চট্টগ্রাম নগরের কালুরঘাট এলাকার বালু ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইউনুসের কাছে গত ২৩ জুলাই হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে ফোন করে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন ‘সন্ত্রাসী’ সাজ্জাদ আলী। অপরাধজগতে তিনি বড় সাজ্জাদ হিসেবে পরিচিত। বিদেশে বসেই চট্টগ্রামের এই ব্যবসায়ীর কাছে ফোনে চাঁদা দাবি করেন তিনি। তবে সাজ্জাদের কথামতো টাকা দিতে পারেননি ওই ব্যবসায়ী। সূত্র: প্রথম আলো
গত ১ আগস্ট রাত সাড়ে ১০টার দিকে নগরের চান্দগাঁও মোহরা এলাকায় মোহাম্মদ ইউনুসের বাসায় হানা দেন একদল অস্ত্রধারী। অস্ত্রধারীদের একজন বলতে থাকেন, ‘সাজ্জাদ ভাইয়ের কথা ভালো লাগে নাই, এবার কবরে যা।’ এ কথার পরই শুরু হয় গুলিবর্ষণ। ব্যবসায়ীর হাঁটু, কোমর, পাসহ শরীরের চারটি স্থানে গুলি লাগে। তবে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি। এ ঘটনার পর ওই ব্যবসায়ী বলেন, ‘যেভাবে এলোপাতাড়ি গুলি করা হয়, ভাবিনি বাঁচব। এখনো বেঁচে আছি বলে মনে হয় না। সাজ্জাদ বিদেশে বসে দেশে এসব করার সাহস কীভাবে পায়। তার সহযোগীরা এত অস্ত্র কোথা থেকে পায়।’
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসের শিকার লোকজন জানান, বিদেশে বসে চট্টগ্রামের অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করছেন সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলী ওরফে বড় সাজ্জাদ। চাঁদা না পেলেই গুলি ছুড়ছেন তাঁর অনুসারীরা। নগরের চান্দগাঁও, বায়েজিদ বোস্তামী ও পাঁচলাইশ এবং জেলার হাটহাজারী, রাউজানসহ পাঁচ থানার পাঁচ লাখের বেশি মানুষকে সাজ্জাদের বাহিনীর কারণে আতঙ্কে থাকতে হয়।
বড় সজ্জাদের অপরাধনামা
শিবির ক্যাডার হিসেবে পরিচিত সাজ্জাদ আলী বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছেন। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আবার বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। তাঁর অন্যতম সহযোগী সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদের মাধ্যমে ৫০ জনের বাহিনী দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছেন অপরাধজগৎ। ১৫ মার্চ ছোট সাজ্জাদ কারাগারে গেলেও থেমে নেই সন্ত্রাসী তৎপরতা।
বড় সাজ্জাদের বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র ও চাঁদাবাজিসহ এক ডজন মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। ২০১২ সালের ১৪ এপ্রিল তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য ইন্টারপোলে বার্তা পাঠায় বাংলাদেশ পুলিশ। তাঁকে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ হিসেবে রেড নোটিশ জারি করে ইন্টারপোল। ওই বছরের ৭ নভেম্বর ভারতের পাঞ্জাবের অমৃতসর থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে সাজ্জাদকে ফেরাতে দফায় দফায় চেষ্টা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ২০১৭ সালে তাঁর বিরুদ্ধে থাকা মামলার নথিও পাঠানো হয় ভারতে। তবে তাঁকে ফেরাতে ব্যর্থ হয় সরকার। এর মধ্যে কয়েক বছর জেল খেটে দিল্লির তিহার কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে এখন তিনি ভারতেই অবস্থান করছেন বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র। কয়েক দফা চিঠি চালাচালি করেও এই সন্ত্রাসীকে ফেরাতে পারেনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাঁর অবস্থান এখন কোথায়, তা–ও জানে না চট্টগ্রামের পুলিশ।
জানতে চাইলে সদ্য বদলি হওয়া নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) মাহমুদা বেগম বলেন, সাজ্জাদকে দেশে ফিরিয়ে আনতে নগর পুলিশের পক্ষ থেকে ইন্টারপোলকে চিঠিসহ যা যা দরকার সব করা হচ্ছে।
