ব্রুনাইয়ের সুলতান হাজী হাসানাল বলকিয়াহ মুইজ্জাদ্দিন ওয়াদদৌল্লাহের সম্পদ রূপকথাকে ও হার মানায় । বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও বিলাসী সুলতান হিসেবে তিনি সুপরিচিত।
১৯৬৭ সালে স্যার হাজি ওমর আলী সাইফুদ্দিন সিংহাসন ত্যাগ করার পর ১৯৬৮ সালের আগস্টে তার ছেলে হাসানাল বলকিয়াহ ব্রুনেইয়ের সুলতান হিসেবে রাজমুকুট পরিধান করেন। এই মূহুর্তে বিশ্বে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে সিংহাসনে থাকা শাসকদের অন্যতম তিনি। তিনি একই সাথে ব্রুনেইয়ের প্রধানমন্ত্রী এবং দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা। সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ তার বিলাসবহুল জীবনযাত্রার জন্যও বেশ আলোচিত। একজন শাসক হিসেবেও শীর্ষ সম্পদশালীদের অন্যতম ব্রুনেইয়ের সুলতান।
১৯৮৮ সাল পর্যন্ত হাসানাল বলকিয়াহ ছিলেন বিশ্বের শীর্ষ ধনী। ২০০৮ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন অনুসারে তার সম্পত্তির পরিমাণ ছিল দুই হাজার কোটি ডলার। বসবাসের জন্য স্বর্ণের প্রাসাদ বানিয়েছেন সুলতান। ১৯৮৪ সালে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত হয় ব্রুনেই। সেই বছরেই ২২ ক্যারাট স্বর্ণ দিয়ে প্রাসাদ গড়ে তুলেছিলেন তিনি। প্রাসাদের নাম ইস্তানা নুরুল ইমান। গিনেস বুকে নামও রয়েছে এই প্রাসাদের। এই নামের অর্থ ‘বিশ্বাসের আলোর প্রাসাদ’। ব্রুনেইয়ের দারুস সালামে অবস্থিত সুলতানের প্রাসাদ ইস্তানা নুরুল ইমান আকারে ভ্যাটিকান বা বাকিংহাম প্রাসাদের চাইতে অনেকগুণ বড়। গিনেস বুক অব রেকর্ডস অনুযায়ী এটি বিশ্বের সবচাইতে বড় প্রাসাদ।
প্রাসাদের নকশা বানিয়েছিলেন লিয়ান্ড্রো ভি লকসিন। ইসলাম এবং মালয় দুই রকম ঐতিহ্যের ছাপই রয়েছে এই প্রাসাদে। ব্যক্তিগত বসবাসের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাসাদ এটিই। ২০ লক্ষ বর্গফুট এলাকা জুড়ে বিস্তৃত প্রাসাদটি অত্যন্ত বিলাসবহুল। প্রাসাদে অন্তত ১৭০০টি ঘর রয়েছে। ২৫৭টি শৌচালয় এবং ৫টি সুইমিং পুল রয়েছে। এই প্রাসাদেই সুলতান থাকেন। ব্রুনেইয়ের সমস্ত প্রশাসনিক কাজও হয় এই প্রাসাদ থেকে। তার জন্য আলাদা আলাদা ঘর বরাদ্দ রয়েছে।
প্রাসাদের মধ্যে সুলতানের বিনোদনের জন্য একটি চিড়িয়াখানা রয়েছে। ধারণা করা হয়, সেখানে নানা প্রজাতির পাখির পাশাপাশি ৩০টি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার রয়েছে। সাধারণ মানুষের কাছে এই প্রাসাদ ঘুরে দেখার অনুমতি নেই। একমাত্র রমজান মাসের শেষে এক উৎসব উপলক্ষে সাধারণ মানুষ প্রাসাদে ঢুকতে পারেন। তিন দিন ধরে উৎসব চলে।
ব্রনাই সুলতানের নিজস্ব জেট বিমান রয়েছে। কোনো দেশ সফরে গেলে তিনি নিজস্ব বিমান ব্যবহার করে থাকেন। নিজের ব্যক্তিগত প্রাইভেট জেট বিমানটিকেও মুড়িয়েছেন সোনা দিয়ে। যেটিকে বলা হয় ভাসমান প্রাসাদ বা উড়ন্ত প্রাসাদ। ভাসমান এই প্রাসাদ নিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণ করেন তিনি। বোয়িং ৭৪৭-৪০০ বিমানটিকে মোড়ানো হয়েছে সোনা দিয়ে। এজন্য এটিকে বিশ্বের অন্যতম দামি বিমান বলা হয়। বর্তমানে একটি বোয়িং বিমানের দাম বাংলাদেশি টাকায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। তবে ব্রুনেই সুলতান যখন বিমানটি কেনেন তখন তার গুণতে হয়েছিল ১ হাজার কোটি টাকা।
