নিউইয়র্ক সিটির ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাথমিক নির্বাচনে ভারতীয় বংশোদ্ভূত জোহরান মামদানির বিপুল বিজয় তাকে শহরের প্রথম দক্ষিণ এশীয় মেয়র হওয়ার পথে এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে। তবে এই জয় ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সমর্থক এবং প্রবাসী হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। তার মুসলিম পরিচয় এবং ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকারের কঠোর সমালোচনা এই বিদ্বেষের প্রধান কারণ বলে আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
বিদ্বেষপূর্ণ আক্রমণ ও প্রচারণা:
গত ২৪ জুন নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর থেকেই ৩৩ বছর বয়সী জোহরান মামদানিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে 'জিহাদি', 'ইসলামপন্থী' ও 'ভারতবিরোধী' বলে আক্রমণ করা হচ্ছে। এই প্রচারণার অংশ হিসেবে:
নিউ জার্সিভিত্তিক 'ইন্ডিয়ান আমেরিকানস ফর কুয়োমো' নামের একটি গোষ্ঠী নিউইয়র্কের আকাশে একটি ব্যানার উড়িয়েছে, যেখানে লেখা ছিল, "সেফ নিউইয়র্ক সিটি ফ্রম গ্লোবাল ইনতিফিদা, রিজেক্ট মামদানি" (বৈশ্বিক ইন্তিফাদা থেকে নিউইয়র্ককে বাঁচান, মামদানিকে প্রত্যাখ্যান করুন)।
ভারতের ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য কঙ্গনা রানাউত এক্স-এ (সাবেক টুইটার) মামদানিকে 'পাকিস্তানপন্থী' হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন এবং অভিযোগ করেছেন যে তিনি 'হিন্দুধর্ম নিশ্চিহ্ন করতে উদ্যত'।
বিজেপিপন্থী প্রভাবশালী ভারতীয় টিভি চ্যানেল আজ-তাক এক প্রতিবেদনে দাবি করেছে, মামদানি 'ভারতবিরোধী' সংগঠন থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন।
ওয়াশিংটনভিত্তিক সেন্টার ফর স্টাডি অব অর্গানাইজড হেট-এর পরিচালক কায়লা বাসেট এই ঘটনাকে "সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায়কে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপনের একটি সংগঠিত চেষ্টা" বলে মন্তব্য করেছেন।
ক্ষোভের নেপথ্যে মামদানির অবস্থান:
জোহরান মামদানি বরাবরই নিজেকে একজন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে পরিচয় দেন এবং বিভিন্ন ইস্যুতে মোদি সরকারের সমালোচনায় মুখর ছিলেন। তার যে অবস্থানগুলো হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীকে ক্ষুব্ধ করেছে সেগুলো হলো:
তিনি ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা এবং বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।
ভারতের কারাবন্দী মানবাধিকারকর্মী উমর খালিদের মুক্তির দাবি তুলেছেন।
সম্প্রতি এক টাউন হল সভায় তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে 'যুদ্ধাপরাধী' হিসেবে আখ্যা দেন এবং ভবিষ্যতে মোদির নিউইয়র্ক সফরে তার সঙ্গে কোনো বৈঠকে অংশ নেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন।
সান্তা ক্লারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোহিত চোপড়ার মতে, হিন্দুত্ববাদী মহল গুজরাট দাঙ্গার মতো বিষয়গুলো নিয়ে নীরবতা পছন্দ করে। যখন মামদানির মতো কেউ আন্তর্জাতিক মঞ্চে এই বিষয়গুলো মনে করিয়ে দেন, তখন তারা ক্ষুব্ধ হয়।
সমালোচনার বিপরীতে বিপুল জনপ্রিয়তা:
তীব্র সমালোচনা সত্ত্বেও জোহরান মামদানি নিউইয়র্কের দক্ষিণ এশীয়, বিশেষ করে মুসলিম ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।
তিনি প্রাথমিক নির্বাচনে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে ৫৬ শতাংশ ভোটে পরাজিত করেছেন।
নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক অরবিন্দ রাজাগোপাল মামদানির এই জয়কে 'সিসমিক' (ভূমিকম্প-তুল্য) বিজয় বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে, মামদানির স্প্যানিশ, হিন্দি, উর্দু এবং বাংলা ভাষায় দক্ষতা তাকে সাধারণ মানুষের কাছে বিরল নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
ডেসিস রাইসিং আপ অ্যান্ড মুভিং (DRUM)-এর রাজনৈতিক পরিচালক জাগপ্রীত সিং জানান, সমালোচনার সিংহভাগই শহরের বাইরের গোষ্ঠী থেকে আসছে। নিউইয়র্কের স্থানীয় হিন্দু ও দক্ষিণ এশীয় কমিউনিটি তাকে আপন করে নিয়েছে। মামদানি দীপাবলিকে রাজ্য সরকারের ছুটির দিন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য একটি বিলও পেশ করেছিলেন।
জোহরান মামদানির বিজয় তিনটি বিষয়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে: তার মুসলিম পরিচয়, মোদি সরকারের নীতির বিরোধিতা এবং নিউইয়র্কের গরিব ও মধ্যবিত্ত দক্ষিণ এশীয় কমিউনিটির প্রতিনিধিত্ব। তার এই উত্থান কেবল নিউইয়র্কের স্থানীয় রাজনীতিতেই নয়, বরং প্রবাসী ভারতীয়দের সামাজিক সমীকরণ এবং বৈশ্বিক রাজনীতিতেও একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিচ্ছে। আর এর বিরুদ্ধে মোদি সমর্থকদের তীব্র ক্ষোভ তাদের মুসলিমবিদ্বেষী মনোভাবকেই স্পষ্ট করে তুলছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।