তবে পুলিশের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে সাজ্জাদের অনুসারীরা তাঁর নির্দেশে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ইটভাটা ও আবাসন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের মালিক জাহাঙ্গীর আলম সন্ত্রাসী ঘটনার শিকার হন। এই ব্যবসায়ীর কাছে ১৫ দিন আগে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। কিন্তু টাকা না দেওয়ায় গত ২০ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে তাঁর বাড়ি লক্ষ্য করে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা গুলি করে। পরে মুঠোফোনে ব্যবসায়ীকে বলা হয়, এবার বাড়িতে গুলি করেছেন তাঁরা। এরপর তাঁদের শেষ করে দেওয়া হবে।
জানতে চাইলে অতিরিক্ত চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার কাজী মো. তারেক আজিজ বলেন, ঘটনায় জড়িত সাজ্জাদের সহযোগীদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
যেভাবে উত্থান বড় সাজ্জাদের
নগরের বায়েজিদ বোস্তামীর চালিতাতলী এলাকার আবদুল গণি কন্ট্রাক্টরের ছেলে সাজ্জাদ আলী। ১৯৯৯ সালের ২ জুন পাঁচলাইশ ওয়ার্ড তৎকালীন কাউন্সিলর লিয়াকত আলী খান বাড়ির সামনে খুন হন। লিয়াকত হত্যায় সাজ্জাদ জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ থাকলেও কেউ আদালতে সাক্ষ্য না দেওয়ায় ওই হত্যা মামলা থেকে তিনি খালাস পেয়ে যান। লিয়াকত হত্যার পর অপরাধজগতে সাজ্জাদের নাম ছড়িয়ে পড়ে।
২০০০ সালের ১২ জুলাই। মাইক্রোবাসে করে একটি দলীয় সমাবেশে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন ছাত্রলীগের ছয় নেতা-কর্মী। পথে বহদ্দারহাটে ওই মাইক্রোবাস থামিয়ে ব্রাশফায়ার করে সন্ত্রাসীরা। ঘটনাস্থলেই ওই ছয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীসহ আটজন মারা যারা যান। ‘এইট মার্ডার’ নামে পরিচিত আলোচিত ওই হত্যাকাণ্ডে সাজ্জাদ নেতৃত্ব দেন বলে অভিযোগ ওঠে। সর্বশেষ ২০০০ সালের ১ অক্টোবর একে-৪৭ রাইফেলসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ২০০৪ সালে জামিনে বেরিয়ে বিদেশে পালিয়ে যান।
শুরুতে নুরনবী ম্যাক্সন, সরোয়ার হোসেন, আকবর আলী ও ছোট সাজ্জাদকে নিয়ে দল গড়েন বড় সাজ্জাদ। তাঁদের হাতেই ছিল অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ। ম্যাক্সন ভারতে মারা যান। সরোয়ার দল ছেড়ে দেন। এরপর ছোট সাজ্জাদ দলের হাল ধরেন ২০১৫ সাল থেকে।
বড় সাজ্জাদের বাহিনীর নেতৃত্বে যাঁরা
পুলিশ জানায়, বড় সাজ্জাদের বাহিনীতে অন্তত ২৫ জন সক্রিয় রয়েছেন। মূল নেতৃত্বে রয়েছেন ১৭ মামলার আসামি বর্তমানে কারাগারে থাকা ছোট সাজ্জাদ। তিনি কারাগারে যাওয়ার পর ১৩ মামলার আসামি রায়হান নেতৃত্বে আসেন। এ ছাড়া এই দলে সক্রিয় আছেন মো. খোরশেদ, মোহাম্মদ, মোবারক হোসেন ওরফে ইমন, মোহাম্মদ ওরফে ভাতিজা মোহাম্মদ, ববি আলম, মো. কামাল, মো. হাসান, নুরুল হক, মোহাম্মদ বোরহান, মো. মবিন, মোবারক, মো. কাদের, মো. তপু, মো. আজম, মনির, তুষার, তুহিন, সোহেল, ছালেক, এরশাদ, ওসমান আলী ও মো. আলভীন। তাঁরা সবাই অস্ত্র চালনায় বিশেষ পারদর্শী। তাঁদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও অস্ত্রের মামলা রয়েছে। বিদেশ থেকে মুঠোফোনে তাঁদের নির্দেশনা দিয়ে আসছেন বড় সাজ্জাদ।
বড় সাজ্জাদের অনুসারী ছোট সাজ্জাদও তাঁর নানা অপরাধের কারণে আলোচনায় এসেছেন। গত বছরের ২৯ আগস্ট এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চোট সাজ্জাদ তাঁর প্রতিপক্ষ মো. আনিস ও কায়সারকে বায়েজিদ বোস্তামী থানার অনন্যা আবাসিক এলাকায় গুলি করে খুন করে পালিয়ে যান। এ ঘটনায় করা পৃথক দুই মামলায় সাজ্জাদ ও তাঁর সহযোগীদের আসামি করা হয়েছে। একই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর চান্দগাঁওয়ে ইট-বালুর ব্যবসায়ী মো. তাহসীনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
ছোট সাজ্জাদকে ধরিয়ে দেওয়ায় ঢাকাইয়া আকবরকে গুলি করে খুন করা হয় বলে প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে। ৩০ মার্চ বাকলিয়া এক্সেস রোডে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় একটি প্রাইভেট কার। সাজ্জাদের প্রতিপক্ষ সরোয়ারকে গুলি করতে গিয়ে গাড়িতে থাকা দুজন মারা যান। ১১ এপ্রিল রাউজানে যুবদল কর্মী ইব্রাহিম হত্যাসহ পাঁচটি খুনে সাজ্জাদের সহযোগীদের নাম উঠে এসেছে।