ডায়াবেটিস এবং উচ্চ কোলেস্টেরল—আধুনিক জীবনযাত্রার দুটি বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি। এই দুটি সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে খাদ্যাভ্যাসের ভূমিকা অপরিসীম। ব্রিটিশ হার্ট ফাউন্ডেশন (BHF)-এর মতো আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো সব সময়ই রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দেয়। কারণ, অনিয়ন্ত্রিত ব্লাড সুগার দীর্ঘমেয়াদে হৃৎপিণ্ড, কিডনি, চোখ এবং স্নায়ুতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।
সাধারণত, ডায়াবেটিসের প্রাথমিক উপসর্গগুলো সহজে বোঝা যায় না। যখন লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়, ততদিনে রোগটি শরীরে অনেকটাই বিস্তার লাভ করে। তাই আগে থেকে সতর্ক হওয়া এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি।
সম্প্রতি, খেজুর নিয়ে করা একটি গবেষণা এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত নতুন করে আলোচনায় এসেছে। যেখানে বলা হচ্ছে, প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণে খেজুর খেলে তা ডায়াবেটিস ও কোলেস্টেরল উভয়ই নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করতে পারে।
আপনার উল্লিখিত গবেষণাটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ র্যান্ডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল, যা ২০২০ সালে "Nutrients" নামক একটি प्रतिष्ठित আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়।
গবেষণার বিবরণ: এই গবেষণায় টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ১০০ জন রোগীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাদের দুটি দলে ভাগ করা হয়। একটি দলকে ১২ সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন তিনটি করে খালাস জাতের খেজুর খেতে দেওয়া হয়। অন্য দলটি (কন্ট্রোল গ্রুপ) খেজুর খাওয়া থেকে বিরত থাকে।
ফলাফল:
রক্তের শর্করার ওপর প্রভাব: গবেষণায় দেখা যায়, যে দলটি প্রতিদিন খেজুর খেয়েছে, তাদের খালি পেটে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা (Fasting Blood Glucose) বা দীর্ঘমেয়াদী ব্লাড সুগারের গড় নির্দেশক HbA1c-এর মাত্রায় কোনো উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ, খেজুর খাওয়ার ফলে তাদের ব্লাড সুগার বাড়েনি।
কোলেস্টেরলের ওপর প্রভাব: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দেখা যায় কোলেস্টেরলের মাত্রায়। যারা খেজুর খেয়েছিলেন, তাদের মোট কোলেস্টেরল (Total Cholesterol) এবং খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। একই সঙ্গে, তাদের ভালো কোলেস্টেরল (HDL)-এর মাত্রা বৃদ্ধি পায়।
সিদ্ধান্ত: গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, খেজুরের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় (প্রায় ৪২-৫৫) এটি রক্তে শর্করার মাত্রা হঠাৎ করে বাড়ায় না। বরং এর মধ্যে থাকা উচ্চমাত্রার ফাইবার এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কোলেস্টেরল কমাতে এবং সার্বিক কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সাহায্য করে।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের (NHS) চিকিৎসক এবং জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আমির খান এই বিষয়ে তার ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে একটি ভিডিওর মাধ্যমে মতামত দেন। তিনি বলেন:
"আমি গত এক বছর ধরে প্রতিদিন তিনটি করে খেজুর খাচ্ছি। এটি দীর্ঘমেয়াদে রক্তে শর্করার ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না, এমনকি ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রেও নয়। পরিশোধিত চিনির স্বাস্থ্যকর বিকল্প হিসেবে খেজুর একটি চমৎকার খাবার।"
তিনি খেজুরকে শুধু একা না খেয়ে ওটমিল, সালাদ, বাদাম বা স্বাস্থ্যকর স্মুদির সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ার পরামর্শ দেন, যা এর পুষ্টিগুণ আরও বাড়িয়ে তোলে।
১. হজম ও অন্ত্রের স্বাস্থ্য: খেজুরে প্রচুর পরিমাণে ডায়েটারি ফাইবার বা আঁশ থাকে। যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য নির্দেশিকা অনুযায়ী, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক ৩০ গ্রাম ফাইবার প্রয়োজন। মাত্র তিনটি খেজুর প্রায় ৫-৬ গ্রাম ফাইবার সরবরাহ করে, যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং অন্ত্রে উপকারী ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
২. অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর: খেজুরে ফ্ল্যাভোনয়েডস, ক্যারোটিনয়েডস এবং ফেনোলিক অ্যাসিড-এর মতো শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। এই উপাদানগুলো শরীরের কোষকে ফ্রি র্যাডিকেলের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে এবং দীর্ঘমেয়াদী রোগ যেমন—হৃৎপিণ্ড, ক্যানসার এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়।
৩. গর্ভাবস্থা ও প্রজনন স্বাস্থ্য: গবেষণা বলছে, গর্ভাবস্থার শেষ দিকে নিয়মিত খেজুর খেলে তা প্রসবের সময়কাল কমাতে এবং স্বাভাবিক প্রসবের সম্ভাবনা বাড়াতে সাহায্য করে। এর কিছু যৌগ মস্তিষ্কের অক্সিটোসিন রিসেপ্টরের মতো কাজ করে, যা প্রসবের জন্য প্রয়োজনীয় জরায়ুর সংকোচনকে উদ্দীপিত করে। পুরুষদের ক্ষেত্রে এটি শুক্রাণুর সংখ্যা ও গুণমান বাড়াতে এবং নারীদের হরমোনের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক হতে পারে।
৪. মস্তিষ্কের সুরক্ষা: কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, খেজুর মস্তিষ্কের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে, যা অ্যালঝাইমার্সের মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের ঝুঁকি কমাতে পারে।
সাধারণ মানুষের জন্য: ড. খানের মতে, সুস্থ ব্যক্তিরা প্রতিদিন ২-৩টি খেজুর অনায়াসে খেতে পারেন। এটি তাদের ডায়েটে পুষ্টি যোগাবে।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য: ডায়াবেটিস রোগীরা প্রতিদিন ১-২টি খেজুর খেতে পারেন। তবে অবশ্যই নিজের রক্তে শর্করার মাত্রা পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। খেজুর খাওয়ার সময় দিনের অন্য শর্করাজাতীয় খাবারের পরিমাণ সমন্বয় করা উচিত।
সতর্কতা: অতিরিক্ত পরিমাণে খেজুর খেলে এর উচ্চ ক্যালোরি ও প্রাকৃতিক চিনির কারণে ওজন বৃদ্ধি বা রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। প্রক্রিয়াজাত খেজুরের পণ্য, যেমন—খেজুরের সিরাপ বা চিনিযুক্ত খেজুর এড়িয়ে চলাই ভালো।
শেষ কথা: পরিমিত পরিমাণে খেলে খেজুর একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং উপকারী ফল, যা ডায়াবেটিস ও কোলেস্টেরল রোগীদের জন্যও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের অংশ হতে পারে। তবে যেকোনো নতুন অভ্যাস শুরুর আগে, বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে, একজন পুষ্টিবিদ বা চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক।
সূত্র:
গবেষণা: Al-Dashti, H. A., et al. (2020). "Consumption of Date Palm Fruit (Phoenix dactylifera L.) Does Not Adversely Affect Blood Glucose and Lipid Profile in Healthy Subjects." Nutrients.
বিশেষজ্ঞের মতামত: Dr. Amir Khan's official Instagram and public health statements.
সাধারণ স্বাস্থ্য তথ্য: British Heart Foundation (BHF) and NHS (UK) websites on healthy eating and diabetes management.
পুষ্টি তথ্য: USDA FoodData Central.