাপাশি, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করবার জন্য আমরা নিরবচ্ছিন্নভাবে নাগরিকবান্ধব সংস্কার চালিয়ে যাচ্ছি।

মাননীয় সভাপতি,

গত বছর দায়িত্ব গ্রহণের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আমি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারকে আমন্ত্রণ জানাই পতিত স্বৈরশাসক কর্তৃক সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নৃশংসতার চিত্র উদ্ঘাটন করার জন্য। তারা মাঠ পর্যায়ে তদন্ত করে বিস্তারিত প্রতিবেদনের পাশাপাশি ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্যে যে সুপারিশমালা দিয়েছে, তা আমরা আমাদের জাতীয় সংস্কার কার্যক্রমে যুক্ত করেছি।

গত বছর সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের পূর্বেই আমরা গুম সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক কনভেনশনে যোগ দিয়েছিলাম। এখন এর বিধানসমূহ জাতীয়ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে। এ বছর, আমরা জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কনভেনশনের ঐচ্ছিক প্রোটোকলে যোগ দিয়েছি  এবং এর বাস্তবায়নে একটি স্বাধীন প্রতিরোধমূলক জাতীয় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছি।

নিবর্তনমূলক স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা হতে মানবাধিকার সুরক্ষাকারী একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্যে প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমরা আমাদের দেশে তিন বছর মেয়াদে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের একটি মিশন পরিচালনার অনুমোদন দিয়েছি যা ইতোমধ্যেই কার্যক্রম শুরু করেছে।

আমাদের এ সকল পদক্ষেপ ও অঙ্গীকার জনগণের প্রত্যাশারই প্রতিফলন। আর এ প্রত্যাশা মূলত একটি গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বহুত্ববাদী সমাজ গড়ে তোলারই প্রত্যাশা।

মাননীয় সভাপতি,

আমাদের উন্নয়ন কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে—সুশাসন, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ও টেকসই উন্নয়ন। বিগত দেড় দশকের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি যে জবাবদিহিতা ছাড়া যে কোনো উন্নয়ন ক্ষণস্থায়ী ও ভঙ্গুর। রাজনৈতিক হীনস্বার্থ ও দুর্নীতির উদ্দেশ্যে গৃহীত অবকাঠামো প্রকল্প শুধু যে অর্থনীতির উপরই চাপ বাড়ায় তা নয়, তা জনগণের কোনো কল্যাণও করে না। দায়িত্ব গ্রহণের পর আমরা একে একে আবিষ্কার করি দুর্নীতি ও জনগণের সম্পদ চুরি কি ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছিল এবং তার ফলশ্রুতিতে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা কি ভয়ানক নাজুক ও ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল।

আমরা এর অবসান ঘটাচ্ছি যেন আর কখনোই উন্নয়নকে জনগণের সম্পদ আত্মসাতের অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা না যায়। দেশের নাজুক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মজবুত করতে আমরা সংস্কারমূলক কিছু কঠিন কিন্তু প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্কার হলো রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থাপনার সংস্কার— যেখানে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সংস্থাকে পৃথক করার জন্য আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে, এবং রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি পাবে। এই উদ্যোগগুলো সদ্যসমাপ্ত ঋঋউ৪ সম্মেলনে গৃহীত সেভিয়া অঙ্গীকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

আমরা আশা করি যে, বাংলাদেশে যেমন সেভিয়া অঙ্গীকারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সংস্কার করবার চেষ্টা করছি, তেমনি উন্নত বিশ্বও সেভিয়ার সামষ্টিক অঙ্গীকার অনুসারে তাদের দায়িত্ব পালনে আন্তরিক হবে।

একই সাথে আমরা মনে করি, আন্তর্জাতিক অর্থায়ন ব্যবস্থায় বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থাপনার সংস্কার, একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক আন্তর্জাতিক কর সহযোগিতার বৈশ্বিক কাঠামো, অবৈধ আর্থিক প্রবাহ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সমন্বিত বৈশ্বিক পদক্ষেপ গ্রহণ এবং অবৈধ ও দুর্নীতিলব্ধ অর্থ ও পাচারকৃত সম্পদ পুনরুদ্ধারেও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মাননীয় সভাপতি,

দেশের পাচার হওয়া অবৈধ সম্পদ পুনরুদ্ধার করা বর্তমানে আমাদের অন্যতম শীর্ষ অগ্রাধিকার। গত ১৫ বছরে দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি ডলার অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। আমরা নিরলসভাবে এই সম্পদ ফেরত আনার চেষ্টা করছি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আইনি প্রক্রিয়া এবং অন্যান্য নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার কারণে আমাদের এই প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর দৃঢ় সদিচ্ছা ছাড়া আমরা পাচার হওয়া অবৈধ সম্পদ পুনরুদ্ধারে সফল হব না। বিশ্বের বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা উন্নয়নশীল দেশ থেকে সম্পদের এই অবৈধ পাচার কার্যকরীভাবে প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিধি বিধানগুলো বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ট্যাক্স হেভেন এ  বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ স্থানান্তরে উৎসাহিত করছে।

