মাজহারুল ইসলাম: হাইড্রোজনের পার অক্সাইড একটি রাসায়নিক যৌগ যার সংকেত ঐ২ঙ২। বিশুদ্ধ অবস্থায় এটা বর্ণহীন তরল। বিশেষজ্ঞরা হাইড্রোজেন পার অক্সাইডকে বর্ণনা করেন অক্সিডাইজিং এজেন্ট হিসেবে। সাধারণভাবে একে বলা যায় ব্লিচিং এজেন্ট।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরাসরি হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ব্যবহার বিপজ্জনক। তাই নিরাপত্তাজনিত কারণে সবসময় এর জলীয় দ্রবণ পরিমিত পরিমাণে ব্যবহার করা হয়। এটি নিজে দাহ্য পদার্থ না হলেও আগুন বা দাহ্য পদার্থের আশেপাশে রাখলে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
আগুনের মাত্রা কীভাবে বাড়ায় এটি
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড রাসায়নিক থাকার কারণেই সীতাকুণ্ডের কন্টেইনার ডিপোতে এতো বড় বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে ধারণা করছেন বাংলাদেশে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। আগুন লাগলে নেভানোর জন্য প্রথমেই মাথায় আসে পানির কথা। কিন্তু পানি দিয়ে সব আগুন নেভানো সম্ভব হয় না। অর্থাৎ আগুন লাগলেই পানি যে সবসময় সমাধান নয়- সীতাকুণ্ডের কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের পর এটি সামনে এসেছে।
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড কোথায় ব্যবহৃত হয়
ইন্ডাস্ট্রিয়াল পর্যায়ে এর ব্যবহার বেশি। ব্লিচিংয়ের জন্য টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি, বিশেষ করে ডাইং ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহার করা হয়। লেদার এবং অ্যাভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিতেও ব্যবহৃত হয় হাইড্রোজেন পার অক্সাইড। ওয়াটার ট্রিটমেন্টসহ বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির কাজে ব্যবহৃত হয় এটি।
এছাড়া বাথরুম পরিষ্কার, কাপড় ধোয়াসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্যেও ব্যবহৃত হয় হাইড্রোজেন পার অক্সাইড। তবে নানা কাজে এর ব্যবহার হলেও সঠিকভাবে সঠিক তাপমাত্রায় এটি ব্যবহার না করলে বিপজ্জনক হতে পারে।
কতটা বিপজ্জনক হাইড্রোজেন পার অক্সাইড
হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের স্ফুটনাঙ্ক পানির তুলনায় ৫০ ডিগ্রি বেশি। সে কারণে বেশি তাপমাত্রায় এটা বিপজ্জনক হতে পারে। এর উচ্চ ঘনত্ব বেশি বিপজ্জনক।
এ রকম রাসায়নিক যেন চোখ আর ত্বকের সংস্পর্শে না আসে সেজন্য সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ এটা ত্বকের ক্ষতি করতে পারে। ত্বকে ও চোখে জ্বালাপোড়া হতে পারে। সে কারণে চোখ বা ত্বকের সংস্পর্শে আসলে তাড়াতাড়ি পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড প্রবেশ করলে মাথাব্যথা, নাক জ্বলা বা বমিও হতে পারে। অতিরিক্ত হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ফুসফুসেও সমস্যা তৈরি করতে পারে।
হাইড্রোজেন পার অক্সাইড সংরক্ষণ
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন এটা শীতল, শুষ্ক, ভালোভাবে বাতাস চলাচল করে এরকম জায়গায় সংরক্ষণ করা উচিত। বিশেষ করে ফ্লেমেবল কেমিক্যাল অর্থাৎ দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে এটা রাখা বিপজ্জনক।
দাহ্য পদার্থ থেকে দূরে এটাকে সংরক্ষণ করা উচিত। কারণ কোন দাহ্য পদার্থের কাছে থাকলে বা আগুন লাগার জায়গায় হাইড্রোজেন পার অক্সাইড থাকলে আগুন বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে যেতে পারে এবং বিস্ফোরণও ঘটতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বিস্ফোরিত হবে কিনা, তা পারিপার্শ্বিক অনেকগুলো অবস্থার উপর নির্ভর করে।
