দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনকে কোনও আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গভীর রাতে সিলেট সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করানো হয়। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, তাকে ভারতে অবস্থানকালীন সময়েই ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (র) ও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। এই সম্পর্কের ফলেই তাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে র-এর হয়ে বিশেষ রাজনৈতিক ‘কিলিং মিশন’-এ কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করা হয়।
সুব্রত বাইন ভারতের কলকাতা প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি থাকলেও বন্দি বিনিময় চুক্তি ছাড়াই বিশেষ ব্যবস্থায় তাকে বাংলাদেশে আনা হয়। দিল্লিতে নিযুক্ত র-এর অপারেশন প্রধানের সঙ্গে সমন্বয় করে এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক জিয়াউল হাসানের নেতৃত্বে এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হয়। তৎকালীন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ অনুমোদনেই এ উদ্যোগ নেয়া হয় বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, তাকে কলকাতা থেকে আনার সময় ভারতীয় এসটিএফ (স্পেশাল টাস্ক ফোর্স) তাকে বিশেষ ব্যবস্থায় সিলেটের জয়ন্তাপুর সীমান্তে হস্তান্তর করে। এরপর তাকে র্যাব সদর দফতরে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, এনটিএমসির মহাপরিচালক জিয়াউল হাসান এবং পুলিশের সাবেক ডিআইজি মনিরুল ইসলাম তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাকে আশ্বাস দেওয়া হয়, নির্ধারিত কাজে সহযোগিতা করলে ‘ক্রসফায়ার’ থেকে রেহাই দেওয়া হবে।
তাকে উত্তরা এলাকায় একটি বাড়িতে গোপনে রাখা হয় এবং ভারতীয় ও পাকিস্তানি স্নাইপার প্রশিক্ষণের আদলে উন্নত অস্ত্র, স্নাইপিং টেকনিক, বাতাসের গতি, আর্দ্রতা ও দূরত্ব নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয়ে নিবিড় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, সুব্রত বাইনকে পাকিস্তানি পাসপোর্টে লন্ডনে পাঠিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। টার্গেট ছিল তারেক রহমানের জুমার নামাজে যাতায়াতের সময়। এই পরিকল্পনায় লন্ডনে নিযুক্ত তৎকালীন হাই কমিশনার সাঈদা মুনা তাসনিম সহযোগিতা করবেন বলেও জানানো হয়। মিশন সফল হলে সুব্রত ও তার পরিবারকে কানাডায় পাঠানো হতো ভারতীয় পাসপোর্টে।
কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। পরবর্তীতে জিয়াউল হাসানের নির্দেশে সুব্রত বাইনকে তার মেয়ে বিতুর কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, ২০২২ সালে তার ‘নিখোঁজের’ পর মায়ের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান সুব্রতর মা কমলিনী বাইন।
উল্লেখ্য, সুব্রত বাইন বরিশালের উজিরপুরের সাবেক সংসদ সদস্য হরনাথ বাইনের ছেলে। এই সপ্তাহের শুরুতে কুষ্টিয়া শহরের একটি বাসা থেকে যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়ে সুব্রত বাইন ও তার এক সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে। বর্তমানে তিনি আট দিনের রিমান্ডে রয়েছেন।
রিমান্ডে সুব্রত বাইন স্বীকার করেছেন, তাকে একটি টার্গেট কিলিং স্কোয়াড গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নেতাদের হত্যার মাধ্যমে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা। এ মিশনের পেছনে ছিলেন আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ ঘোষিত শীর্ষ পর্যায়ের কিছু নেতা। মোল্লা মাসুদ নামে এক ব্যক্তি তার লজিস্টিক সহায়তায় ছিলেন। প্রতিবেশী দেশ থেকে ‘কুন্ডির মাধ্যমে’ অর্থ এনে অস্ত্র কেনা এবং শুটার নিয়োগের কাজ চলত।
তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, অস্ত্রগুলো সীমান্ত দিয়ে এনে ঢাকার মগবাজার, শাহবাগ, গুলশান ও বাড্ডার সন্ত্রাসীদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। এছাড়া টার্গেট কিলিং শেষে বিভ্রান্তিকর প্রচার চালিয়ে রাজনৈতিক বিভাজনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে সুবিধাজনক অবস্থানে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল বলেও সুব্রত স্বীকার করেছেন।
এই ঘটনায় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে বিষয়টি গভীরভাবে তদন্ত করা হচ্ছে। উৎস: আমার দেশ।