তাই, যেসব দেশ ও প্রতিষ্ঠান এ পাচারকৃত সম্পদ গচ্ছিত রাখবার সুযোগ দিচ্ছে, তাদের আমি আহ্বান জানাচ্ছি, তারা যেন এই অপরাধের শরিক না হয়— এ সম্পদ তার প্রকৃত মালিককে অর্থাৎ কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ করদাতাদের নিকট ফিরিয়ে দিন। আমি উন্নয়নশীল দেশ হতে সম্পদ পাচার রোধে কঠোর আন্তর্জাতিক বিধি বিধান প্রণয়ন এবং এর প্রয়োগ নিশ্চিতের প্রস্তাব করছি।

মাননীয় সভাপতি,

রাজস্বখাতের ঐতিহাসিক সংস্কারের পাশাপাশি আমরা বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার চালু করেছি, ব্যাংক খাতে অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ, নতুন ব্যাংক রেজোলিউশন অধ্যাদেশ ও আসন্ন ডিপোজিট প্রটেকশন অধ্যাদেশের মাধ্যমে শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা আনছি; পুঁজিবাজারে সংস্কার টাস্কফোর্স ও শক্তিশালী তদন্তব্যবস্থার মাধ্যমে তদারকি আধুনিকীকরণ করেছি। সরকারি ক্রয়ব্যবস্থায় ডিজিটাল টেন্ডারিং বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং স্বার্থের সংঘাত সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পাশাপাশি নতুন পাবলিক অ্যাকাউন্টস অডিট অধ্যাদেশের মাধ্যমে জবাবদিহিতা আরও জোরদার করা হয়েছে। শুধুমাত্র আর্থিক স্থিতিশীলতা অর্জনের সীমাবদ্ধ না থেকে আমরা বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলছি: বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো এখন ১৯টি সংস্থাকে একীভূত করে কাস্টমস প্রক্রিয়া সহজ করছে; দ্রুত বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বিশেষায়িত বাণিজ্য আদালত গঠিত হয়েছে; বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ওয়ান-স্টপ সার্ভিস সাবলীলভাবে প্রদানের জন্য সমন্বয় কমিটি গঠন করেছে, নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষগুলোকে একই ছাদের নীচে নিয়ে আসা হয়েছে এবং ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিট প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে; এবং এফডিআই হিটম্যাপ ও জাতীয় সেমিকন্ডাক্টর টাস্কফোর্স বিনিয়োগকারীদের কাছে উচ্চ সম্ভাবনাময় খাতগুলোর তথ্য সহজ ও স্বচ্ছভাবে তুলে ধরছে। বাণিজ্য লজিস্টিকসেও উন্নতি ঘটছে—চট্টগ্রাম বন্দরে গত আগস্টে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ২৭.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটেছে, যা দক্ষতার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নির্দেশ করে। এসব উদ্যোগ অর্থনৈতিক শাসনব্যবস্থাকে যেমন সুদৃঢ় করছে, তেমনি বিনিয়োগকেও নিরাপদ করছে। এসব সংস্কারের ফলে বাংলাদেশ এখন টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন এক পর্যায়ে প্রবেশ করেছে।

এর পাশাপাশি, এত স্বল্প সময়ে অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর পিছনে আমাদের প্রবাসীরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তাঁরা বিদেশের মাটিতে কঠোর পরিশ্রম করে প্রতি মাসে দেশে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। শুধু বাংলাদেশেই নয়, স্বাগতিক দেশগুলোতেও তাদের বিশাল অবদান রয়েছে। তাঁরা সেখানে বহুল চাহিদাসম্পন্ন সেবা প্রদান করছেন। এটি তাই আমাদের জন্য যেমন, তেমনি স্বাগতিক দেশগুলোর জন্যও সমানভাবে লাভজনক। উভয় দেশের জন্যই তা উপকারী।

এ প্রসঙ্গে জানাতে চাই, আমরা শ্রম অধিকার সংস্কার এগিয়ে নিচ্ছি। ইতোমধ্যেই স্বাধীন শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে একটি কমিটি গঠিত হয়েছে; বাংলাদেশ শ্রম আইন সংশোধনের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে, যেখানে ট্রেড ইউনিয়ন প্রক্রিয়া সহজ করা, মাতৃত্বকালীন ছুটি বৃদ্ধি, এবং আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উভয় খাতের শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা সম্প্রসারণের পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। ট্রেড ইউনিয়নের জন্য অনলাইন নিবন্ধন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে এবং নিবন্ধন প্রক্রিয়াকে আরও সহজতর করার বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। পাশাপাশি, শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় আমাদের অঙ্গীকারের নিদর্শনস্বরূপ সম্প্রতি আমরা ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা-র লেবার সেন্টারের সংবিধিতেও স্বাক্ষর করেছি।

