‘ছোট বোনের বিয়ে উপলক্ষে চার হাজার টাকা সুদে এক মাসের জন্য ফজর আলীর কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ধার নিই। কয়েকদিন আগে ওই টাকা ফেরত দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দিতে পারিনি। ফজরের কাছে আরও কয়েকদিন সময় চাই, কিন্তু তা না দিয়ে হুমকি দিতে থাকে। গত বৃহস্পতিবার রাতে সেই টাকার সূত্র ধরে বাড়িতে এসে ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে ধর্ষণ করে ফজর। ধর্ষণের বিষয়টি টের পেয়ে আশপাশের লোকজন এসে ফজরকে পেটাতে থাকে। এ সময় আমাকেও বিবস্ত্র অবস্থায় মারধর করেছিল তারা।’
নিজের ওপর ঘটে যাওয়া পাশবিক নির্যাতনের এভাবে বর্ণনা দিয়েছেন কুমিল্লার মুরাদনগরে ধর্ষণের শিকার নারী। তিনি বলেন, ‘আশপাশের কয়েকজন যুবক এসে আমাকে পিটিয়ে আহত করে। বারবার অনুরোধ করেও কোনও কাজ হয়নি। ওসব লোকজনই নির্যাতনের ভিডিও মোবাইলে ধারণ করে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়।’
মুরাদনগরের তিতাস নদীর পাড়ে ওই নারীর বাবার বাড়ি। তার বাবা নদীতে মাছ ধরে পরিবারের ভরণপোষণ চালান। ঘটনার পর থেকে পুরো পরিবার উদ্বেগ আর আতঙ্কে আছে। নির্যাতিত নারীর চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। তিনি এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান। তবে এটাও বলেছেন, তার প্রবাসী স্বামী কোনও ঝামেলা চান না। তিনি মামলা তুলে নিতে বলছেন। তবে অন্য কেউ তাকে মামলা তুলে নিতে বলেননি। তিনি বলেন, ‘আমি খুব ক্লান্ত। আর পারছি না। এমন যেন আর কারও সাথে না ঘটে। এত মানুষ বাড়িতে আসে। তাদের নানা প্রশ্ন। কীভাবে তাদের বোঝাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাই। এত মানুষ বাড়িতে আসুক, আমরা চাই না। আমার সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও এই হয়রানি বন্ধ করুন। আর নিতে পারছি না আমরা।’
এ ঘটনার পর থেকে ভুক্তভোগীর বাড়িতে মানুষের ভিড় কমছে না। এর মধ্যে স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রতিবেশী বেশি। রবিবার দুপুরে কুমিল্লার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নাজির আহমেদ খান পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে ওই বাড়িতে যান। তিনি ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেন। তবে সেখান থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনও কথা বলেননি। অবশ্য পরে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এ ঘটনায় জড়িত অন্য যারা, ভিডিও ছড়িয়েছে তাদেরও গ্রেফতার করা হবে। দুটি মামলা হয়েছে। সবাইকে শনাক্ত করে গ্রেফতার করা হবে।
কে এই ফজর আলী: ধর্ষণের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত ফজর আলী উপজেলার রামচন্দ্রপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের শহীদ মিয়ার ছেলে। তার বিষয়ে প্রতিবেশী আল আমিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ফজর আলী মূলত সুদের ব্যবসা করে। এলাকায় ঘুরে ঘুরে সুদের ওপরে মানুষকে টাকা দেয়। তবে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা ও ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়া খোকনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে। কোনও পদে আছে বলে আমার জানা নেই। ৫ আগস্টের পর অন্য দল করে কিনা, তাও জানি না। তাকে দিয়ে সবসময় আমাদের গ্রামে টিসিবির কার্ড বিতরণ করিয়েছেন চেয়ারম্যান।’
প্রতিবেশী আরেক বাসিন্দা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপি নেতাদের সঙ্গে মেশা শুরু করে ফজর। ইউনিয়ন বিএনপির পদ পাওয়ার চেষ্টা করেছিল।
ইউনিয়ন বিএনপির এক নেতা বলেন, ‘ফজর আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী। আওয়ামী লীগ নেতা খোকন চেয়ারম্যানের বডিগার্ড হিসেবে পরিচিত। ৫ আগস্টের পর খোকন চেয়ারম্যানের সঙ্গে চলাফেরা কমিয়ে দিয়েছে। তবে বিএনপির সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। কোনও পদেও নেই।’
একই এলাকার বাসিন্দা মাসুদ রানা বলেন, ‘তাকে ঘিরে বিএনপিকে জড়ানো হচ্ছে। আমরা ছোটবেলা থেকে দেখছি ফজর আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে। বিএনপির কোনও অনুষ্ঠানে দেখিনি।’
ফজরের বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়া খোকন বলেন, ‘ফজর আলীকে আমি তেমন চিনি না। আমি জনপ্রতিনিধি, আমার সঙ্গে অনেকে ছবি তুলতে আসে। আমি তো কাউকে ওভাবে মনে রাখি না।’
উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মহিউদ্দিন অঞ্জন বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে ফজর আলীর কোনও সম্পর্ক নেই। সে আওয়ামী লীগ করে। খোকন চেয়ারম্যানের দেহরক্ষী হিসেবে পরিচিত। এখন অনেকে তাকে বিএনপি কর্মী হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে তার বেশ কয়কটি ছবি দেখেছি, কিন্তু বিএনপির নেতাদের সঙ্গে একটা ছবিও নেই তার।’
