শিরোনাম
◈ বেনজীর আহমেদের চ্যালেঞ্জ: কেউ দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারলে তাকে সব সম্পত্তি দিয়ে দেবো ◈ চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, হিট স্ট্রোকে একজনের মৃত্যু ◈ আইনজীবীদের গাউন পরতে হবে না: সুপ্রিমকোর্ট ◈ তীব্র গরমে স্কুল-কলেজ ও মাদরাসা আরও ৭ দিন বন্ধ ঘোষণা ◈ সিরিয়ায় আইএসের হামলায় ২৮ সেনা নিহত ◈ সরকার চোরাবালির ওপর দাঁড়িয়ে, পতন অনিবার্য: রিজভী  ◈ সরকারের বিরুদ্ধে অবিরাম নালিশের রাজনীতি করছে বিএনপি: ওবায়দুল কাদের ◈ বুশরা বিবিকে ‘টয়লেট ক্লিনার’ মেশানো খাবার খাওয়ানোর অভিযোগ ইমরানের ◈ গাজায় নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়াল ◈ প্রার্থী নির্যাতনের বিষয়ে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে, হস্তক্ষেপ করবো না: পলক

প্রকাশিত : ০২ জুলাই, ২০২২, ০২:১৮ দুপুর
আপডেট : ০২ জুলাই, ২০২২, ০২:১৮ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিলে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব 

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

ভূঁইয়া আশিক রহমান : উন্নয়ন-অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেছেন, বিগত বাজেটগুলোর তুলনায় এবারের বাজেট  অনেকটা রিজেনেবল। যতোদূর সম্ভব একটি সময়োপযোগী বাজেট বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তবে বাজেট বাস্তবায়নে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত হচ্ছে ইউক্রেন-রাশিয়া ও কোভিড পরবর্তী দেশের অর্থনীতিতে যে চ্যালেঞ্জ এসেছে তা মোকাবেলার কলাকৌশল নির্ধারণ করা এবং বাস্তবায়নে যথেষ্ট দক্ষতা প্রদর্শন করা। ২০২৬ সালে বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার জন্য যে লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, তা মিলানো। সেসব লক্ষ্য মাথায় রেখেই বাজেট বানানোর চেষ্টা ছিলো বলে প্রতিয়মান হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়ন সক্ষমতা নিয়ে সবসময়ই যে প্রশ্ন থেকে যায়। সেটি রয়েই যাচ্ছে। বাজেট বাস্তবায়ন করা যাবে কি? বাস্তবায়ন করতে গেলে কী কী হবে। সেদিকে নজর দেওয়া হবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। 

তিনি বলেন, সব মহল থেকে যখন স্বাস্থ্য খাতের বিশেষ করে স্বাস্থ্য সেবা খাতে ব্যয় বরাদ্দের ওপর গুরুত্বারোপ চলছে সেখানে স্বাস্থ্য সেবা মেডিটেশনের ওপর যে কর আরোপ করা হয়েছে, তা স্ববিরোধী প্রতীয়মান হয়েছে। মেডিটেশনের ওপর করারোপের যৌক্তিকতা সে নিরীখে দেখা দরকার। করের সংখ্যা না বাড়ালে অনেকেই কর ফাঁকি দেবে। এতে যারা কর দিচ্ছেন তাদের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে। আবার জনগণের দেওয়া করের টাকা যথাযথভাবে ব্যয় হচ্ছে নাকি বেহাত হচ্ছে এবং তাতে কর-দাতাদের  নিরুৎসাহের কারণ ঘটছে কিনা, সেটা দেখার বিষয়।

আবদুল মজিদের মতে, তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জÑ করোনাভাইরাসে ধরাশায়ী অর্থনীতির ওঠে দাঁড়ানো, কিয়েভ-ক্রেমলিন যুদ্ধের অভিঘাতে আমদানিনির্ভর অর্থনীতিতে সৃষ্ট বিপর্যয় মোকাবেলা এবং আগামী বছর চারেকের মাথায় মধ্যম আয়ের দেশের তকমা পাওয়ার জন্য জোর প্রস্তুতির প্রাক্কালে বাংলাদেশের ২০২২-২৩ বাজেট বর্ষের জাতীয় বাজেটের আকার অবয়ব নিয়ে চিন্তাভাবনার অবকাশ এমনিতেই এসে যায়। বিষয়টি এ কারণেও গুরুত্ববহ যে, মহামারি মোকাবেলায় একটি উদীয়মান উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য যেসব চ্যালেঞ্জ ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে, তা কী ধরনের কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে উতরানো যাবে, পুনরুদ্ধার তথা আগের অবস্থায় ফিরে আসা যাবে, তার একটা পথনকশা বাজেটে প্রত্যাশিত ছিলো, অনেকটা সে আশা পূরণও হয়েছে। এখন বাস্তবায়ন ব্যাপারটা সামনে চলে আসবে। 