এই কারণেই আমরা নিরাপদ, সুশৃঙ্খল ও নিয়মিত অভিবাসনকে সমর্থন করি এবং যেসব দেশে প্রবাসী শ্রমিকরা  যান সেই সব দেশে তাঁদের জন্য সহমর্মিতা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার আহবান জানাই।

উন্নত বিশ্ব যেখানে বয়স্ক জনসংখ্যার চাপে ভুগছে, বাংলাদেশ সেখানে সৌভাগ্যবান—আমাদের ৬০ শতাংশেরও বেশি মানুষের বয়স ৩৫ বছরের নিচে। তাই অভিবাসন প্রক্রিয়াকে সহজ করলে তা উভয় পক্ষের জন্যই উপকারী হবে। তরুণ জনসংখ্যার এই সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে আমরা উন্নত বিশ্বের শ্রম সমস্যার সমাধান ও প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হবো।

মাননীয় সভাপতি,

বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম ইতোমধ্যেই প্রমাণ করেছে যে তারা সমাজ পরিবর্তনের চালিকাশক্তি। আমরা তাদের দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ করছি—তথ্যপ্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, নবায়নযোগ্য শক্তি, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। আমাদের লক্ষ্য হল—প্রত্যেক তরুণকে শুধুমাত্র চাকুরিপ্রার্থীর পরিবর্তে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা।

এ উদ্দেশ্যে আমরা জাতিসংঘের সঙ্গে অংশীদারিত্বে, মাঠ পর্যায়ের তরুণদের সঙ্গে সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের যুক্ত করার একটি স্থায়ী মাধ্যম চালু করছি। ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে সারা দেশে একাধিক পরামর্শ সভার আয়োজন করা হয়েছে। আজকের তরুণরা স্থানীয় পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে— অনলাইন ও অফলাইন ফোরাম, জরিপ এবং প্রচারণার মাধ্যমে তাদের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকতে চায়। তারা নেতৃত্ব বিকাশ, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং ডিজিটাল সক্ষমতা উন্নয়নের জন্য আরও বেশি সুযোগ চায়। তারা চায় এই প্রক্রিয়ায় জবাবদিহিতা অন্তর্ভুক্ত থাকুক—নিয়মিত অগ্রগতি প্রতিবেদন এবং অব্যাহত সংলাপের প্রতিশ্রুতি থাকুক। সর্বোপরি, প্রক্রিয়াটি হোক অন্তর্ভুক্তিমূলক যাতে নারী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, প্রতিবন্ধী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সকলের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বের সমান সুযোগ থাকবে।

তরুণদের নিয়ে পরিকল্পনার ক্ষেত্রে এ বছরটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এ বছর আমরা বিশ্ব যুব কর্মপরিকল্পনার ৩০তম বার্ষিকী পালন করছি। শুধু বর্তমান প্রজন্মের তরুণদের চ্যালেঞ্জ নয়, এ বছর তাই ভবিষ্যতেও তারা যে সংকট ও সমস্যার মুখোমুখি হবে, তা অনুধাবন করে তার সম্ভাব্য সমাধান খুঁজে বের করবারও সুযোগ এনে দিয়েছে।

দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির এই যুগে উন্নয়নশীল বিশ্বের তরুণদের জন্য আরও গভীর এক ডিজিটাল বিভাজন তৈরি হওয়ার ঝুঁকি আজ আমাদের একটি বড় উদ্বেগ।

কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ভাষা-ভিত্তিক বৃহৎ মডেল কিংবা আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা—এসব প্রযুক্তি যেন তাই পক্ষপাতদুষ্ট না হয়, এবং এর সুফল যেন ন্যায্যভাবে সবার কাছে পৌঁছায় তা আজ আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় বিশ্বব্যাপী এমন একটি প্রজন্ম তৈরি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে যারা নিজেদের বঞ্চিত, প্রান্তিক, অন্যায় ও অবিচারের শিকার হিসেবে বিবেচনা করবে। তারা সকল ধরনের ক্ষতিকারক প্রলোভনের সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে।

আমরা মনে করি, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সুফল বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়ে তরুণদের ঝুঁকিমুক্ত রাখার জন্য শুধু প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন সামাজিক উদ্ভাবন।

