বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন।। "অনেকে আমার হাতে জল খেতে চায়নি। চেনা লোকেরা ছায়া স্পর্শ করবে না বলে আমাকে দেখেই উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করেছে।"
কথাগুলো বলছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার টুম্পা দাস। তার পেশা মৃতদেহ সৎকার করা।
ওই জেলার বারুইপুরের কল্যাণপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসিন্দা তিনি। বাড়ির কাছেই পুরন্দরপুর মঠ মহাশ্মশানে মৃতদেহ সৎকারের কাজ করেন টুম্পা দাস। ২০১৪ সালে যখন এই কাজ শুরু করেন, তখন তার বয়স ১৯ বছর।
কল্যাণপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান সুরজিত পুরকায়েত বিবিসি বাংলাকে বলেন, "টুম্পা পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র নারীকর্মী যে শ্মশানে মৃতদেহ সৎকারের কাজ করে। খুব সাহসী মেয়ে। বাবার পর এই কাজে ও যোগ দিয়েছে।"
তার (টুম্পার) বাবা বাপী দাস পুরন্দরপুর মঠ মহাশ্মশানে শবদাহের কাজ করতেন। একদশক আগে মি. দাসের অকস্মাৎ মৃত্যুর পর কেউ ভাবেইনি তার মেয়েও এই একই পেশা বেছে নেবেন। কারণ ভারতীয় হিন্দু সমাজে এই পেশায় মূলত পুরুষদের দেখা যায়।
পাড়া-পড়শী এবং আত্মীয়দের অনেকেই সেই সময় সমাজে 'প্রচলিত' এই কথাগুলো মনে করিয়ে দিয়েছিলেন।
মিজ দাস বলেছেন, "সেই সময় অনেকে বলেছিল এটা মেয়েদের কাজ নয়, ছেলেদের কাজ। বাবা এ কাজ করত বলেই আমি পারব এমন ভাবা ভুল। কেউ মাকে ভয় দেখিয়েছে যে আমার বিয়ে হবে না।"
তারপরেও গত এক দশক ধরে এই কাজ করে চলেছেন তিনি।
বাবার পথে মেয়ে
শুরুর দিনগুলো সহজ ছিল না।
তিনি বলেছেন, "প্রথম প্রথম কেউ ভাবতেই পারত না যে একজন মেয়ে এই কাজটা করবে বা সবকিছু ঠিকঠাক করে করতে পারবে।"
এমনও হয়েছে, পুরন্দরপুর মহাশ্মশানে লোকবল না থাকায় টানা ২৪ ঘণ্টাই একা কাজ করেছেন, মাসের পর মাস ছুটি পাননি। রাত বিরেতে শবদাহ করতে শ্মশানে আসতে হয়েছে তাকে।
সেই দিনগুলোর কথা মনে করে তিনি বলেছেন, "প্রথম দিকে রাতে শ্মশানে যেতে হলে মা সঙ্গে আসত। এত রাতে একা ছাড়তে রাজি হতো না।"
গ্রীষ্মের তীব্র তাপপ্রবাহে ইলেক্ট্রিক চুল্লির সামনে কাজ করা সহজ নয়। তবে, তিনি যখন ওই শ্মশানে কাজ শুরু করেন, তখন ইলেকট্রিক চুল্লি ছিল না।
"লোক কম থাকলে আমি প্রথমে অফিসে রেজিস্ট্রেশনের কাজ করেছি আর তারপর চিতা সাজিয়েছি। মা দেখিয়ে দিয়েছে, ঠিক যেভাবে বাবা সাজাত," বলছিলেন তিনি।
"অথচ জানেন তো, বাবা চাননি আমি এখানে (শ্মশানে) আসি। ছেলেবেলাতে খুব কৌতূহল ছিল বাবা কী কাজ করে দেখার। একবার লুকিয়ে শ্মশানে এসে দেখেছিলাম। তখন খুব ছোট আমি। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।"
আর এখন?
