উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে সীমিত আয়ের মানুষের চাপে থাকার মধ্যে করমুক্ত আয়সীমায় কিছুটা ছাড় দিয়ে করদাতাদের কিছুটা সুখবর দেওয়ার চেষ্টায় সরকার; তবে করের বোঝা বাড়ানোর প্রস্তাবও অনেকটা ‘ঠিকঠাক’ করে ফেলেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
রাজস্ব আদায়কারী সংস্থাটির নীতি নির্ধারক পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলেন, আসছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে বর্তমানে থাকা ব্যক্তিশ্রেণির সাধারণ করদাতাদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা ২৫ হাজার টাকা বাড়িয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার করার প্রস্তাব চূড়ান্ত করতে তারা সরকারের সায় পেয়েছেন।
একই সঙ্গে সর্বনিম্ন করহার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে এক লাফে ১০ শতাংশ করা হচ্ছে। নীতি নির্ধারকদের সবুজ সংকেতের পর এনবিআরের তরফে এ প্রস্তাবও ঠিক করে এখন সরকারের বিবেচনার জন্য বাজেট প্রস্তাবে রাখা হচ্ছে, যোগ করেন এনবিআরের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা।
এমন খবরে করদাতারা বলছেন, এতে মধ্যম আয়ের মানুষের ওপর করের চাপ আরও বাড়বে।
এনবিআর প্রস্তাবিত বাজেট আয়করে এ দুই পরিবর্তনের পাশাপাশি নতুন আয়কর দাতাদের উৎসাহিত করতে তাদের কিছুটা ছাড় দেওয়ার পথে হাঁটছে। আয়মুক্ত সীমা পার হলে নতুন কোনো করদাতা সর্বনিম্ন ১ হাজার টাকাও আয়কর দিতে পারবেন বলে প্রস্তাব করা হচ্ছে।
আয়কর সীমা ২৫ হাজার টাকা বাড়ানোর সঙ্গে করহারে বড় লাফের প্রস্তাবে অবশ্য খুশি হচ্ছেন না বেসরকারি একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা নূর-ই আলম নিশান।
তিনি বলেন, "২৫ হাজার টাকা করমুক্ত সীমা বাড়িয়ে করের হার বাড়িয়ে দিলে কী লাভ হল? এটা তো 'অযৌক্তিক' আমাদের মত নিম্ন মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য।
"এ বছর ৬-৭ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট পেলে আমি করের মধ্যে ঢুকে যাব। এখন আমার ইনক্রিমেন্ট থেকে কর বাড়লে তো আমাদের জন্য বোঝা হয়ে যাবে, বড় বোঝায়।"
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন অবশ্য এ প্রস্তাবকে বর্তমানে কাঠামোর তুলনায় ‘তুলানামূলক ভালো’ মনে করছেন।
তার ভাষ্য, "বর্তমানে যেটা তার থেকে অব্যাহতির সীমা বাড়িয়ে পরবর্তী স্লাবে ট্যাক্স বাড়ানোটা বর্তমানের চেয়ে বেটার মনে হচ্ছে।"
যুক্তি হিসেবে অব্যাহতির জন্য যে রাজস্ব আদায় কম হবে তা তো কোথাও না কোথাও প্রত্যক্ষ কর বাড়িয়েই পোষাতে হবে, যোগ করেন তিনি।
সেক্ষেত্রে নিচের দিকে কর না কমিয়ে ওপরের আয়ের ক্ষেত্রে করের বোঝা বাড়ানো যেত কি না এমন প্রশ্নের জবাবে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, "সেটা তো যেতই। তবে কোথাও না কোথাও তো লাইন ড্র করতেই হতো। এবং এ কাঠামোতেও বেশি আয়ের মানুষের ওপরই করের বোঝা বেশি হবে। কারণ তাকেও এই স্লাবের আয়ের ওপর বেশি কর দিতে হবে।"
কী পরিবর্তন আসছে?