প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে আমরা ক্ষুদ্রঋণের ধারণা নিয়ে এসেছিলাম। তখন সেটি ছিল প্রথাগত ধারণার বিরুদ্ধে এক বৈপ্লবিক নিরীক্ষা—কিন্তু আজ বিশ্বব্যাপী তা মূলধারার হাতিয়ার হিসেবে স্বীকৃত। ক্ষুদ্রঋণ, লক্ষ লক্ষ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করেছে। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গ্রামীণ আমেরিকা বছরে এখন চার বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ঋণ নিম্ন-আয়ের নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিতরণ করেছে, এবং এর প্রায় শতভাগ নিয়মিতভাবে পরিশোধ করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ও বিশ্বজুড়ে আমরা আজ ‘সামাজিক ব্যবসা’-র ধারণা প্রসার করছি। এটি এক ব্যবসা যার সম্পূর্ণ মুনাফা  সামাজিক কল্যাণেই পুনর্বিনিয়োগ করা হয় । ‘সামাজিক ব্যবসা’ প্রমাণ করছে যে প্রতি মানুষের উদ্যোক্তা সত্ত্বা সামাজিক কল্যাণে ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে কাজে লাগানো সম্ভব। এর ফলে পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যার সমাধানের একটি সৃজনশীল পদ্ধতি সকলের হাতে এসে যায়— যেটি পরিবেশের সমস্যা হোক, সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ার সমস্যা হোক, স্বাস্থ্যের সমস্যা হোক, বেকারত্ব দূরীকরণের সমস্যা হোক, দারিদ্র্য দূরীকরণের সমস্যা হোক— সব কিছুতে এই পদ্ধতি টেকসই বা কাজে লাগানো যায়। 

মাননীয় সভাপতি,

জলবায়ু সংকট চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় বিশ্বজনীন তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্যমাত্রা আজ আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু সহায়তার প্রতিশ্রুতিও পূরণ হয়নি। বরং যে ক্ষুদ্র অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ হয়ে থাকে, তাও কাগজে কলমে দেখানো হচ্ছে বহুগুণ হিসেবে। এটি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।

আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। “লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড” পুরোপুরি চালু করতে হবে। জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রশমনের উদ্যোগ যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি অভিযোজনেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। আর অভিযোজন প্রচেষ্টা হতে হবে দেশজ, স্থানীয়ভাবে নির্ধারিত ও  পরিচালিত। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে স্থানীয়ভাবে সংবেদনশীল অভিযোজনের নীতিকে মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে। আসন্ন কপ-৩০ সম্মেলনে আমরা তৃতীয় বারের মত জলবায়ু পরিবর্তন রোধকল্পে আমাদের জাতীয় প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করবো, যেখানে জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রশমন লক্ষ্যের পাশাপাশি অভিযোজন উদ্যোগও থাকবে—বিশেষ গুরুত্ব পাবে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল রক্ষা ও জলাভূমি পুনরুদ্ধার। একইসঙ্গে আমরা আশা করি যে বৈশ্বিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে উচ্চ-কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো, তাদের দায়িত্বটুকু আন্তরিকভাবে পালন করবে।

মাননীয় সভাপতি,

বর্তমানের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিশ্ব বাণিজ্যে সংরক্ষণবাদের উত্থান। আমাদের সময়ে আমরা দেখেছি বাণিজ্য ও বিশ্বায়নের সুফল মাত্র তিন দশকে একশ’ কোটির মত মানুষকে দারিদ্র্য মুক্ত করেছে। এখন যদি আমরা উল্টো পথে হাঁটি, তবে আমাদের সন্তানদের আর সেই সুযোগ থাকবে না।

এটা অনস্বীকার্য যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে, প্রতিটি দেশের সার্বভৌম স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে হবে এবং কোনো দেশকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা বইতে দেয়া যাবে না। কিন্তু বৈশ্বিক শান্তি ও সমৃদ্ধি টিকিয়ে রাখার স্বার্থে উন্মুক্ত, ন্যায়সঙ্গত ও নিয়মভিত্তিক বৈশ্বিক বাণিজ্যের কোনো বিকল্প নেই। তাছাড়া বৈশ্বিক বাণিজ্যে দ্রুত সামাজিক ব্যবসার প্রসার ঘটাতে হবে। উন্নয়ন সহায়তার একটি বড় অংশ সামাজিক ব্যবসা প্রসারে বিশ্বময় ক্রমাগতভাবে জোরদার করতে হবে।

আমার প্রজন্ম দেখেছে কিভাবে একটি পারস্পরিক নির্ভরশীল বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেকোন সংঘাতকে ব্যয়বহুল করে তুলেছে এবং বিশ্বে শান্তি টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে। আজ বিশ্বব্যাপী ১২০টিরও বেশি সশস্ত্র সংঘাত চলছে—পারস্পরিক অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা ভেঙে গেলে  এ রকম সংঘাত আরও বাড়বে,  ব্যাহত হবে উন্নয়ন, বিনষ্ট হবে বিশ্ব শান্তি।

মাননীয় সভাপতি,

আমাদের প্রতিবেশী দেশ মায়ানমারে চলমান সংঘাত সমগ্র অঞ্চলের জন্য এক গভীর উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এটি যে শুধু আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকেই ঝুঁকিতে ফেলছে না, তা নয়,  বরং বাংলাদেশে আশ্রয়পাপ্ত বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমি মায়ানমারে প্রত্যাবাসনকেও কঠিন করে তুলেছে।