রাসায়নিক সংরক্ষণের ম্যাটারিয়াল সেইফটি ডেটশিট অনুযায়ী হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রাখতে হবে গ্লাস, স্টেইনলেস স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম অথবা প্লাসিক কনটেইনারে। অন্য কোনো ধাতুর সংস্পর্শ পেলে এটা বিক্রিয়া করে।
বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলছেন, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড যেখানে রাখা আছে তার আশেপাশে কী আছে, কতদিন ধরে কীভাবে রাখা আছে, এসব অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করছে এটা কী আচরণ করবে। তাছাড়া উচ্চ তাপে এটা বিস্ফোরক আচরণ করতে পারে। এটা দাহ্য পদার্থ না হলেও এটা অক্সিডাইজিং এজেন্ট। অর্থাৎ এটা অক্সিডাইজার হিসেবে কাজ করে। আর অক্সিডাইজারে অক্সিজেন বা ফ্লোরিন বা ক্লোরিনের মতো পদার্থ যুক্ত থাকে যা দাহ্য পদার্থের মতো আচরণ করতে পারে।
এ ধরনের আগুন নেভাতে করনীয়
এ ধরনের আগুন নেভাতে হয় অন্য কৌশলে। ফগ সিস্টেমে এ ধরনের আগুন নেভানো সম্ভব। এছাড়া ফোম বা ড্রাই পাউডার জাতীয় অগ্নি নির্বাপন যন্ত্র দিয়ে এমন আগুন নেভাতে হয়। কারণ পানির সংস্পর্শে এলেও বিস্ফোরক আচরণ করতে পারে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড। এটি যেহেতু রাসায়নিক যৌগ সেই কারণে হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের কারণে কোন আগুন লাগলে সেটি পানি দিয়ে নেভানো যায় না। এ ধরনের আগুন লাগলে তার আশেপাশে কোন অক্সিডাইজিং এজেন্ট থাকলে সেটা আগুনের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। পর্যাপ্ত তাপ ও জ্বালানি পেলেই আগুনের তীব্রতা বাড়ে এবং এই তীব্রতা বিস্ফোরণও ঘটতে পারে।
দেশে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড উৎপাদন
দেশে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড উৎপাদনকারী অন্তত ৬টি কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় উৎপাদিত পণ্য দেশে ব্যবহারের পাশাপাশি রপ্তানিও হয়। দেশে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- সামুদা কেমিক্যাল কমপ্লেক্স, তাসনিম কেমিক্যাল কমপ্লেক্স, এসএম কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, এইচপি কেমিক্যালস লিমিটেড, ইনফেনিয়া কেমিক্যাল ও আল-রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্স।
যেসব দেশে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড রপ্তানি করা হয়
মোট ১৪টি দেশে রাসায়নিকটি রপ্তানি হয়। যেসব দেশে বস্ত্র কারখানা বেশি, সেখানেই মূলত রপ্তানি করে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা।
বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড রপ্তানি করেছে ভারত, পাকিস্তান ও ভিয়েতনামে। এ ছাড়াও ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও দক্ষিণ আফ্রিকা হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড রপ্তানি করা হয়্।
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড রপ্তানি করে আয়
ইপিবির তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড রপ্তানি করে আয় হয়েছে ২০৭ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে যে পরিমাণ রপ্তানি হয়েছে, তা আগের অর্থবছরের পুরো সময়ের চেয়ে ২৩ শতাংশ বেশি। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের পুরো সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে রপ্তানি আয় হয়েছে তিন গুণ। হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড রপ্তানিতে সরকার ভর্তুকি দেয় ১০ শতাংশ। মানে হলো, ১০০ টাকা রপ্তানি করলে সরকারের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়া যায় ১০ টাকা।