শিরোনাম
◈ পারস্পরিক শুল্ক সংকট: চূড়ান্ত দর-কষাকষিতে বাংলাদেশ ◈ আরব আমিরাতের আবুধাবিতে প্রবাসী বাংলাদেশির ভাগ্যবদল: লটারিতে জিতলেন ৮০ কোটি টাকা ◈ ২৪ ঘণ্টায় গাজায় নিহত ১১৮, যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পর্যালোচনায় হামাস ◈ ‘মব এবং জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হলে কঠোর পদক্ষেপ নেবে সেনাবাহিনী’ ◈ হোটেলে নারীকে মারধর করা বহিষ্কৃত যুবদল নেতার বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তারের চেষ্টায় পুলিশ ◈ বনানীর জাকারিয়া হোটেলে ঢুকে নারীদের ওপর যুবদল নেতার হামলা, ভিডিও ◈ দাঁড়িপাল্লা প্রতীকসহ জামায়াতের নিবন্ধন পুনর্বহালের গেজেট প্রকাশ ◈ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও শহীদ দিবস পালনের নির্দেশ ◈ তিন দিনের ছুটিতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, পাবেন না যারা ◈ উচ্চ ও নিম্ন আদালতকে ফ্যাসিস্টমুক্ত করতে হবে: সালাহউদ্দিন

প্রকাশিত : ১২ জানুয়ারী, ২০২৪, ১০:৫৯ দুপুর
আপডেট : ১২ জানুয়ারী, ২০২৪, ১০:৫৯ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

শব্দ-বিন্দু-আনন্দ-সিন্ধু : ‘সূত্র ’

মানবর্দ্ধন পাল: কৈশোরকালে স্কুলজীবনে প্রথম ‘সূত্র’ শব্দটির সঙ্গে আমরা কমবেশি পরিচিত হয়েছি। তখন এর একটি অর্থই জেনেছি- সংজ্ঞা। কোনো জটিল ও দুর্বোধ্য বিষয়ের নিয়মকেই ‘সূত্র’ বলে জানতাম। সে-সময় সূত্র মানেই মগজ গরম-করা বিষয়, করোটির ভেতরের শ্বেত পদার্থ বৈদ্যুতিক চুল্লিতে টগবগ করে ফোটানো এবং মাথায় আকাশ ভেঙে-পড়া অবস্থা। সেই অর্বাচীন বয়সের অপক্ব মস্তিষ্কে ‘সূত্র’ মানে ব্যাকরণ, বিজ্ঞান, পাটিগণিত, জ্যামিতি ও বীজগণিতের মগজ- গলানো নিয়ম-কানুন। ‘সূত্র’ ও ‘সংজ্ঞা’ বানানের জটিলতাই যখন সুবোধ্য হয়নি তখন নানা বিষয়ের জঙ্গম সূত্রের নিয়ম-কানুন আত্মস্থ করা কোমলমতি সাধারণ শিক্ষার্থীর জন্য স্নায়ুবিক চাপ বৈকি।

 এই পরিণত বয়সে প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ চুকিয়েও স্নায়ুবিক চাপ কমে না বরং আরো বেড়ে যায়- যখন জানতে পারি ‘সূত্র’ শব্দের আছে আরো অনেক বিচিত্র অর্থের সমাহার। আছে সরলার্থ, নিহিতার্থ এবং বহুমাত্রিক অর্থান্তর। সূত্রের শুরুতে যে ‘সূ’ তাও কিন্তু নিরর্থক নয়। আমরা সাধারণরা সু-এর মানে জানি কিন্তু ‘সূ’ অর্থ অনেকেই জানি না। আমাদের চারপাশে বন্ধু-স্বজন, পরিচিতদের মধ্যে অনেকের নামের আদ্যক্ষর ‘সু’ দিয়ে- সুজন, সুবোধ, সুভাষ, সুধীর, সুনীল, সুনাম ইত্যাদি। তারুণ্যে সুদর্শনা সুবর্ণা, সুস্মিতা ও সুচিত্রাদের আমরা পেছন ফিরে দেখেছি- সুকণ্ঠী সুলতাদের গান শুনে মুগ্ধ হয়েছি। তাতে সহজেই বুঝে গেছি, ‘সু’ মানে সুন্দর। কেবল তাই নয়, ‘সু’ বাংলা ও সংস্কৃত উপসর্গগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। সেই কোমল কৈশোরে জেনেছি, বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় চারটি উপসর্গে মিল- আ সু বি নি। তা এখনো ভুলিনি। ‘সূত্র’ শব্দের শুরুতে দীর্ঘ ঊ-কার যুক্ত ‘সূ’ আছে। তা ব্যাকরণের উপসর্গ নয়- স্বাধীন শব্দ।