আট বছর পার হলেও রোহিঙ্গা সংকটের কোনো সমাধান দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। উপরন্তু, বাংলাদেশ প্রতিনিয়তই মায়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বাধ্য হচ্ছে। স্পষ্টতই, সাংস্কৃতিক পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির কারণে রোহিঙ্গাদের ওপর অধিকার বঞ্চনা ও নির্যাতন রাখাইনে অব্যাহত রয়েছে।

রোহিঙ্গাদের প্রান্তিকীকরণের প্রক্রিয়া আর চলতে দেওয়া যাবে না। যেসব বৈষম্যমূলক নীতি ও কর্মকাণ্ড আজকের এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে, তার সমাধান এবং প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা এখনই গ্রহণ করা সম্ভব। তার জন্য পূর্ণাঙ্গ জাতীয় রাজনৈতিক মীমাংসার অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। রাখাইনের সমস্যাগুলোর চূড়ান্তভাবে রাজনৈতিক সমাধান করাও অপরিহার্য। তবে এর জন্য রাখাইন অঞ্চলের সংশ্লিষ্ট সকল জাতিসত্ত্বার অংশগ্রহণে এমন একটি বন্দোবস্ত প্রয়োজন যেন রোহিঙ্গারা সমঅধিকার ও নাগরিকত্বসহ সমাজের অংশ হতে পারে।

এই সংকটের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী রোহিঙ্গারা, আর তাদের পরেই বৃহত্তম ভুক্তভোগী হল বাংলাদেশ। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, রোহিঙ্গা সংকট কোনোভাবেই মায়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের  কোনো দ্বিপাক্ষিক বিষয় নয়। আমরা শুধু একটি দায়িত্বশীল প্রতিবেশী এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে আমাদের মানবিক দায়িত্ব পালন করে আসছি। কিন্তু তহবিল সংকটের কারণে আজকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ন্যূনতম জীবনমান বজায় রাখার আমাদের যৌথ প্রয়াসও ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি তাদের জরুরি সহায়তা কার্যক্রমে মারাত্মক তহবিল ঘাটতির বিষয়ে ইতোমধ্যে সতর্ক করেছে। অবিলম্বে নতুন তহবিল না এলে, মাসিক রেশন অর্ধেকে নামিয়ে এনে মাথাপিছু মাত্র ৬ মাকিন ডলারে নামতে পারে, যা রোহিঙ্গাদের অনাহার ও অপুষ্টিতে নিমজ্জিত করবে যা তাদেরকে আগ্রাসী কোনো পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করতে পারে। তহবিলের অতিরিক্ত কাটছাঁট হলে তা নিঃসন্দেহে সুরক্ষা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি বহুগুণ বৃদ্ধি করবে, যা ক্যাম্পের সীমানা ছাড়িয়ে যেতে পারে । তাই আমি বিদ্যমান দাতাদের সাহাজ্য বাড়াতে এবং সম্ভাব্য নতুন দাতাদের অনুদান প্রদানের আহ্বান জানাচ্ছি, যাতে এ বিপর্যয়কর পরিস্থিতি এড়ানো যায়।

মানবিক সহায়তার জন্য নতুন ও বর্ধিত তহবিলের বাইরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই মায়ানমার সরকার বা রাখাইনের অন্যান্য অংশীদারদের উপর ইতিবাচক পরিবর্তন ও দ্রুত রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে হবে। অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলোকেও তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। রাখাইনে স্থিতিশীলতা আনতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে কোনো যৌথ প্রচেষ্টায় সহযোগিতা দিতে বাংলাদেশ সদাপ্রস্তুত।

আমরা আশা করি, আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের উচ্চপর্যায়ের সম্মেলন বিশ্বব্যাপী দৃঢ় সংকল্প তৈরি করবে এবং রোহিঙ্গাদের জন্য বাস্তবসম্মত আন্তর্জাতিক সহায়তা নিশ্চিত করবে, যেখানে তহবিল সংগ্রহ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে। একইসঙ্গে, আন্তর্জাতিকভাবে একটি রোডম্যাপ গৃহিত হবে এবং সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান খুজে পাওয়া সম্ভব হবে।

মাননীয় সভাপতি,

শুধু মায়ানমার নয়, এ বছর, আমরা পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি প্রান্তেই সংঘাত প্রত্যক্ষ করেছি—ইউরোপ, দক্ষিণ এশিয়া কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে।

বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে আমরা বাস করি। বিশ্বের আর কোনো অঞ্চলেই এত সংখ্যক পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্র এত অল্প দূরত্বে অবস্থান করছে না। তাই নিরস্ত্রীকরণ ও পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তাররোধের গুরুত্ব আমরা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারি।

