আজ উন্মোচিত ২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের সংকটগুলো উপেক্ষা করায় সমালোচনার মুখে পড়েছে।
উচ্চ প্রত্যাশা সত্ত্বেও, বাজেটে প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণ, জীবনমান উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা বা নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য কোনো নতুন উদ্যোগ ঘোষণা করা হয়নি।
রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রক্রিয়াকে আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর করার দিকেও কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
বিশেষ করে, বিদেশে নিযুক্ত নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়ে — যারা নানা রকম শোষণ ও নির্যাতনের শিকার হন — বাজেটে কোনো নজর দেয়া হয়নি।
একটি ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থেকে অনেক প্রবাসী শ্রমিকই একটি জনগণকেন্দ্রিক বাজেট এবং তাদের সংগ্রাম ও স্বপ্নকে প্রতিফলিত করা প্রকল্প ও প্রণোদনার প্রত্যাশা করেছিলেন।
কিন্তু সরকার নতুন কোনো কল্যাণমূলক কর্মসূচি ঘোষণার বদলে শুধু আরও বেশি শ্রমিক বিদেশে পাঠানোর জন্য দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পেই মনোযোগ দিয়েছে।
এই লক্ষ্য পূরণে, বাজেটে জেলা পর্যায়ে ৭০টি এবং উপজেলা পর্যায়ে ৪০টি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (TTC) শক্তিশালীকরণ এবং ৫০টি নতুন TTC নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
কিছু ডিজিটাল পদক্ষেপও উল্লেখ করা হয়েছে। ছয়টি জেলায় ইতিমধ্যে চালু হওয়া এক্সিট ক্লিয়ারেন্স সেবা দেশব্যাপী বিস্তারের পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া, প্রতারিত শ্রমিকদের জন্য ডিজিটাল অভিযোগ দাখিল ও নিষ্পত্তি ব্যবস্থাও চালু করা হবে।
জেলা পর্যায়ে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (ADR) ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ, তদন্ত কর্মকর্তাদের ক্ষমতা প্রদান এবং অভিযোগ ব্যবস্থাপনা সেল চালু করার পরিকল্পনাও বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বিদেশি ভাষা শিক্ষা ও আরও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের কথাও আবারও বলা হয়েছে।
তবে, অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মীদের মতে, বাজেটটি প্রবাসী শ্রমিকদের মৌলিক সমস্যাগুলো উপেক্ষা করেছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ গত বছরের ১,২১৭ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে এবার ৮৫৫ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে — যা ৩৬২ কোটি টাকার হ্রাস।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন অ্যান্ড ইয়ুথ ইনিশিয়েটিভস প্রোগ্রামের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, “বিদেশগামী শ্রমিকরা বহুমাত্রিক সংকটে রয়েছেন, যা বাজেটে প্রতিফলিত হওয়ার দরকার ছিল।”
তিনি বলেন, “এটা এক ধরনের পরিহাস যে, বাজেটে প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য কোনো আশার আলোই রাখা হয়নি।”
“সরকার এবারও প্রবাসী শ্রমিকদের দুঃখ-কষ্টের প্রতি নজর দেয়নি। সমাজসেবা অধিদপ্তরের মতো আলাদা বরাদ্দ এবং বিভিন্ন প্রকল্প-প্রণোদনার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু তা বাজেটে নেই।”
তিনি আরও বলেন, “শুধু মৃতদেহ ফেরানো নয়, প্রবাসী শ্রমিকদের জীবনের মানোন্নয়ন, অধিকার, স্বাস্থ্য, প্রত্যাবর্তনের পর সহায়তা, বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়গুলো বাজেটে উপেক্ষিত।”
শরিফুল সরকারকে অভিযুক্ত করে বলেন, “সরকার যেন রেমিট্যান্স আদানে আগ্রহী, কিন্তু শ্রমিকদের কল্যাণে নয়।”
অভিবাসন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোহাম্মদ জালাল উদ্দিনও বাজেটে কাঠামোগত সমস্যা সমাধানে অবহেলার কথা বলেন।
তিনি বলেন, “সরকার শ্রমিকদের উন্নয়নে যথাযথ তহবিল বরাদ্দ করেনি। কাঠামোগত জটিলতা কমানোই তাদের সবচেয়ে বড় চাহিদা।”
তিনি আরও বলেন, “যেটুকু সুযোগ সুবিধা আছে তা মূলত শ্রমিকদের নিজেদের অর্থেই পরিচালিত — যেমন, ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ডের সেবা বা প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক। এই ব্যাংকটি সরকারের তহবিলে পরিচালিত হওয়া উচিত এবং এর শাখা বাড়ানোর জন্য আরও অর্থ বরাদ্দ হওয়া প্রয়োজন।”
স্থান সংকট থাকলে, বিদ্যমান ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ে ক্ষুদ্র শাখা পরিচালনারও প্রস্তাব দেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, “ব্যর্থ বা প্রত্যাবর্তিত শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম কাগজপত্রে কম সুদে বড় ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা থাকা দরকার।”
টিটিসিগুলোর বিষয়ে তিনি বলেন, “এসব কেন্দ্রকে আধুনিকীকরণ করা জরুরি। বাজেটের একটি বড় অংশ এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র উন্নয়নে বরাদ্দ করা দরকার।”
অনেকে আশাবাদী ছিলেন, এবারের বাজেটে রেমিট্যান্স প্রণোদনা বাড়বে। কিন্তু তা অপরিবর্তিত ২.৫ শতাংশই রাখা হয়েছে।
সমালোচকরা বলছেন, হুন্ডির চেয়ে প্রতিযোগিতামূলক হার না দিলে প্রবাসীরা আনুষ্ঠানিক পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে আগ্রহী হবেন না।
২০১৯–২০ অর্থবছর থেকে সরকার রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ প্রণোদনা দিয়ে আসছে, যা ২০২২ সালে বাড়িয়ে ২.৫ শতাংশ করা হয়। বর্তমানে একজন প্রবাসী প্রতি ১০০ টাকা পাঠালে, দেশে প্রাপক পান ১০২.৫ টাকা — অতিরিক্ত ২.৫ টাকা সরকার ভর্তুকি দেয়। উৎস: ডেইলি স্টার।