দেশে বোরো ধানের রেকর্ড উৎপাদন সত্ত্বেও মিলারদের কারসাজি এবং যথাযথ সরকারি নজরদারির অভাবে চালের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। ভরা মৌসুমেও দাম কমার বদলে উল্টো বাড়ছে, যার ফলে কৃষক ও ভোক্তা কেউই সুফল পাচ্ছেন না।
দেশে এ বছর রেকর্ড পরিমাণ বোরো ধান উৎপাদন হলেও এর ইতিবাচক প্রভাব বাজারের উপর পড়েনি। উল্টো বোরোর ভরা মৌসুমেই হু হু করে বাড়ছে সব ধরনের চালের দাম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে নজরদারির অভাবের সুযোগে মিলাররা সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এর ফলে পাইকারি আড়ত থেকে শুরু করে খুচরা বাজার পর্যন্ত সর্বত্রই দাম ঊর্ধ্বমুখী। আমদানি ও অভ্যন্তরীণ ফলন ভালো হওয়া সত্ত্বেও এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
এক নজরে মূল সমস্যা:
কৃষকের ক্ষতি: কৃষকের হাতে ধান থাকার সময় দাম কম থাকে, কিন্তু ব্যবসায়ীদের হাতে গেলেই দাম বেড়ে যায়।
ভোক্তার চাপ: গত এক বছরে চালের দাম গড়ে ১৫% বেড়েছে, যা সাধারণ মানুষের উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে।
মিলারদের কারসাজি: অভিযোগ উঠেছে, বড় বড় মিলার ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো পরিকল্পিতভাবে বাজারকে অস্থির করে তুলেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর বোরো মৌসুমে রেকর্ড ২ কোটি ১৪ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে, যা গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
২০১৯-২০: ১ কোটি ৯৫ লাখ টন
২০২০-২১: ১ কোটি ৯৩ লাখ টন
২০২১-২২: ২ কোটি টন
২০২২-২৩: ২ কোটি ৫ লাখ টন
২০২৩-২৪: ২ কোটি ১৪ লাখ টন
অন্যদিকে, সরকারের গুদামেও চাল ও গমের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। চলতি অর্থবছরের শুরুতে মজুতের পরিমাণ ছিল ১৭.৬৪ লাখ মেট্রিক টন, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩ লাখ টন বেশি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, এই পরিস্থিতিতে চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে, গত এক মাসে চিকন চালের দাম ৫% এবং মাঝারি ও মোটা চালের দাম ৯% বেড়েছে। সরকারি সংস্থা টিসিবি-র প্রতিবেদনেও দাম বাড়ার চিত্র উঠে এসেছে।
ব্যবসায়ী ও মিলারদের বক্তব্য:
রাজধানীর বাদামতলী চাল আড়ত মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজামউদ্দিন বলেন, "দেশের চালের বাজার এখন অটো রাইস মিল ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর দখলে। তারা প্রতিযোগিতা করে ধান কেনায় ধানের বাজার বাড়তি।"
বাংলাদেশ অটো, মেজর ও হাস্কিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী বলেন, "বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো হাজার হাজার মণ ধান কিনছে। তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে সাধারণ মিলাররা ব্যবসা ছাড়ছেন। বাজারে ধানের সরবরাহ কম, তাই চালের দামও বেশি।"
কৃষক ও বিশেষজ্ঞদের ভিন্নমত:
তবে কৃষকরা বলছেন, প্রতিযোগিতা করে ধান কিনলে তাদের লাভবান হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তারা অধিক মুনাফা পাননি। নাটোরের কৃষক তোফাজ্জেল হোসেন বলেন, "মোকামে ধানের দাম বেশি শুনেছি, কিন্তু এর সুফল আমরা পাইনি।"
ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির সরাসরি মিলারদের দায়ী করে বলেন, "সবই মিলারদের সাজানো কারসাজি। কৃষকের হাতে ফসল থাকলে দাম কমিয়ে রাখা হয়, আর তাদের হাত থেকে চলে গেলেই দাম বাড়িয়ে ভোক্তাকে ক্ষতির মুখে ফেলা হয়।"
কোরবানির ঈদের পর থেকে প্রতি বস্তা চালে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। শুক্রবার (৪ জুলাই) রাজধানীর খুচরা বাজারে চালের দাম ছিল নিম্নরূপ:
মোটা চাল (ইরি/স্বর্ণা): ৫৫ থেকে ৬০ টাকা/কেজি
মাঝারি চাল (পাইজাম/লতা): ৬০ থেকে ৬৭ টাকা/কেজি
সরু চাল (নাজিরশাইল/মিনিকেট): ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা/কেজি
যা সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ৩ থেকে ৫ টাকা বেশি।
এ প্রসঙ্গে কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, "উৎপাদন ভালো হওয়া সত্ত্বেও দাম বাড়তি। সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ফসল কেনার সময় ১৫ দিন এগিয়ে এনেছে। তবে আমাদের মূল সমস্যা দুর্নীতি। এটা রোধ করা গেলে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব।"
সার্বিকভাবে, রেকর্ড উৎপাদনের পরেও চালের বাজারের এই অস্থিরতা প্রমাণ করে যে, সরবরাহ বা মজুতের চেয়েও শক্তিশালী সিন্ডিকেট এবং বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাই দাম বৃদ্ধির মূল কারণ। এই চক্র ভাঙতে না পারলে কৃষক ও ভোক্তা উভয়েরই স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হতে থাকবে। উৎস: বাংলাট্রিবিউন।