আমরা সময়ের সঙ্গে দুর্বল হয়ে পড়া বৈশ্বিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তিগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার জোর দাবি জানাচ্ছি। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানাচ্ছি। একইসঙ্গে আমরা পূর্ণ স্বচ্ছতার সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের যে অধিকার প্রতিটি দেশের রয়েছে তার  প্রতি সমর্থন জানাই।

একটি দায়িত্বশীল দেশ হিসেবে, আমাদের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করার আগেই, এই বছর, আমরা আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার আওতাধীন পারমাণবিক নিরাপত্তা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত যৌথ কনভেনশন-এ যোগদান করেছি। এই যোগদানের মাধ্যমে সর্বোচ্চ মানের পারমাণবিক নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতার প্রতি আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করছি।

মাননীয় সভাপতি,

আমি সবসময় মানুষকে আশার বাণী শুনিয়েছি, কখনো ভয় দেখিয়ে কিছু করা আমি সমর্থন করিনি। কিন্তু আজ আমাকে সেখান থেকে সরে এসে ভয়ংকর কিছু কথা বলতে হচ্ছে। আজ আমি সতর্ক করছি—চরম জাতীয়তাবাদ, অন্যের ক্ষতি হয় এমন ভূরাজনীতি, এবং অন্যের দুর্ভোগ ও পীড়নের প্রতি ঔদাসীন্য বহু দশকের পরিশ্রমে আমরা যে অগ্রগতি অর্জন করেছি তা ধ্বংস করে দিচ্ছে।

এর সবচেয়ে মর্মান্তিক চিত্র আমরা দেখছি গাজায়। শিশুরা না খেয়ে অকাল মৃত্যুবরণ করছে, বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে, হাসপাতাল, স্কুলসহ একটি গোটা জনপদ নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হচ্ছে। জাতিসংঘের স্বাধীন তদন্ত কমিশনের সাথে আমরাও একমত যে আমাদের চোখের সামনেই একটি নির্বিচার গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে; আমাদের দূর্ভাগ্য যে মানবজাতির পক্ষ থেকে এর অবসানে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি না। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।

বাংলাদেশের জনগণ ও বিশ্বের বিবেকবান নাগরিকদের পক্ষ থেকে আমি আবারও জোরালো দাবী জানাচ্ছি যে, পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ সমস্যার দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান এখনই বাস্তবায়ন করতে হবে। শুধুমাত্র ১৯৬৭ সালের পূর্বের সীমারেখার ভিত্তিতে, যেখানে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থাকবে, তখনই ন্যায়বিচার সম্পূর্ণভাবে কার্যকর হবে।

মাননীয় সভাপতি,

বাংলাদেশে আমরা বিশ্বাস করি যে, আমাদের একটি শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে—যেখানে সর্বস্তরে সহনশীলতা, অহিংসা, সংলাপ ও সহযোগিতার মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করা হবে। গত সাড়ে তিন দশক ধরে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অন্যতম শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে আমাদের অংশগ্রহণ, বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি আমাদের নিরবিচ্ছিন্ন অঙ্গীকারের এক বাস্তব প্রমাণ। এমনকি এই মুহূর্তে প্রায় ৬,০০০ বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী বিশ্বের সবচেয়ে সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে জাতিসংঘের আওতায় দায়িত্ব পালন করছেন এবং আজ পর্যন্ত মোট ১৬৮ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী তাঁদের দায়িত্বপালনকালে শহীদ হয়েছেন।

একাধিক গবেষণায় একথা বার বার প্রমাণিত হয়েছে যে, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রম অন্য যে কোনো একপাক্ষিক শান্তিরক্ষা উদ্যোগের তুলনায় অধিক টেকসই ও কার্যকর। তাই, বিশ্বের শান্তি রক্ষাকারী এই কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা ও কার্যকারিতা রক্ষায়—আমরা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা অভিযানের জন্য স্পষ্ট ও বাস্তবসম্মত ম্যান্ডেট, এবং পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ করবার দাবি জানাই। শান্তিরক্ষীদের নিরাপত্তা এবং তাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাও সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত।

দেশে এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে বহুভাষিকতাকে বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে উৎসাহিত করে, কারণ আমরা বিশ্বাস করি যে, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, পারস্পরিক বোঝাপড়াকে আরও গভীর করে। একবিংশ শতাব্দীতে কোনো সমাজেই ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা, বর্ণবাদ, বিদেশিদের প্রতি বিদ্বেষ বা ইসলামবিদ্বেষের কোনো স্থান নেই।

অথচ বর্তমানে বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা এবং ঘৃণাত্মক বক্তব্য গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে। গত বছর বাংলাদেশে ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিভ্রান্তিকর সংবাদ ছড়ানো হয়েছে, যা এখনো চলমান রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরিকল্পিত মিথ্যা সংবাদ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্ভর ‘ডিপফেক’-এর প্রসার, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। এসবের বিরুদ্ধে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে—যাতে এসব বিকৃত কর্মকাণ্ড মানুষের উপর মানুষের আস্থাকে বিনষ্ট না করে কিংবা সামাজিক সম্প্রীতিকে দুর্বল না করে।