এরপর এটিকে নিজের মতো করে সজ্জিত করেন বিভিন্ন বিলাসী জিনিসপত্র দিয়ে। এজন্য এর পেছনে খরচ হয়েছে আরও প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে বাংলাদেশি টাকায় এই বিমানের দাম প্রায় ৪০০০ কোটি টাকা। এই টাকা দিয়ে বিমানে দেওয়া হয় সোনার প্রলেপ। এছাড়াও বিমানটিকে সুসজ্জিত করতে আরও বিভিন্ন বহু মুল্যবান ধাতু ব্যবহার করা হয়েছে। সুলতানের ব্যবহারের জন্য তৈরি বাথরুমটি পুরোটাই তৈরি করা হয়েছে সোনা দিয়ে। বিমানের ভেতর প্রাইভেট অফিস থেকে শুরু করে একটি মাস্টার বেডরুম, কাস্টম টেবিলওয়্যার, টাইনিং হল, কনফারেন্স হলসহ বিশাল বর একটি লাউঞ্চ আছে।
তবে এছাড়াও সুলতান হাসানাল বলকিয়ার আরও একটি আড়াই হাজার কোটি টাকার বোয়িং ৭৬৭-২০০ বিমান আছে। ১৩০০ কোটি টাকা মূল্যের একটি এয়ারবাস রয়েছে। এছাড়া হাসানাল বলকিয়াহর রয়েছে এক বিশাল গাড়ির বহর। বলা হয়ে থাকে, তার বহরে সাত হাজারের মত গাড়ি আছে, যার মোট মূল্য ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার। তার গ্যারেজের সংখ্যা ১১০টি। বহরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বাহন তার সোনায় মোড়ানো রাজকীয় রোলস রয়েস সিলভার স্পার ২ মডেলের গাড়ি। বিশেষ ডিজাইনের রোলস রয়েসের ছাদ খোলা এবং পেছনে ছাতা সংযুক্ত করা। এতে চেপে তিনি নিজে যেমন শহর ভ্রমণ করেন, তেমনি রাজপরিবারের সদস্যদের বিয়ের অনুষ্ঠানের পর প্রথা অনুযায়ী প্রজাদের দর্শন দিতেও ব্যবহার হয় এই গাড়ি। এটি ছাড়াও মোট ৬০০টির মত রোলস রয়েস গাড়ির মালিক সুলতান।
ধারণা করা হয়, নব্বইয়ের দশকে বিক্রি হওয়া বিশ্বের অর্ধেক রোলস রয়েসের মালিক সুলতান এবং তার পরিবার। এছাড়া কয়েকশ’ ফেরারি গাড়ি আছে তার। এর বাইরে ল্যাম্বরগিনি, পোর্সেসহ দুর্লভ এবং লিমিটেড এডিশন গাড়িরও লোভনীয় বহর আছে সুলতানের।
এদিকে দ্যা টাইমসের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, সুলতানের চুল কাটার জন্য তার নিজের মালিকানাধীন ব্রিটেনের দ্য ডরচেষ্টার হোটেলের একজন নাপিত নিয়মিত বিমানের প্রথম শ্রেণীতে চেপে উড়ে যান ব্রুনেই। বিমান ভাড়া এবং অন্যান্য খরচ বাদে তার পারিশ্রমিক ২০ হাজার মার্কিন ডলার এবং ওই নাপিতকে প্রতিবার নগদ অর্থে পারিশ্রমিক প্রদান করা হয়। জানা গেছে, পোলো খেলার শখ রয়েছে সুলতানের। সেই কারণে ২২০টি ঘোড়াও পোষেন তিনি। ঘোড়াগুলো পরিচর্যার জন্য একাধিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আস্তাবল রয়েছে প্রাসাদ চত্বরে।
১৯৪৬ সালের ১৫ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন হাসানাল। ব্রুনেইয়ের দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার আগে নিজেদের প্রাসাদেই প্রাথমিক শিক্ষা নেন সুলতান। পরে অবশ্য উচ্চশিক্ষার জন্য মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন তিনি। এরপর যুক্তরাজ্যের রয়্যাল একাডেমী থেকে স্নাতক অর্জন করেন। ২০১২ সালের হিসাব অনুযায়ী হাসানাল বলকিয়ার তিন স্ত্রী, পাঁচ ছেলে এবং সাত মেয়ে রয়েছে। ২০২৫ সালের হিসাব অনুযায়ী তাঁর ২০ জন নাতি-নাতনিও রয়েছে। প্রতি সেকেন্ডে ব্রুনাইয়ের সুলতানের আয় ১০০ মার্কিন ডলার। তেল সম্পদ ও বিনিয়োগ থেকেই তার এ আয়। এদিকে সুলতান হিসেবে ব্রুনাইয়ে তিনি খুব জনপ্রিয়। সে দেশের কোনো নাগরিককে ট্যাক্স দিতে হয় না বলেই তার এ জনপ্রিয়তা।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের পর তিনিই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সময় ধরে রাজত্ব করা সুলতান। সুলতান গান শুনতে পছন্দ করেন। ১৯৯৬ সালে তার ৫০তম জন্মদিন উপলক্ষে ব্রুনাইয়ে মাইকেল জ্যাকসনের কনসার্ট আয়োজন করেন। এজন্য মাইকেল জ্যাকসনকে তিনি দিয়েছিলেন ১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৪ সালের ৫ অক্টোবর শাসনকালের ৫৭ বছর পূর্তি উৎসব পালন করেছেন তিনি। সূত্র: দৈনিক ইনকিলাব