বর্তমানে ব্যক্তিশ্রেণির সাধারণ করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা। এরপরের এক লাখ টাকা আয়ের জন্য কর দিতে হয় ৫ শতাংশ হারে; অর্থ্যাৎ সাড়ে তিন লাখ টাকা থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ওপর করের হার রয়েছে ৫ শতাংশ।
নতুন কর কাঠামো অনুযায়ী, ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করমুক্ত আয়সীমা করে পরের ধাপেই কর হার করা হচ্ছে ১০ শতাংশ করে। এতে এখন যে ব্যক্তির আয় বছরে সাড়ে ৪ লাখ টাকা তাকে ৭৫ হাজার টাকার জন্য কর দিতে হবে ১০ শতাংশ।
এতে মধ্যম আয়ের মানুষের ওপর করের বোঝা কীভাবে বাড়বে তা একটি হিসাব দিয়ে বোঝানো যেতে পারে।
কোনো ব্যক্তি যদি বার্ষিক আয় করে থাকেন ৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। তাহলে এর মধ্যে তিন ভাগের এক ভাগ আয়ের ওপর কোন করই দিতে হবে না। বাকি সাড়ে ৪ লাখ টাকার ওপর তাকে আয়কর দিতে হবে।
বর্তমান কাঠামো অনুযায়ী তাকে সাড়ে তিন লাখের পরের ১ লাখের জন্য কর দিতে হবে ৫ শতাংশ হারে ৫ হাজার টাকা।
কিন্তু নতুন প্রস্তাব বাজেটে পাস হলে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকার পরবর্তী ৭৫ হাজার টাকার জন্য আয়কর দিতে হবে ১০ শতাংশ হারে ৭ হাজার ৫০০ টাকা। অর্থ্যাৎ আয়কর বাড়ল আড়াই হাজার টাকা।
সাধারণত মধ্যম আয়ের মানুষেরই এই ধরনের বার্ষিক আয় থাকে।
এছাড়া উচ্চ আয়ের মানুষের ওপরও করের বোঝা বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত করার কথা বাজেটের আলোচনার টেবিলে রয়েছে।
বর্তমানে কী আছে, নতুন কী হচ্ছে?
বর্তমান কর কাঠামো অনুযায়ী, ব্যক্তিশ্রেণির সাধারণ করদাতার করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
নারী করদাতাদের এই সীমা ৪ লাখ, প্রতিবন্ধীদের ৪ লাখ ৭৫ হাজার এবং গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ৫ লাখ টাকা।
আয়করের বর্তমান স্ল্যাব অনুযায়ী, সাড়ে ৩ লাখ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকার মধ্যে বার্ষিক আয় থাকলে করদাতাদের ৫ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হয়। পরবর্তী ৪ লাখ টাকার (মোট আয় সাড়ে ৮ লাখ টাকা) ওপর ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লাখের (মোট আয় সাড়ে ১৩ লাখ টাকা) ওপর ১৫ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লাখের (মোট আয় সাড়ে ১৮ লাখ টাকা) ওপর ২০ শতাংশ, অবশিষ্ট আয়ের ওপর ২৫ শতাংশ হারে আয়কর নির্ধারণ করা আছে।
প্রস্তাবিত কাঠামো অনুযায়ী করমুক্ত আয়ের সীমা দাঁড়াতে পারে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। প্রথম স্তরে এর পরের ৩ লাখ ১০ হাজার টাকা আয়ের জন্য (মোট আয় ৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা পর্যন্ত) ১০ শতাংশ হারে কর, তার পরের ৪ লাখ টাকার ওপর (মোট ১০ লাখ ৮৫ হাজার টাকা পর্যন্ত) ১৫ শতাংশ হারে কর, পরবর্তী ৫ লাখ টাকার ওপর (মোট ১৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা পর্যন্ত) ২০ শতাংশ হারে কর, তার পরের ২০ লাখ টাকার ওপর (মোট ৩৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা পর্যন্ত) ২৫ শতাংশ হারে কর এবং এর ওপরে থাকা আয়ের জন্য ৩০ শতাংশ হারে কর নির্ধারণের আলোচনা রয়েছে।
সুখবর আসছে নতুনদের জন্য : তবে নতুন আয়কর দাতাদের জন্য এক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় আছে। আয়করমুক্ত সীমা পার হলে তিনি সর্বনিম্ন ১ হাজার টাকাও আয়কর দিতে পারবেন। তাদের করের আওতায় আনতে এ সিদ্ধান্তের কথা ভাবছে সরকার।
বর্তমান আইন অনুযায়ী আয়মুক্ত সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা পার হলে পরের এক লাখ টাকার মধ্যে তার আয় যাইই হোক তার জন্য এলাকাভেদে ৩ হাজার টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা সর্বনিম্ন আয়কর দিতে হত।
হিসেবটা হওয়ার কথা রয়েছে এভাবে। বর্তমানে সাড়ে তিন লাখের ওপর সাড়ে ৪ লাখের মধ্যে আয় যাই হোক না কেন তাকে ঢাকার করদাতা হলে দিতে হত ৫ হাজার টাকা।
নতুন কাঠামোয়, কেউ যদি ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা আয় করে তাহলে তার করমুক্ত আয়সীমার পরের ৫ হাজার টাকা আয়ের ওপর ১০ শতাংশ হারে কর ৫০০ হলেও দিতে হবে ১ হাজার টাকা। ৩ লাখ ৮৫ হাজার ছাড়ালে বাড়তি টাকার ওপর ১০ শতাংশ হারে তারা কর দিতে পারবে।