মাননীয় সভাপতি,

আমাদের শীর্ষ অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো নারীর ক্ষমতায়ন। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়— ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’

প্রকৃতপক্ষে, বর্তমান বিশ্বে অনেক গুরুত্ব্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নারীদের অবদান অর্ধেকেরও বেশি। এ মাসে বাংলাদেশে প্রথমবারের মত ‘আনপেইড হাউজহোল্ড প্রোডাকশন স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট’ জরিপ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে দেখা যায় যে, অবৈতনিক পরিচর্যা ও গৃহস্থালি কাজের শতকরা ৮৫ ভাগেরও বেশি কাজ নারীরা একাই করে থাকেন, যার অর্থমূল্য আমাদের স্থূল দেশজ উৎপাদনের প্রায় ১৬ শতাংশ। বহু প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আজ আমাদের মেয়েরা শ্রেণিকক্ষ থেকে বোর্ডরুম, গবেষণাগার থেকে ক্রীড়াঙ্গন—সবখানেই বাধা অতিক্রম করে সফল হচ্ছে। সম্প্রতি আমাদের নারী ফুটবল দল আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছে, আন্তঃএশীয় প্রতিযোগিতার জন্য উত্তীর্ণ হয়েছে, এবং সারা দেশের লাখো মানুষকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে।

নারীর নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং সমান সুযোগ সুনিশ্চিত করার জন্য আমার সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ বছর আমরা বেইজিং ঘোষণা-পত্রের ৩০তম বার্ষিকী উদযাপন করছি। এ উপলক্ষে নারীর ক্ষমতায়নে আমাদের অঙ্গীকারকে আরও জোরদার করতে আমরা ‘বেইজিং+৩০ অ্যাকশন এজেন্ডা’-এর অধীনে আগামী পাঁচ বছরে বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে চারটি জাতীয় প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছি।

এর মধ্যে রয়েছে— যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সুরক্ষা সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা,  নারীর অবৈতনিক পরিচর্যা ও গৃহস্থালি কাজের স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক ও জনপরিসরে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা, এবং নারীর সমতা ও ক্ষমতায়নের প্রতি সংবেদনশীল বাজেট প্রণয়ন পদ্ধতি শক্তিশালী করা।

মাননীয় সভাপতি,

বাংলাদেশ পারষ্পরিক শ্রদ্ধা, স্বচ্ছতা এবং কল্যাণের ভিত্তিতে আঞ্চলিক সহযোগিতায় অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমরা ইওগঝঞঊঈ, ইইওঘ, এশিয়ান হাইওয়ে এবং এসএএসইসি-এর মতো উদ্যোগের মাধ্যমে আঞ্চলিক সংযোগ ও বাণিজ্যকে এগিয়ে নিচ্ছি। একই সাথে আমরা আসিয়নের মত কার্যকরী আঞ্চলিক ফোরামে যুক্ত হওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছি এবং এই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।

দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা—সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য আমরা দৃঢ় আহ্বান জানাচ্ছি। চার দশক আগে গঠিত এই সংস্থা প্রাথমিক পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছিল এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি করেছিল। রাজনৈতিক অচলাবস্থার পরও এর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো কার্যকর রয়েছে এবং আমরা বিশ্বাস করি যে, সার্ক এখনো আমাদের অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের জন্য কল্যাণ এনে দিতে সক্ষম—যেমনটি অঝঊঅঘ তাদের অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের জন্য করতে পারে।

সম্মিলিত উন্নয়নের জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার কোনো বিকল্প নেই। একই সাথে অভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারে ন্যায্যতা ও সহমর্মিতার চর্চা করা একান্ত প্রয়োজন। প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার নিয়ে শান্তিপূর্ণ আঞ্চলিক সহযোগিতায় বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ। তাই প্রথম দক্ষিণ এশীয় দেশ হিসেবে সম্প্রতি আমরা জাতিসংঘের পানি সংক্রান্ত কনভেনশনে যোগ দিয়েছি।

মাননীয় সভাপতি,

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রাজনৈতিক শোষণ, সম্পদ লুণ্ঠন ও কাঠামোগত বৈষম্য আজকের অসম উন্নয়নের বাস্তবতা তৈরি করেছে। আজ থেকে এক দশক পূর্বে যখন আমরা এজেন্ডা ২০৩০ অর্জনে একমত হয়েছিলাম। তখন আমরা পথ পরিবর্তন করে সঠিক লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া নিয়ে আশাবাদী হয়েছিলাম। কিন্তু আজকের বাস্তবতা হলো—টেকসই উন্নয়নের অভীষ্ট বাস্তবায়নের যে অগ্রগতি কাম্য ছিল তা মারাত্মকভাবে পিছিয়ে পড়েছে। উন্নয়নে অর্থায়নের ঘাটতি ক্রমশ বাড়ছে এবং উন্নয়ন সহায়তার (ওডিএ) প্রবাহ কমছে। আমরা দাতা দেশসমূহকে এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে তাদের অঙ্গীকার পূরণ করতে আহ্বান জানাই।