বাংলাদেুশের অর্থনীতিকে নিম্ন থেকে নিম্নধ্যবিত্তের তকমা পেতে হলে সব খাত ও ক্ষেত্রে একযোগে উন্নয়নশীল হতে হবে। সামগ্রিকভাবে কৃষি খাতের উন্নতি একটি সম্মিলিত প্রয়াস-যেখানে কৃষিবিদ, কৃষিবিজ্ঞানী, কৃষক ও কৃষি উপকরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রাইভেট সেক্টর, আমিষ, শর্করা সরবরাহকারীরাও সরাসরি জড়িত। কৃষিক্ষেত্রে ভর্তুকি/প্রণোদনা যেন যথাযথভাবে এবং যথাসময়ে সত্যিকার প্রান্তিক চাষি ও খামারিরা পায়। কৃষিতে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে  হাওড়ের বাঁধ কিংবা উপকূলীয় অঞ্চলের বেড়িবাঁধ স্থায়ীভাবে নির্মাণের পদক্ষেপ থাকা আবশ্যক হবে। নতুন নতুন উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণে বাংলাদেশে প্রাইভেট সেক্টরের অবদান কম নয়। সেজন্য পাবলিক সেক্টরের পাশাপাশি প্রাইভেট সেক্টরেও বাজেট বরাদ্দ থাকা উচিত। রাসায়নিক সারের তুলনায় জৈবসার মাটির স্বাস্থ্য ভালো করে বিধায় রাসায়নিক সারের মতো বাজেটে জৈবসার উৎপাদনে ভর্তুকির ব্যবস্থা রাখা, দেশের প্রান্তিক চাষিরা যাতে তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায়, তার সুস্পষ্ট কৌশল, মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রতিরোধ, প্রতারক, পথে পথে চাঁদাবাজের দৌরাত্ম্য, প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত দুর্নীতি কমানোর কমিটমেন্ট বাজেটে থাকা দরকার। বাংলাদেশের প্রায় সব সেক্টরেই বিমার ব্যবস্থা থাকলেও গত বাজেটে কৃষি ও কৃষকের বিমার প্রস্তাবনা থাকার পরও তা বাস্তবায়িত হয়নি। প্রান্তিক চাষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তা, খামারি, মাছ চাষির কাছে স্টিমুলাস প্যাকেজের টাকা সময়মত এখনো পৌঁছায়নি। ব্যাংক বা আর্থিক খাতে বিশাল ব্যাধির সুচিকিৎসার ব্যবস্থা হয়নি। ধনী আরও ধনী হওয়ার সহজ সুযোগে আয়-বৈষম্য বেড়েই চলেছে। অন্তর্ভুক্তির নামে বিচ্ছিন্নতাই বাড়তে থাকলে ‘কাউকে পেছনে ফেলা যাবে না’ এসডিজি গোল অর্জনের এ মর্মবাণী সকরুণ ব্যর্থতার বিবরে উন্নয়নশীল অর্থনীতির কপোলে কালো তিলক আঁকতেই থাকবে।

গ্রামীণ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় বরাদ্দ বৃদ্ধি, আরও কর্মসৃজনমূলক সৃজনশীল খাত সৃষ্টি এবং নমিনাল টার্মে বেশি থাকা দরকার এবং বন্টনে পক্ষপাতিত্বহীন ও স্বচ্ছ হওয়া আবশ্যক। ৫০ লাখ প্রাপককে যে বিশেষ অর্থ প্রদান করা হয়েছিলো এবং সামনে ঈদ উপলক্ষ্যে ১ কোটি প্রাপককে প্রদানের ঘোষণা আসছে, তা বিলি-বন্টনে ন্যায্যতা, সঠিক গন্তব্য ও প্রাপ্যতা নিয়ে এখনো যে সংশয় সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে, তার নিরসনে ব্যবস্থা বা নজর থাকা আবশ্যক হবে।

