গ্রীষ্মকাল মানেই চারিদিকে পাকা আমের ম-ম গন্ধ আর রসালো স্বাদ। 'ফলের রাজা' হিসেবে পরিচিত এই ফলটি পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং প্রায় সকলেরই প্রিয়। ভিটামিন, মিনারেলস আর অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর আম শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। কিন্তু অমৃতও বেশি খেলে বিষে পরিণত হতে পারে। লোভে পড়ে বা স্বাদের বশে অতিরিক্ত আম খাওয়ার ফলে লাভের চেয়ে ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি, যা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
আসুন, বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক অতিরিক্ত আম খেলে কী কী বিপদ হতে পারে।
অতিরিক্ত আম খাওয়ার স্বাস্থ্যঝুঁকি:
১. ওজন বৃদ্ধি এবং স্থূলতা:
আমে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক চিনি, বিশেষ করে ফ্রুক্টোজ থাকে। এটি একটি উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত ফল। একটি মাঝারি আকারের আমে প্রায় ১৫০-২০০ ক্যালোরি থাকতে পারে। আপনি যদি আপনার নিয়মিত খাবারের পাশাপাশি দিনে বেশ কয়েকটি আম খান, তবে এই অতিরিক্ত ক্যালোরি শরীরে চর্বি হিসেবে জমা হতে শুরু করে। ফলস্বরূপ, ওজন দ্রুত বাড়তে পারে এবং স্থূলতার ঝুঁকি তৈরি হয়।
২. ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বৃদ্ধি:
আমের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) মাঝারি মানের (প্রায় ৫১)। পরিমিত পরিমাণে খেলে এটি রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু একসঙ্গে অনেক বেশি আম খেলে এর মধ্যে থাকা শর্করা দ্রুত রক্তে মিশে যায়, যা ব্লাড সুগার স্পাইক (Blood Sugar Spike) ঘটায়। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক। এমনকি যাদের ডায়াবেটিস নেই, তাদের ক্ষেত্রেও দীর্ঘমেয়াদে অতিরিক্ত আম খাওয়া ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
৩. পেটের সমস্যা ও হজমের গোলযোগ:
ডায়রিয়া: পাকা আমে প্রচুর পরিমাণে ডায়েটারি ফাইবার থাকে। পরিমিত পরিমাণে ফাইবার হজমের জন্য উপকারী হলেও, অতিরিক্ত ফাইবার পেটে অস্বস্তি, গ্যাস এবং ডায়রিয়ার কারণ হতে পারে।
গ্যাস্ট্রিক ও বদহজম: অন্যদিকে, বেশি পরিমাণে কাঁচা আম খেলে এর কষ ও অম্লতার কারণে গ্যাস্ট্রিক, অ্যাসিডিটি এবং বদহজমের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম (IBS): আমে প্রচুর পরিমাণে ফার্মেন্টেবল অলিগোস্যাকারাইড, ডাইস্যাকারাইড, মনোস্যাকারাইড এবং পলিওলস (FODMAPs) থাকে, যা এক ধরনের কার্বোহাইড্রেট। যাদের আইবিএস-এর সমস্যা আছে, তাদের ক্ষেত্রে এই উপাদানগুলো হজম করা কঠিন হয়ে পড়ে এবং পেটে ব্যথা, গ্যাস, ফোলাভাবের মতো সমস্যাগুলো বাড়িয়ে তোলে।
৪. অ্যালার্জির সমস্যা:
আমের খোসা এবং বোঁটার কাছে এক ধরনের আঠালো তৈলাক্ত পদার্থ থাকে, যাতে ইউরুশিওল (Urushiol) নামক একটি রাসায়নিক উপাদান পাওয়া যায়। এই উপাদানটি অনেকের ত্বকে চুলকানি, ফুসকুড়ি বা অ্যালার্জিক রিয়্যাকশনের (Contact Dermatitis) কারণ হতে পারে। এছাড়াও, কিছু ব্যক্তির সরাসরি আমের শাঁসেও অ্যালার্জি থাকতে পারে, যা খেলে মুখ বা গলা চুলকাতে পারে।
৫. ত্বকের সমস্যা:
অতিরিক্ত মিষ্টি ফল, যেমন আম, বেশি পরিমাণে খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ে। এর ফলে শরীরে ইনফ্ল্যামেশন বা প্রদাহ সৃষ্টি হতে পারে এবং সিবাম (ত্বকের প্রাকৃতিক তেল) উৎপাদন বেড়ে যায়। এর পরিণতিতে অনেকের মুখে ব্রণ এবং অন্যান্য ত্বকের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
উপকারিতাও অনস্বীকার্য:
অবশ্যই মনে রাখতে হবে, পরিমিত পরিমাণে আম খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। আমে রয়েছে:
ভিটামিন এ: দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে।
ভিটামিন সি: রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ত্বক সুস্থ রাখে।
ফাইবার: কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং হজমশক্তি উন্নত করে।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (যেমন ম্যাঙ্গিফেরিন, বিটা-ক্যারোটিন): কোষকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচায় এবং ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়।
কতটা আম খাওয়া নিরাপদ?
একজন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি, যার অন্য কোনো শারীরিক সমস্যা নেই, তিনি দিনে একটি বা সর্বোচ্চ দুটি মাঝারি আকারের আম খেতে পারেন। তবে যাদের ডায়াবেটিস, স্থূলতা, আইবিএস বা হজমের সমস্যা রয়েছে, তাদের অবশ্যই পুষ্টিবিদ বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে পরিমাণ নির্ধারণ করা উচিত।
শেষ কথা:
গ্রীষ্মের এই সুস্বাদু ফলের স্বাদ উপভোগ করুন, তবে পরিমিত পরিমাণে। স্বাদের লোভে পড়ে নিজের শরীরের ক্ষতি করবেন না। সচেতন থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং নিয়ম মেনে ফলের রাজার স্বাদ গ্রহণ করুন।
সূত্র:
হেলথলাইন (Healthline): আমে থাকা পুষ্টিগুণ এবং অতিরিক্ত খাওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত প্রতিবেদন।
মেডিকেল নিউজ টুডে (Medical News Today): আম এবং ডায়াবেটিসের সম্পর্ক বিষয়ক গবেষণা।
ওয়েবএমডি (WebMD): আমের অ্যালার্জি এবং হজম সংক্রান্ত তথ্য।
বিভিন্ন পুষ্টিবিদ ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের মতামত ও পরামর্শ।