আমরা স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় আছি। আমাদের মসৃণ ও টেকসই উত্তরণ নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের, বিশেষ করে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি। এ বিষয়ে আমরা ঙঐজখখঝ সহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের কার্যক্রমকে সাধুবাদ জানাই। স্বল্পোন্নত দেশসমূহ এবং ঝুঁকিতে থাকা অন্যান্য দেশগুলোর প্রতি আরও কার্যকর সহযোগিতা প্রদানের জন্য আমরা এই দপ্তরকে আরও শক্তিশালী করার আহ্বান জানাই।

একই সঙ্গে অনুদান, ঋণের পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে সামাজিক ব্যবসা খাতকে বিপুলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। এই নতুন পদ্ধতি দাতা ও গ্রহীতা উভয় দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে এবং উৎসাহব্যঞ্জক হবে। সৃজনশীলতার অতি উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে সহায়ক হবে।

মাননীয় সভাপতি, 
বাংলাদেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নের অভিযাত্রায় জাতিসংঘের অবদানকে আমরা সাধুবাদ জানাই। বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা, উন্নয়ন এবং মানবাধিকার—জাতিসংঘের এই তিনটি স্তম্ভের প্রতিই আমরা আমাদের পূর্ণ আস্থা পুনর্ব্যক্ত করছি।

আমার বক্তব্যের শুরুতেই আমি বলেছিলাম যে, গত আট দশকে জাতিসংঘ বার বার দেখিয়েছে যে বহুপাক্ষিক কূটনীতি মানবজাতিকে আরও ভালোভাবে একসঙ্গে বেঁচে থাকতে সহায়তা করে। তবুও, এর ৮০তম বার্ষিকীতে আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে বহুপাক্ষিক কূটনীতি আজ নানান চাপে রয়েছে। প্রায়শই অসম দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের টানাপোড়েন আবারও প্রমাণ করেছে যে বহুপাক্ষিক কূটনীতি আমাদের শেষ এবং সর্বোত্তম ভরসা। তাই বহুপাক্ষিক কূটনীতির ধারক ও বাহক জাতিসংঘকে উজ্জীবিত রাখতে আমরা সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সাথে পূর্ণ স্বচ্ছতা ও আন্তরিক আলোচনার আহ্বান জানাই।

বর্তমান সময়ের দাবি মেটাতে এবং বহুপাক্ষিকতার প্রতি আমাদের যৌথ আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে হলে জাতিসংঘকে ক্রমাগত বিকশিত ও অভিযোজিত হতে হবে। এই মর্মে আমরা মহাসচিবের ইউএন৮০ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। তবে একই সঙ্গে জোর দিয়ে বলতে চাই যে, সংস্কারের নামে যেন বহুপাক্ষিকতাকে দুর্বল না করা হয় বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর কণ্ঠস্বরকে অবহেলা না করা হয়। সংস্কারের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত মাঠপর্যায়ে বাস্তব ও ইতিবাচক পরিবর্তন আনা।

মাননীয় সভাপতি,
গত বছর, আমার জনগণ প্রমাণ করেছে যে এ জগতে অন্যায়ের বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। তারা প্রমাণ করেছে যে পরিবর্তন যেমন সম্ভব, তেমনি অপরিহার্য।

আমাদের মনে রাখা দরকার যে, সামনের দিনে যে চ্যালেঞ্জগুলো আসছে তা কোনো দেশের পক্ষে একা মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে, বর্তমান পৃথিবীতে কোনো একটি দেশ সংকটে পড়লে, অথবা বিশ্বের কোনো এক প্রান্তে সংকট দেখা দিলে— সমগ্র বিশ্বের নিরাপত্তাই ঝুঁকির মুখে পড়ে যায়।

আমাদেরকে তিন শূণ্যের পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। তরুণরা তিন শূণ্য বাস্তবায়নের সৈনিক হয়ে বড় হবে। তাদের সামনে থাকবে শূণ্য কার্বন, শূণ্য সম্পদ কেন্দ্রীভূতকরণ, এবং শূণ্য বেকারত্ব— এর ভিত্তিতে তারা গড়ে তুলবে তাদের পৃথিবী।

তিন শূণ্যের পৃথিবী গড়া জাতিপুঞ্জের সকলের স্বপ্ন হোক— এ কামনা ব্যক্ত করে আমার বক্তব্য সমাপ্ত করলাম।

আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়