এ মুহূর্তে করোনা ও কিয়েভ-ক্রেমলিন সমর অভিঘাত মোকাবিলায় দেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে চলমান ও টেকসই রাখতে সুপরিকল্পিত ও সম্প্রসারণধর্মী বাজেটের কোনো বিকল্প নেই। করোনাকালে এবং করোনা-উত্তর পরিবেশ-পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়নশীল দেশে উন্নীতকরণ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত ও প্রগতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করতে একটি বহুমুখী, বাস্তবায়নযোগ্য এবং সম্প্রসারণশীল বাজেটের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও এবারের বাজেটি সংকোচনমূলক করতে হয়েছে। সুতরাং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো ও এর গতিপ্রকৃতির সঙ্গে তুলনা করলে সাম্প্রতিককালের বাজেটটিকে উচ্চাভিলাসী বলা চলে না। এ দেশের অর্থনীতির ভিত মজবুত করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা, অবকাঠামোগত উন্নয়নে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা, সামাজিক নিরাপত্তা বলয় বৃদ্ধি, সামগ্রিক ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করা এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নের জন্য বাজেটের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি করার অবকাশ রয়েছে।

রাজস্ব আহরণ খাতে চলমান সংস্কার ও অনলাইনিকরণ বাস্তবায়নে দৃঢ়চিত্ত ও সময়সূচিভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণ করা উচিত। বিদ্যমান আইনের সংস্কার এবং অনলাইনিকরণ ব্যতিরেকে বিদ্যমান কর্মকাঠামো ও লোকবল দিয়ে রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতি ও পরিবেশের উন্নয়ন সাধন সম্ভব ও সমীচীন হবে না। রাজস্ব আহরণ ও প্রদান ব্যবস্থাপনাকে গতিশীল ও আস্থায় আনতে সংসদের অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির তত্ত্বাবধানে সরকারি-বেসরকারি খাত সমন্বয়ে উপদেষ্টা প্যানেল প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। প্যানেল থেকেই কর নীতি ও রাজস্ব আহরণ পদ্ধতি প্রক্রিয়ার সংস্কার প্রস্তাব আসতে পারে। জাপানসহ অনেক উন্নত অর্থনীতির দেশে এ ধরনের রাজস্ব ব্যবস্থাপনা আছে।

করদাতা এবং কর আহরণকারী দপ্তরের মধ্যে রাজস্ব আহরণ বিষয়ক জটিলতা ও সমস্যা আপিল আবেদন নিষ্পত্তি উপরিদর্শনের মাধ্যমে পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কর ন্যায়পাল অফিস পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। ২০০৫ সালে যে উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়ে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান কর ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ২০১১ সালে অর্থাৎ মাত্র সাড়ে পাঁচ বছরের মাথায় বিশ^ব্যাপী অনুসৃত এই প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত করার প্রেক্ষাপটটি পুনঃপর্যালোচনার অবকাশ রয়েছে।

রাজস্ব আয়, জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং অর্থনীতির কিছু সূচকের লক্ষ্যমাত্রা সব সময় স্তবসম্মত হওয়া দরকার। এসবের পরস্পর প্রযুক্ততার বিশ্লেষণে গেলে স্ববিরোধিতা ফুটে ওঠে। এসব নিশ্চিত হতে গেলে [১] বিশ্বমন্দা দ্রুত কেটে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে বাংলাদেশের পোশাকের চাহিদা বাড়তে হবে, [২] মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের ফিরিয়ে নিতে হবে, [৩] দেশের মধ্যে সাধারণ মানুষের হাতে নগদ অর্থ থাকতে হবে, [৪] বাড়তে হবে চাহিদা, [৫] কেউ চাকরি হারাবেন না, কারও বেতনও কমবে না। সর্বোপরি, [৬] বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির ১২ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ হতে হবে। অথচ বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ১ শতাংশ বাড়াতে ৫ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে যে অর্থনীতিতে, যখন সেই অর্থনীতিতে করোনাভাইরাস বেসরকারি খাতনির্ভর বেসরকারি বিনিয়োগ এক অর্থবছরেই জিডিপির ২৪ দশমিক ২ শতাংশ থেকে কমে ১২ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে যাওয়ার মতো ক্ষতি ইতোমধ্যে সাধন করেছে এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির পতাকা ৮.২ স্কেল থেকে ৫.২-এ নামাতে হয়েছিল -এ বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়ে, বিবেচনায় রেখেই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হওয়া উচিত।

বাংলাদেশ বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে যাচ্ছে, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে বড় উলম্ফন হতে যাচ্ছে-এ ধরনের অনুমান আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও ভুল বার্তা দিতে পারে। এটি কোভিড মোকাবেলায় তহবিল পাওয়ার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এ বছর আপাতত প্রবৃদ্ধির চেয়ে মানুষের জীবনযাত্রা ও কর্মসংস্থান কতোটা টেকসই হবে, সেদিকে নজর রাখতেই হবে। বাজেট বছরে করোনা, সম্ভাব্য বৈশি^ক মন্দা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা ও জাতীয় পুঁজি সংবর্ধন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ন্যূনতম কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে ৭-৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়তো খুব কঠিন হবে না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়