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য আব্দুর রব বলেন, ‘ফজর এলাকার চিহ্নিত মাদক কারবারি। এলাকায় জুয়ার আসর বসিয়ে অনেক পরিবারকে নিঃস্ব করেছে। ১৫ বছর ধরে নিজেকে আওয়ামী লীগের নেতা পরিচয় দিতো, ৫ আগস্টের পর থেকে নিজেকে বিএনপির লোক বলে পরিচয় দিতে শুরু করে। তবে আওয়ামী লীগ বা বিএনপির কোনও কমিটিতে তার পদ নেই।’
স্তব্ধ, হতভম্ব ভুক্তভোগীর স্বজনরা : রবিবার বিকালে ভুক্তভোগীর বাবাকে ঘরের সামনে বসে থাকতে দেখা যায়। চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফজরের কাছ থেকে টাকা ধার নেওয়ার বিষয়টি স্ত্রী জানিয়েছেন। কিন্তু টাকা ধার নিয়ে এমন বিপদে পড়বেন জানলে কোনও দিনও ধার নিতেন না। চোখ মুছতে মুছতে বাবা বলেন, ‘এখন আর চোখে পানি আসে না। এত কষ্ট সহ্য করার শক্তি নেই। কার কাছে বিচার চাইবো। মানসম্মান বলতে আর কিছুই রইলো না। মানুষ বাড়িতে আসে, হাসিঠাট্টা করে বেড়াচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে আমাদের।’
ভুক্তভোগীর ছোট ভাই বলেন, ‘ঘটনার দিন মা-বাবা বাড়িতে ছিলেন না। তারা সাপ্তাহিক একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। আমি নিজে পাশের উপজেলা তিতাসে ছিলাম। সেখানে রাজমিস্ত্রির কাজ করি। বাড়িতে বোন, বোনের ছোট দুই ছেলেমেয়ে ছিল। তারা ঘুমিয়ে ছিল। এরই মধ্যে ঘটে যায় এমন ঘটনা।
বাড়িতে এসে শুনেছি, ফজর আলীর ভাই শাহ পরানের সঙ্গে তার বিরোধ চলছিল। সেই বিরোধের জের ধরে শাহ পরানই ঘটনার সময় আমাদের বাড়িতে লোকজন পাঠায়। তারাই মারধর করে ভিডিও ছড়িয়ে দেয়। এখন নানা জনে নানা কথা বলে বেড়াচ্ছে। যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের সবার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।’
ভুক্তভোগীর চাচা বলেন, ‘আমরা বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। এ ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। অভিযুক্ত ফজর ও ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় জড়িত সবাইকে গ্রেফতারের দাবি জানাই।’
এমন ঘটনা আগে ঘটেনি এই এলাকায়: চারদিকে পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার গাড়ির ভিড়। এমন গাড়িবহর প্রথম দেখছেন স্থানীয় লোকজন। তারা বলছেন, এমন ঘটনা এর আগে এখানে ঘটেনি। কল্পনাও ছিল না। তাই উৎসুক মানুষের ভিড় বেশি।
স্থানীয় বাসিন্দা তাহমিনা বেগম জানান, তিনি কুমিল্লা থেকে এসেছেন। এখানে তার ফুফুর বাড়ি। এমন ঘটনা এর আগে এই গ্রামে ঘটেনি। তাই শুনে দেখতে এসেছেন। তিনি বলেন, স্থানীয় বাসিন্দাদের মনে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। এমন ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হলে আরও ঘটতে পারে।
একই গ্রামের বাসিন্দা হাবিবুর রহমান হবি বলেন, ‘আমরা হিন্দু-মুসলিম, আওয়ামী লীগ-বিএনপি বুঝি না। ধর্ষকের কোনও পরিচয় নেই। শুধু শাস্তি চাই, কঠোর শাস্তি। এখানে আমার মেয়েও হতে পারতো। ঘটনায় জড়িত সবাইকে ধরতে হবে।’
ঘটনায় জড়িত সবাইকে গ্রেফতার করা হবে: ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মুরাদনগর সার্কেল) এ কে এম কামরুজ্জামান বলেন, ‘প্রকৃত অর্থেই ওই নারী পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বুঝেছি, তিনি সহজ-সরল প্রকৃতির মানুষ। আমরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। নির্যাতন ও ভিডিও ধারণের ঘটনায় আরও কেউ জড়িত আছেন কিনা, সেটিও তদন্ত করে দেখছি। ঘটনায় জড়িত সবাইকে গ্রেফতার করা হবে।’
দুই মামলা ও গ্রেফতার ৫: মুরাদনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুর রহমান বলেন, ‘ফজর আলীকে আসামি করে গত শুক্রবার মুরাদনগর থানায় ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন ওই নারী। এ ছাড়া রবিবার পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে আরেকটি মামলা করেন ভুক্তভোগী। ওই মামলায় চার জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতপরিচয় আরও ২০ থেকে ২৫ জনকে আসামি করা হয়। ফজরকে আজ ভোরে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনায় সময় পিটিয়ে তার হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সে এখন কুমিল্লা জেলা পুলিশ হাসপাতালে পুলিশ পাহারায় চিকিৎসাধীন। এ ছাড়া ভুক্তভোগীকে নির্যাতন করে ৫১ সেকেন্ডের ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় চার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলো- মোহাম্মদ আলী ওরফে সুমন, রমজান আলী, মো. আরিফ ও মো. অনিক। তাদের বিকালে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে মোহাম্মদ আলী নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের ওয়ার্ড কমিটির সাবেক নেতা।’ উৎস: বাংলাট্রিবিউন।