মহসিন কবির: নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ নিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। রাজনৈতিক দলগুলো চাচ্ছে ডিসেম্বরে নির্বাচন আর সরকার নির্বাচন দিতে চাচ্ছে আগামী বছরের জুন মাসে। এটা নিয়ে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো নাখোশ। রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়ার সঙ্গে একমত হয়েছেন সেনাপ্রধান। এ প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
এনসিপির নেতারা বলছেন, জুলাই অভ্যুত্থানকে বেহাত করতে একটি পক্ষ খুবই সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে সরকারের জুলাই সনদ ঘোষণার পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে দেশি ও বিদেশি চক্র কাজ করছে। উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করে অবশ্যই প্রকাশ করতে হবে। অভ্যুত্থানের অন্যতম স্বীকৃতি এই ঘোষণাপত্র। এনসিপি এর সঙ্গে কোনো ধরনের কম্প্রোমাইজ করবে না। প্রয়োজনে বৃহত্তর ঐক্য নিয়ে ফের আন্দোলনে নামবে দলটি।
এদিকে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নে যত বড় বাধাই আসুক, তা মোকাবিলা করা হবে। কারণ আমাদের রাজনীতি ও অস্তিত্ব হচ্ছে এই জুলাই গণঅভ্যুত্থান। তা যত বেশি ধারণ করব, আমরা তত বেশি এগিয়ে যেতে পারব। দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা চলছে। এর ফাঁদে পা না দিয়ে আমরা বরং ঐক্যবদ্ধ থাকব।
জাতীয় নাগরিক পার্টির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমরা স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কথা আগেই জানিয়েছিলাম। অবৈধ নির্বাচনের বৈধতা দেওয়ার চেয়ে নির্বাচন হলে দেশ ও জনগণ উপকৃত হতো। নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে স্থানীয় সরকার শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারত।
তিনি বলেন, কয়েকটি এজেন্ডা নিয়ে আমরা কাজ করছি এবং কর্মসূচি পালন করছি। এরমধ্যে আছে মৌলিক সংস্কার। সকল দলের সঙ্গে ঐক্যের ভিত্তিতে আমরা মৌলিক সংস্কারগুলো করার জন্য কাজ করব। এ ছাড়া নতুন সংবিধানের জন্য গণপরিষদ নির্বাচন, জুলাই সনদ এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন। এসব দাবিতে আমরা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করব।
এদিকে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে এনসিপির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। তার মতে, নির্বাচন হলে জনগণ গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে উপকৃত হবে। বর্তমানে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের অফিসগুলোতে জনপ্রতিনিধির অভাবে যে সেবাগুলো ব্যাহত হচ্ছে, তা আবার স্বাভাবিক হবে। এর মাধ্যমে নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা যাচাই করা সম্ভব হবে।
এছাড়া নির্বাচন কমিশনের (ইসি) গণবিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আগামী ২২ জুনের মধ্যেই নিবন্ধনের আবেদন করতে চায় এনসিপি। এ লক্ষ্যে কাজ করছে দলটির একটি টিম। এই সময়ের মধ্যে শর্ত পূরণের চেষ্টা আছে তাদের। ইসিতে নিবন্ধিত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক দলীয় কার্যালয় স্থাপনসহ আনুষঙ্গিক কাজের প্রস্তুতি চলছে বলে জানান তারা।
রাজনীতিবিদরা বিশ্লেষকরা বলছেন, চলমান পরিস্থিতিতে সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে। সব রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা এবং উপদেষ্টা পরিষদকে সংযতভাবে কথা বলতে হবে। সেই সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে যেন সমাধান বের হয়, সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। অতিদ্রুত সর্বদলীয় সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচনের সুস্পষ্ট দিনক্ষণ তথা রোডম্যাপ ঘোষণা করার দাবি জানান রাজনীতিবিদরা।
এদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে একেবারেই বসে নেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। উপদেষ্টা পরিষদের একাধিক বৈঠকে দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তর আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। সর্বশেষ গতকাল শনিবারও উপদেষ্টা পরিষদের অনির্ধারিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, দেশকে স্থিতিশীল রাখতে নির্বাচন, বিচার ও সংস্কার কাজ এগিয়ে নিতে এবং চিরতরে এ দেশে স্বৈরাচারের আগমন প্রতিহত করতে বৃহত্তর ঐক্য প্রয়োজন বলে মনে করে উপদেষ্টা পরিষদ। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য শুনবে এবং সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করবে।
আরও বলা হয়, শত বাধার মধ্যেও গোষ্ঠীস্বার্থকে উপেক্ষা করে অন্তর্বর্তী সরকার তার ওপর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। যদি পরাজিত শক্তির ইন্ধনে এবং বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সরকারের ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালনকে অসম্ভব করে তোলা হয়, তবে সরকার সব কারণ জনসমক্ষে উত্থাপন করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জুলাই অভ্যুত্থানের জনপ্রত্যাশাকে ধারণ করে। কিন্তু সরকারের স্বকীয়তা, সংস্কার উদ্যোগ, বিচার প্রক্রিয়া, সুষ্ঠু নির্বাচন ও স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে—এমন কর্মকাণ্ড অর্পিত দায়িত্ব পালন করাকে অসম্ভব করে তুললে সরকার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেছেন, দেশের যে পরিস্থিতি, তা অবশ্যই উদ্বেগের। আজকের এই সময়ে এসে ড. ইউনূস যদি পদত্যাগ করেন, সেটা জাতীয় বিপর্যয়ের কারণ হবে। তিনি সত্যিই চলে গেলে তার জায়গাটা কীভাবে পূরণ হবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। অনেকে মনে করছেন, সামরিক শাসন বা সে ধরনের কিছু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জায়গাটা পূরণ করা হবে। তবে সেটা হলে তা গণতন্ত্র ও দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। এমনকি সামরিক বাহিনীর জন্যও মঙ্গলজনক হবে না। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর হিসাব করা উচিত।
চলমান পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সৃষ্ট বিভাজনের কথা তুলে ধরে মাহবুব উল্লাহ বলেন, আধিপত্যবাদ প্রত্যাবর্তনেরই একটি রাস্তা করে দিচ্ছে। এবার আধিপত্যবাদের প্রত্যাবর্তন ঘটলে বাংলাদেশের জন্য কবর রচনার ঘটনা ঘটবে। এটা খুবই ভয়াবহ ব্যাপার হবে। ১৯৬৫-৬৬ সালে ইন্দোনেশিয়ায় যে ১০ লাখ লোককে হত্যা করা হয়েছিল, বাংলাদেশেও সে রকম একটা রক্তের বন্যা বয়ে যেতে পারে। দেশে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।