ঢাকার অপরাধ জগতের কুখ্যাত শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনকে গ্রেফতার করেছে সেনাবাহিনী। তার সঙ্গে থাকা সহযোগী মোল্লা মাসুদকেও একই অভিযানে আটক করা হয়েছে। মঙ্গলবার কুষ্টিয়া শহরের কালীশংকরপুর এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
দেশের অপরাধ জগৎ দীর্ঘদিন ধরে একাধিক শীর্ষ সন্ত্রাসীর দখলে ছিল, যাদের প্রভাব রাজধানীর রাজপথ থেকে শুরু করে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পর্যন্ত বিস্তৃত। এই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সুব্রত বাইন, যিনি কথিত সেভেন স্টার বাহিনীর প্রধান হিসেবেও পরিচিত।
পুলিশের খাতায় তার পুরো নাম—ত্রিমাত্রী সুব্রত বাইন। বহুদিন ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে দাপট দেখিয়ে তিনি ভারতের কারাগারেও বন্দী ছিলেন। তার আদিনিবাস বরিশালের আঘোলজড়া থানার জোবারপড় গ্রামে। বাবা বিপুল বাইন ছিলেন একটি এনজিও-র গাড়িচালক। মা ও তিন বোনকে নিয়ে ঢাকার মগবাজারের একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন তারা।
সুব্রত বাইনের জন্ম ১৯৬৭ সালে ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। প্রাথমিক শিক্ষা নেন বরিশালের অক্সফোর্ড মিশন নামক একটি খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। এরপর নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন ঢাকার শেরেবাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং সেখান থেকে এসএসসি পাস করেন। সিদ্ধেশ্বরী কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় এক ছাত্রনেতার সঙ্গে পরিচয়ের পর বইয়ের পরিবর্তে হাতে ওঠে অস্ত্র।
খুব অল্প সময়ের মধ্যে মগবাজারে নিজস্ব সন্ত্রাসী চক্র গড়ে তোলেন তিনি। ১৯৯৩ সালে মধুবাজারে এক সবজি ব্যবসায়ীকে খুন করার মধ্য দিয়ে তার নাম পুলিশের তালিকায় উঠে আসে। এরপর মগবাজারের বিশাল সেন্টার নির্মাণকালে চাঁদাবাজি নিয়ে গোলাগুলিতে তার নাম গণমাধ্যমে আসে। পরবর্তীতে সেই সেন্টারের দোকান মালিক সমিতির নেতা হন সুব্রত, সেখান থেকেই শুরু হয় আরেক দফা চাঁদাবাজির অধ্যায়।
১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠেন তিনি। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এমনকি একবার মগবাজারের মধুবাগ মাঠে তার জন্মদিন উপলক্ষে উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে সরকারদলীয় নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। সেই রাতেই সুব্রত বাইন হয়ে ওঠেন মিডিয়ার তারকা সন্ত্রাসী।
এক পর্যায়ে যুবলীগ নেতা লিয়াকতের কবল থেকে মগবাজারের নিয়ন্ত্রণ নেন তিনি। ১৯৯৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ট্রিপল মার্ডারের নেতৃত্ব দেন। এছাড়া রফিক, সিদ্ধেশ্বরীর খোকনসহ আরও কয়েকজন খুন হন তার হাতে। তখন রমনা, মগবাজার, কাওরান বাজার ও মধুবাগ এলাকায় প্রতিদিনের ঘটনা ছিল গোলাগুলি। রাজধানীর দক্ষিণাংশে তার বাহিনীর একচ্ছত্র দাপট প্রতিষ্ঠিত হয়।
সেই সময়ে তার বিরুদ্ধে কমপক্ষে ৩০টি মামলা ছিল। ১৯৯৭ সালে নয়াপল্টনের একটি হাসপাতাল থেকে গোয়েন্দা পুলিশের এসি আকরাম হোসেন তাকে গ্রেফতার করেন। দীর্ঘদিন কারাভোগের পর জামিনে মুক্ত হন সুব্রত। তবে কারাগারে থাকা অবস্থায় তার স্ত্রী প্রেমে পড়েন গ্রুপেরই এক সদস্যের। এই ঘটনা জানতে পেরে সুব্রত নিজেই স্ত্রীকে সেই যুবকের সঙ্গে বিয়ে দেন।
পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে বিউটি নামে এক নারীকে বিয়ে করলেও কয়েক বছরের মধ্যেই ডিভোর্স দেন। এরপর বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এলে ২০০১ সালের ২৫ ডিসেম্বর ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা প্রকাশ করে সরকার, এবং পুরস্কার ঘোষণা করা হয় তাদের ধরিয়ে দিলে। সেই তালিকায় প্রথম নামটি ছিল সুব্রত বাইনের।
তার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি হয়। এরপর ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় আশ্রয় নেন তিনি। সেখানে নদীয়া জেলার ঝামেলা নামের এক নারীকে বিয়ে করেন। জমি কিনে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং অপরাধী কার্যক্রমও অব্যাহত রাখেন।
২০০৮ সালের ১১ অক্টোবর অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে কলকাতা পুলিশ তাকে আটক করে। পরে জামিনে মুক্ত হয়ে দুবাই চলে যান। সেখান থেকে ফেরত এসে এক চিত্রনায়িকার কাছ থেকে চাঁদা দাবি করলে কলকাতা পুলিশের টাস্ক ফোর্সের ধাওয়ায় নেপালের সীমান্ত শহর কাকরভিটেতে পালিয়ে যান। সেখানেই নেপালি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। প্রথমে ভাদ্রপুর এবং পরে যমুকা কারাগারে পাঠানো হয় তাকে।
২০১২ সালের ৮ নভেম্বর সেই কারাগারে ৭৭ ফুট দীর্ঘ সুরঙ্গ কেটে পালিয়ে যান সুব্রত। পালিয়ে কয়েকদিন পর কলকাতার বউবাজার এলাকা থেকে ফের গ্রেফতার হন। এরপর থেকে তিনি সেখানকার জেলেই ছিলেন।
কলকাতায় বসেই ঢাকার অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করতেন সুব্রত বাইন। সড়ক ও জনপথ বিভাগের বড় ঠিকাদারি কাজ ভাগাভাগি করতেন। সেই চাঁদার টাকায় নদীয়ায় ৫০ বিঘা জমি ও একটি বাগানবাড়ি কেনেন। ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কলকাতার ব্যবসায়ীদের পাওনা টাকা আদায়ও করতেন সুব্রতর লোকজন।
বর্তমানে সুব্রত বাইনের পরিবার গাজীপুরের মোবাইল হারবাই ছায়াপাড়ায় বসবাস করছে। সেখানে তারা পাঁচখানা জমি কিনে বাড়ি নির্মাণ করেছেন। বাবা বিপুল বাইন ও মা কুমুলিনী বাইন এখন সেখানেই বসবাস করেন।