অভিধানকাররা জানান, এই ‘সূ’ মানে প্রসব- জননীর সন্তান প্রসবের প্রক্রিয়া। এই ‘সূ’- এর সঙ্গে ‘ত’ যুক্ত করলে ‘সূত’ অর্থ, পুত্র। এর আরো বিচিত্র অর্থ আছে : ১. জাত ২. সূর্য ৩. উৎপাদিত ৪. পুরাণকথক ৫. সারথি ৬. পারদ ৭. স্তুতিপাঠক ৮. সূত্রধর জাতি ৮. বন্দনাকারী। এই ‘সূ’ থেকে সংস্কৃত শব্দ ‘সূত্র’। সূত্র থেকে সূত, সূতক, সূতিকা, সূতা, সুতা, সূতি, সুতি, সুতলি। দারুশিল্পী বা কাঠমিস্ত্রিকে আমরা বলি সূত্রধর বা সুতার। এসব শব্দেরই উৎসমূল এক। সূত্রের সংজ্ঞায় চৈতন্যচরিতামৃতে বলা হয়েছে, যে বাক্য ‘স্বল্পাক্ষর, সন্দেহ-বিশিষ্ট পদশূন্য, অসারতাহীন, সমস্ত লক্ষ্যগামী, সর্ব্বাংশে ত্রুটিহীন ও অনিন্দ্যনীয়’ তাকেই সূত্র বলে। মধ্যযুগের সাহিত্যে ‘সূত্র’ শব্দের অর্থের বহুবিধ প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। একালে সেসব অর্থ অনেকটাই ম্লান, প্রয়োগ সীমিত এবং অধিকাংশ অভিধানের পাতায় বন্দি। এখন পুরনো সেসব অর্থ ও প্রয়োগবিধি জেনে নেওয়া যাক। 