"এখন বুঝেছি, ভয় পেলে বাঁচতে পারব না। লোকের কথায় কান দিলে বাঁচতে পারব না। আমার ওপর সংসার নির্ভর করছে," বলেছেন মিজ দাস।
নার্সিং থেকে দেহ সৎকারে
"যখন কাজ শুরু করি তখন আমার বয়স অল্প। বন্ধুদের দেখতাম তারা নিজেদের শখ আহ্লাদ পূরণ করছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর আমি বাড়ি থেকে শ্মশানে কাজে যেতাম আর ফিরে আসতাম। আমার কাছে উপায় ছিল না," বলছিলেন মিজ দাস।
মাধ্যমিক পাশ করার পর প্রথমে টেইলরিং এবং পরে নার্সিং ট্রেনিং নিয়েছিলেন মিজ দাস। যে সময় বাবাকে হারান, সেই সময় এক রোগীকে শুশ্রূষার কাজ করতেন। তার মাসিক উপার্জন ছিল তিন হাজার টাকা।
"বাবাকে হারানোর পর যখন আমাকে এই কাজের কথা বলা হয়, তখন তিন হাজার টাকাই মাইনে দেবে বলেছিল। ওই একই টাকা নার্সিংয়ের কাজ করেও পেতাম।"
"ভেবে দেখলাম, বাড়ির কাছে কাজ করলে যাতায়াতের খরচ, টিফিন খরচ বেঁচে যাবে। তখন ভাবতে হতো কীভাবে একটা টাকাও বাঁচাতে পারি। বাড়িতে মা, ছোট বোন আর ভাই রয়েছে… তাই রাজি হয়ে যাই।"
তিনি জানতেন পথ চলা সহজ হবে না।
মিজ দাস বলেছেন, "সত্যি বলতে কী বাবাকে হারানোর ছয়মাসের মধ্যে শ্মশানে কাজ করতে কষ্ট হতো। অন্যদের কাঁদতে দেখে খুব খারাপ লাগত। বাবাকে মিস করতাম।"
"কিন্তু তাদের সামনে শক্ত থাকতাম। একবার বাচ্চা ছেলেকে দাহ করতে এসেছিল তার পরিবারের লোকেরা। বারবার মনে হচ্ছিল আমার হাত দিয়েই হতে হচ্ছে?" কথা গুলো থেমে থেমে বলছিলেন তিনি।
"তারপরেই নিজেকে শক্ত করেছি। বুঝিয়েছি ভেঙে পড়লে চলবে না।"
"আমি আমার কাজটা নিষ্ঠা ভরে করি। স্বজনকে হারানোর কষ্টটা তো আমরা সবাই বুঝি, তাই চেষ্টা করি এখানে যারা এসেছেন তাদের যাতে কোনো সমস্যা না হয়।"
কোভিডের সময়কার অভিজ্ঞতাও জানিয়েছেন তিনি। তার কথায়, "কোভিডের সময় অনেকে ভয় পেয়েছে কাজ করতে। পাড়ার লোকজন মানা করেছেন, কিন্তু আমি শুনিনি। একটাই কথা মনে হয়েছে যে তাহলে ওরা (দেহ সৎকারের জন্য আসা পরিবার) কোথায় যাবে?"
মা পাশে ছিলেন
পুরন্দরপুর জোড়া মন্দিরের কাছেই বাস করেন টুম্পা দাস ও তার পরিবার। ঘরের দাওয়ায় বসে কথা বলছিলেন তার মা বিনতা দাস।
সমাজের 'ভ্রুকুটি' তোয়াক্কা করেননি তিনি? উত্তরে মা বিনতা দাস বলেছেন, "ওর বাবা কিন্তু বাস কন্ডাক্টারের কাজ করত। আমার বাপ- ঠাকুরদার পেশা ছিল এটা (মৃতদেহ সৎকার)। আমি একমাত্র মেয়ে।"
"তাই আমার বাবার মৃত্যুর পর যখন প্রশ্ন ওঠে কে এই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবে, তখন ওর বাবা চাকরি ছেড়ে দেন।"
প্রায় একই পরিস্থিতি তৈরি হয়, বাপী দাসের অকস্মাৎ মৃত্যুর পর। সেই সময় মা-ই সাহস যোগান টুম্পাকে।
তিনি বলেছেন, "আমাকে বারবার লোকে বলেছে যে মেয়েদের এই কাজ করতে নেই, শাস্ত্রে মানা আছে। আমি সে সব জানি না, কিন্তু আমার কখনোই মনে হয়নি মেয়েরা এই কাজ করতে পারে না।"
"আমাদের পরিবার বরাবরই এই কাজকে ভালো (মহৎ) বলে মনে করে এসেছে।"
পুরুষপ্রধান পেশা
সাধারণত এই পেশায় নারীদের দেখা যায় না বললেই চলে। ওড়িশার লক্ষ্মী জানা বা বারানসীর যমুনা দেবীর মতো ব্যতিক্রমী হাতে গোনা যারা এই কাজ করেন।
লক্ষ্মী জানার স্বামী এই কাজ করতেন। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ার পর প্রথমে স্বামীকে সাহায্য করা ও পরে একার হাতে সৎকারের কাজ শুরু করেন তিনি। যমুনা দেবী এই পেশা বেছে নেন, তার স্বামীর মৃত্যুর পর।
কিন্তু কেন এই পেশায় সাধারণত নারীদের দেখা যায় না?
