লিফটে চড়া আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু যদি কখনো লিফটের তার ছিঁড়ে যায় বা লিফটটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিচে পড়তে শুরু করে, তবে সেই চরম মুহূর্তে সঠিক পদক্ষেপই আপনার জীবন বাঁচাতে পারে। অনেকেই এই পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেন। তবে বিশেষজ্ঞরা একটি নির্দিষ্ট কৌশল অবলম্বনের পরামর্শ দেন, যা আপনাকে গুরুতর আঘাত থেকে রক্ষা করতে পারে।
যদি আপনি বুঝতে পারেন লিফটটি অবাধে নিচে পড়ছে, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে লিফটের মেঝেতে পিঠ লাগিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ুন।
অবস্থান: পিঠ মেঝেতে রেখে সোজা হয়ে শুয়ে পড়ুন।
মাথা ও মুখ রক্ষা: এক হাত বা উভয় হাত দিয়ে আপনার মাথা এবং মুখমণ্ডল ঢেকে রাখুন, যাতে কোনো ধ্বংসাবশেষ বা লিফটের ছাদ থেকে খসে পড়া অংশ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন। সম্ভব হলে আপনার ব্যাগ বা কোট মাথায় নিচে দিয়ে কুশনের মতো ব্যবহার করতে পারেন।
এই কৌশলের পেছনের মূল বিজ্ঞান হলো শক্তির বন্টন (Force Distribution)।
যখন লিফটটি নিচে সজোরে আছড়ে পড়ে, তখন প্রচণ্ড গতির কারণে একটি 엄청 শক্তি (Impact Force) তৈরি হয়। আপনি যদি দাঁড়িয়ে থাকেন, তাহলে এই সম্পূর্ণ শক্তি আপনার পা বেয়ে শিরদাঁড়া ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে সঞ্চালিত হবে। মানুষের পা বা শিরদাঁড়া এই 엄청 চাপ সহ্য করতে পারে না, ফলে মারাত্মক ভাঙন বা অভ্যন্তরীণ আঘাতের ঝুঁকি থাকে।
বিপরীতে, আপনি যখন মেঝেতে শুয়ে পড়েন, তখন আপনার শরীর একটি বৃহৎ পৃষ্ঠতল (Surface Area) তৈরি করে। ফলে, আছড়ে পড়ার শক্তিটি কোনো একটি নির্দিষ্ট অঙ্গে কেন্দ্রীভূত না হয়ে আপনার পুরো শরীরে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায়, চাপ = বল / ক্ষেত্রফল (Pressure = Force / Area)। ক্ষেত্রফল যত বেশি হবে, শরীরের প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে চাপের পরিমাণ তত কমে যাবে। এর ফলে, হাড় ভাঙা বা গুরুতর অভ্যন্তরীণ আঘাতের আশঙ্কা অনেকাংশে হ্রাস পায়।
অনেকের মধ্যেই কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত আছে, যা এই পরিস্থিতিতে জীবনহানির কারণ হতে পারে।
১. ভুল ধারণা: লাফ দেওয়া
অনেকে ভাবেন, লিফটটি মেঝেতে আঘাত করার ঠিক আগ মুহূর্তে লাফ দিলে বেঁচে যাবেন। এটি একটি মারাত্মক ভুল ধারণা।
কারণ: প্রথমত, লিফট কখন মেঝেতে আঘাত করবে তা সঠিকভাবে অনুমান করা প্রায় অসম্ভব। দ্বিতীয়ত, লিফট যে প্রচণ্ড গতিতে নিচে পড়ছে, তার তুলনায় আপনার লাফের গতি হবে নগণ্য। উদাহরণস্বরূপ, লিফট যদি ঘণ্টায় ৫০ কিমি বেগে নিচে পড়ে, আর আপনি ৫ কিমি বেগে লাফ দেন, তাহলেও আপনি ঘণ্টায় ৪৫ কিমি বেগেই নিচে আঘাত করবেন, যা প্রায় সমান বিপজ্জনক।
২. ভুল ধারণা: হাঁটু ভেঙে দাঁড়িয়ে থাকা
কেউ কেউ মনে করেন, হাঁটু সামান্য ভেঙে দাঁড়ালে পায়ের পেশি শক অ্যাবজরভারের (Shock Absorber) মতো কাজ করবে।
কারণ: লিফট পড়ার শক্তি এতটাই বেশি যে মানুষের পায়ের পেশি বা হাড় তা শোষণ করতে পারে না। এতে আপনার পা এবং শিরদাঁড়ায় প্রচণ্ড চাপ পড়বে এবং ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকবে।
আতঙ্কিত হবেন না: যদিও এটি বলা সহজ, করা কঠিন, তবুও মাথা ঠান্ডা রাখা জরুরি। আতঙ্কিত হলে আপনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না।
চোখ বন্ধ রাখুন: চোখ বন্ধ রাখলে মানসিক চাপ কিছুটা কমতে পারে এবং ছিটকে আসা কোনো বস্তু থেকে চোখ রক্ষা পাবে।
সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করুন: লিফট থেমে যাওয়ার পর দরজা খোলার জন্য জোর করবেন না। ইমার্জেন্সি অ্যালার্ম বোতাম চাপুন বা ইন্টারকম/মোবাইল ফোন ব্যবহার করে সাহায্য চান এবং অপেক্ষা করুন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, আধুনিক লিফটের তার ছিঁড়ে অবাধে নিচে পড়ে যাওয়ার ঘটনা অত্যন্ত বিরল। আধুনিক লিফটগুলোতে একাধিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে:
একাধিক ইস্পাতের তার (Multiple Steel Cables): প্রতিটি লিফটে তার ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী একাধিক তার ব্যবহার করা হয়। একটি ছিঁড়ে গেলেও বাকিগুলো লিফটের ভার বহন করতে সক্ষম।
গতি নিয়ন্ত্রক বা গভর্নর (Governor System): লিফট নির্দিষ্ট গতির চেয়ে দ্রুত চলতে শুরু করলে এই যন্ত্রটি সক্রিয় হয়।
সেফটি ব্রেক (Safety Brakes): গভর্নর সক্রিয় হওয়ার সাথে সাথেই লিফটের পাশে থাকা রেলকে আঁকড়ে ধরে এমন একটি ব্রেকিং সিস্টেম চালু হয়ে যায়, যা লিফটকে তৎক্ষণাৎ থামিয়ে দেয়।
বাফার (Buffers): লিফট শ্যাফটের একেবারে নিচে বড় স্প্রিং বা হাইড্রোলিক শক অ্যাবজরভার থাকে, যা কোনো কারণে লিফট নিচে চলে এলেও আঘাতের তীব্রতা কমিয়ে দেয়।
সুতরাং, লিফট ছিঁড়ে পড়ার ভয় না পেয়ে এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে অবগত থাকা উচিত। তবে জ্ঞান এবং প্রস্তুতি যেকোনো দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
সূত্র:
ডিসকভারি চ্যানেল (Discovery Channel) - "MythBusters" অনুষ্ঠান, যেখানে এই তত্ত্বটি পরীক্ষা করে দেখানো হয়েছে।
ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (MIT) - পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের প্রায়ই এই ধরনের সমস্যার সমাধান করতে দেওয়া হয়।
বিভিন্ন লিফট প্রস্তুতকারক সংস্থা ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের প্রকাশনা (যেমন: National Elevator Industry, Inc. - NEII)।