 [১] ‘সূত্রপুঁথি হাতে লৈয়া চণ্ডীপাঠ গাও।’ (শব্দার্থতত্ত্ব গ্রন্থ অর্থে, বংশী দাসের মনসামঙ্গল)। [২] ‘এই যে কহিল সূত্র সংক্ষেপ করিয়া।’ (বিষয় নির্দেশ অর্থে, চৈতন্য ভাগবৎ)। [৩] ‘প্রথমেতে সূত্ররূপে করিব গণন; পাছে বিস্তারিয়া তার করিব বিবরণ।’ (সারসংক্ষেপ অর্থে, চৈতন্যচরিতামৃত)। [৪] ‘এতো যে কাণ্ড হলো তার সূত্র খুঁজে পাওয়া গেলো না।’ (মূল অর্থে, প্রচলিত)। [৫] ‘সেই সব লীলার আমি সূত্রমাত্র কৈল।’ (ইঙ্গিত অর্থে, কৃষ্ণদাস)। [৬] ‘এই অন্তলীলা সার/সূত্র মধ্যে বিস্তার।’ (শ্লোক অর্থে, কৃষ্ণদাস)। [৭] ‘শিখা-সূত্র ঘুচাইলে সে কৃষ্ণ পাই।’ (পৈতা অর্থে, বৃন্দাবন দাস)। [৮] ‘পুরিলুঁ রসের সূত্রে সুবলিত হার।’ (বাঁধন অর্থে, দৌলত উজির বাহরাম খাঁ)। [৯] ‘তন্মধ্যে যে সূত্রগাছি সর্বাপেক্ষা স্থূল তাহার নাম গর্ভকেশর।’ (কোমল পুষ্পদণ্ড অর্থে, অক্ষয়কুমার দত্ত)। [১০] ‘বৈদিক গ্রন্থ চারি অংশে বিভক্ত- চ্ছন্দ-মন্ত্র-ব্রাহ্মণ এবং সূত্র।’ (বেদের অংশবিশেষ অর্থে, বঙ্গদর্শন পত্রিকা)। [১১] ‘ব্যারিষ্টার রঞ্জিৎ পণ্ডিতের সাথে শ্রীযুক্তা বিজয়লক্ষ্মী পরিণয়-সূত্রে আবদ্ধ হন।’ (বিবাহ অর্থ, বেগম পত্রিকা)। [১২] ‘পরম্পরা পরস্পর শুনি এই সূত্র/স্ত্রীভাগ্যে ধন, পুরুষের ভাগ্যে পুত্র।’ (ব্যবস্থা অর্থে, ভারতচন্দ্র)। [১৩] ‘অপূর্ব ঈশ্বরলীলা, কর্ম্মমাত্র সূত্র।’ (কারণ অর্থে, মহাভারত, কাশীরাম দাস)। [১৪] ‘বাহিরে কোনোরকম আমোদের সূত্র না পাইলে ঘরে আসিয়া মাথায় হাত দিয়া বসে।’ (ছল-ছুতা অর্থে, আলালের ঘরের দুলাল)। [১৫] ‘নন্দের হয়েছে পুত্র, সেই কথার শুনে সূত্র,/(দৈবজ্ঞ) মহানন্দে নন্দালয়ে যায়।’ (আভাস অর্থে, দাশরথি রায়ের পাঁচালি)। [১৬] ‘তরণী তীরঘেষে চলে সূত্রের টানে।’ ( গুণরজ্জু বা নৌকা টানার দড়ি অর্থে, বর্তমান লেখক)।

এছাড়াও সমাসবদ্ধ রূপে পদটির অর্থ-বৈচিত্র্য লক্ষণীয় : সূত্রছিন্ন= শেকড়হীন। সূত্রধর= ছুতার, কাঠমিস্ত্রি, পেশাজীবী হিন্দু সম্প্রদায়বিশেষ অথবা ধারাবাহিকতা বহনকারী। সূত্রধার= নাটকের কাহিনি-সূত্র ধরিয়ে দেন এমন চরিত্র। সূত্রধারী/সূত্রবাহী= পৈতাধারী ব্রাহ্মণ। বর্তমান পর্বটি ‘শুষ্কং কাষ্ঠং’- এর মতো নীরস ও কঠিন হয়ে গেলো। এই কাঠিন্য  ও নীরসতা, বোঝা যাচ্ছে, বিষয়ের ব্যাখ্যায়, বর্ণনে এবং উদাহরণে। সহজ কথাটি আর সরল করে লেখা গেলো না। তাই নীরস-কাঠিন্য নিয়ে সুরসিক রবীন্দ্র-জীবনের একটি গল্প বলি : কবির এক নারীভক্ত তাঁকে আপ্যায়নের জন্য সকালে শীতের পিঠা নিয়ে এসেছেন। চালের গুঁড়ির পিঠাগুলো ছিলো আগের দিন রাতে বানানো। রবীন্দ্রনাথ চোখ মুদে খাচ্ছেন দেখে নারীভক্ত জিজ্ঞেস করলেন- পিঠা কেমন হয়েছে গুরুদেব? কবির সরস উত্তর- একি পিষ্টক না ইষ্টক, বুঝতে পারছি না! এপর্বটিও অনেকটা তেমনই হয়ে গেলো।

লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়