মিজ দাস বলেছেন, "আসলে মেয়েদের সবেতেই মানা। কিছুতেই স্বাধীনতা নেই।"
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এর নেপথ্যে রয়েছে সমাজে প্রচলিত চিন্তাভাবনা।
সমাজতত্ত্ববিদদের মতে, মৃত্যু এবং শ্মশানকে বরাবরই 'সামাজিক দূরত্ব' বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়।
সমাজকর্মী ও অধ্যাপিকা শাশ্বতী ঘোষ বলেন, "আসলে মৃত্যু এবং শ্মশান থেকে মানুষ দূরত্ব বজায় রাখতে চেয়েছে। লোকালয় থেকে বহুদূরে শ্মশান তৈরি করা হতো।"
"নারী ও শিশুদের সেখান থেকে দূরে রাখার জন্যই হয়তো নানান কথার প্রচলন করা হয় বলে আমার ধারণা।"
ঐতিহাসিক ও পুরাণ বিশারদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী জানিয়েছেন, হিন্দু শাস্ত্রে কিন্তু নারীদের এই কাজ করতে বাধার কথা কোথাও লেখা নেই।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, "হিন্দু শাস্ত্রে কোথাও একথা বলা নেই যে মেয়েরা এই কাজ করতে পারবে না বা মেয়েদের এই পেশায় আসায় কোনো বাধা আছে।"
"বরং পিতার পেশাকে কে তার সন্তান বেছে নিয়েছে এটাতো মহৎ বিষয়। আসলে আমাদের সমাজে এই সমস্ত চিন্তা -ভাবনা প্রচলন করার পিছনে উদ্দেশ্য ছিল মেয়েদের এগোতে না দেওয়া।"
তার মতে এই জাতীয় ভাবনা 'ভ্রান্ত'।
তার মতে, "এগুলো প্রচলিত ধারণাগুলো ভ্রান্ত। পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার প্রতিফলন।"
সহকর্মীরা কী বলছেন?
এই মুহূর্তে মিজ দাসের চারজন সহকর্মী রয়েছেন। তাদেরই একজন অজিত দাস। তিনি বলেছেন, "আমরা একটা পরিবারের মতো এখানে কাজ করি। অসুবিধা হলে একে অন্যকে হেল্প করি।"
ওই শ্মশানে পুরোহিত হিসেবে যোগ দিয়েছেন রমেশ ব্যানার্জী। একজন নারীকে এই কাজ করতে দেখে বেশ আশ্চর্যই হয়েছিলেন তিনি। তার কথায়, "কাজে যোগ দিতে আসার আগে আমাকে জানানো হয়েছিল, একজন ম্যাডাম রয়েছেন এখানে।"
"প্রথমদিন তার সঙ্গে আলাপ হয়। ইতিমধ্যে দাহের জন্য কিছু মানুষ এসে পড়েন। উনি আমাকে বসিয়ে উনি আমাকে বসিয়ে রেজিস্ট্রিশন কাউন্টারে চলে গেলেন।"
এই অব্দি ছবি মেলাতে 'অসুবিধা' হয়নি তার। কিন্তু এর পরের অংশের জন্য 'প্রস্তুত' ছিলেন না তিনি।
মি. ব্যানার্জী বলেন, "রেজিস্ট্রেশন শেষ করে দেখি উনি ওপরে চলে গেলেন, চুল্লির ব্যবস্থা করতে। সত্যি বলতে কী খুব অবাক হয়েছিলাম।"
এখিন অবশ্য তিনি 'অভ্যস্ত' হয়ে পড়েছেন। তার কথায়, "এখন আমরা একটা পরিবার হয়ে গিয়েছি। ভাবতে ভালো লাগে যে উনি এই রাজ্যের একমাত্র নারীকর্মী যার এটা পেশা।"
তবে, তার সহকর্মীরা জানিয়েছেন, 'আপাত শান্ত দেখতে' এই নারী প্রয়োজনে শক্ত হতে দ্বিধা করেন না।
এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে মিজ দাস হেসে বলেন, "গভীর রাতে সমস্যায় পড়লেও আমারই ডাক পড়ে। এমন অনেক সময় হয়েছে, আমি উটকো লোক এসে ঝামেলা করেছে, মত্ত অবস্থায় গেটে ধাক্কা মেরে ভেঙে ফেলেছে।"
"তাদের সামলাতে আমাকে শক্ত হতে হয়েছে। প্রয়োজনে লাঠি হাতে ভয় দেখিয়েছি। পরিস্থিতি আসলে মানুষকে সব কিছু শিখিয়ে দেয়।"
পরিস্থিতি বদলেছে?
মিজ দাস জানিয়েছেন, পরিস্থিতি আগের থেকে বদলেছে। মিজ দাস বলেছেন, "শ্মশানে এনে অনেকে আমার খোঁজ করেন। কেউ কেউ আমাকে বাড়িতে ডাকতে চলে আসেন। দাহ হয়ে যাওয়ার পরেও অনেকে দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেন।"
তবে তার লড়াই শেষ হয়নি। তিনি বলেছেন, "আমাদের সংসারে অভাব রয়েছে। পাঁচ হাজার টাকা মাইনেতে সংসার চালানো যায় না। খুব চিন্তা হয়।"
তবে এই কাজ যে তিনি কোনো মতেই ছাড়বেন না, সেকথা জানিয়েছেন। টুম্পা দাস বলেছেন, "আমার জন্য বিয়ের সম্বন্ধ আসছে। কিন্তু সবাই চাইছে আমি এই কাজটা ছেড়ে দিই।"
"আমি রাজি হয়নি। এই কাজ আমি কিছুতেই ছাড়ব না।"