স্ট্রোককে প্রায়শই একটি আকস্মিক দুর্যোগ হিসেবে দেখা হয়, যা কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই আঘাত হানে। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে ভিন্ন কথা। একটি বড় ধরনের স্ট্রোক হওয়ার আগে, এমনকি কয়েক সপ্তাহ বা মাস আগেও, আমাদের শরীর বেশ কিছু সতর্কতামূলক সংকেত পাঠাতে শুরু করে। এই সংকেতগুলোকে ট্রানজিয়েন্ট ইস্কেমিক অ্যাটাক (Transient Ischemic Attack - TIA) বা "মিনি-স্ট্রোক" বলা হয়, যা একটি আসন্ন বড় স্ট্রোকের শক্তিশালী পূর্বাভাস।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং আমেরিকান স্ট্রোক অ্যাসোসিয়েশন (American Stroke Association) এর মতে, এই লক্ষণগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকলে এবং সময়মতো চিকিৎসা নিলে জীবন বাঁচানো সম্ভব। চলুন, স্ট্রোকের সেই গুরুত্বপূর্ণ ৫টি আগাম ইঙ্গিত সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
১. হঠাৎ মাথা ঘোরা এবং ভারসাম্য হারানো (Sudden Dizziness and Loss of Balance)
বিস্তারিত বিবরণ: কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে তীব্রভাবে মাথা ঘোরা, চারপাশ দুলছে বলে মনে হওয়া বা শরীরে টালমাটাল অবস্থা তৈরি হওয়া স্ট্রোকের একটি অন্যতম আগাম লক্ষণ। মস্তিষ্কের যে অংশ (বিশেষ করে সেরিবেলাম) আমাদের শরীরের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানে রক্ত সরবরাহ কমে গেলে এই সমস্যা দেখা দেয়। অনেকে এটিকে সাধারণ দুর্বলতা বা বয়সের কারণ বলে ভুল করেন, কিন্তু যদি এটি হঠাৎ এবং তীব্রভাবে হয়, তবে তা উপেক্ষা করা উচিত নয়।
কেন এটি সতর্ক সংকেত: মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে আবার চালু হলে এই ধরনের ক্ষণস্থায়ী ভারসাম্যহীনতা দেখা দিতে পারে, যা একটি মিনি-স্ট্রোক বা TIA-এর লক্ষণ।
২. শরীরের এক পাশ দুর্বল বা অবশ হয়ে যাওয়া (Sudden Weakness or Numbness on One Side)
বিস্তারিত বিবরণ: এটি স্ট্রোকের সবচেয়ে পরিচিত লক্ষণগুলোর মধ্যে একটি। হঠাৎ করে শরীরের যেকোনো একদিকের মুখ, হাত বা পা দুর্বল, অসাড় বা ঝিঁ ঝিঁ করার মতো অনুভূতি হতে পারে। অনেক সময় মুখ একপাশে বেঁকে যায়, হাসতে গেলে একদিকের ঠোঁট ওঠে না বা এক হাত অন্য হাতের মতো ওপরে তোলা যায় না। এই লক্ষণগুলো কয়েক মিনিট স্থায়ী হয়ে আবার ঠিক হয়ে যেতে পারে।
কেন এটি সতর্ক সংকেত: মস্তিষ্কের বাম অংশ শরীরের ডান দিককে এবং ডান অংশ বাম দিককে নিয়ন্ত্রণ করে। মস্তিষ্কের কোনো এক পাশে রক্ত চলাচল ব্যাহত হলে তার বিপরীত দিকের অংশে এই দুর্বলতা দেখা দেয়। TIA-এর ক্ষেত্রে এই লক্ষণগুলো ক্ষণস্থায়ী হয়, কিন্তু এটি একটি আসন্ন বড় স্ট্রোকের জোরালো ইঙ্গিত।
৩. কথা জড়িয়ে যাওয়া বা কথা বুঝতে অসুবিধা (Slurred Speech or Difficulty Understanding)
বিস্তারিত বিবরণ: কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে কথা বলতে গিয়ে জিভ জড়িয়ে আসা, পরিচিত শব্দ ভুলে যাওয়া, অসংলগ্ন কথা বলা বা অন্যের সহজ কথাও বুঝতে অসুবিধা হওয়া মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালনের সমস্যার লক্ষণ। ব্যক্তি হয়তো বোঝাতে চাইছেন এক, কিন্তু বলছেন আরেক।
কেন এটি সতর্ক সংকেত: মস্তিষ্কের যে অংশগুলো ভাষা এবং কথা বলার প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে (যেমন ব্রোকা'স ও ওয়ারনিক'স এরিয়া), সেখানে অক্সিজেন বা রক্তের অভাব হলে এই সমস্যাগুলো দেখা দেয়।
৪. চোখে ঝাপসা দেখা বা হঠাৎ দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া (Sudden Blurred Vision or Vision Loss)
বিস্তারিত বিবরণ: হঠাৎ করে এক বা উভয় চোখে ঝাপসা দেখা, দুটি করে দেখা (ডাবল ভিশন) অথবা কোনো এক দিকের দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়া স্ট্রোকের একটি লক্ষণ। এটি চোখের সমস্যা নয়, বরং মস্তিষ্কের সেই অংশে রক্ত প্রবাহের সমস্যা যা দৃষ্টিশক্তি নিয়ন্ত্রণ করে।
কেন এটি সতর্ক সংকেত: চোখের সঙ্গে সংযুক্ত মস্তিষ্কের অপটিক্যাল লোবে রক্ত সরবরাহ ব্যাহত হলে এই ধরনের দৃষ্টির সমস্যা তৈরি হয়।
৫. তীব্র ও আকস্মিক মাথাব্যথা এবং মানসিক বিভ্রান্তি (Severe Sudden Headache and Confusion)
বিস্তারিত বিবরণ: যদি জীবনে কখনো অনুভব করেননি এমন তীব্র মাথাব্যথা হঠাৎ করে শুরু হয়, যাকে প্রায়ই "বজ্রপাতের মতো মাথাব্যথা" (Thunderclap Headache) বলা হয়, তবে এটি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোকের (Hemorrhagic Stroke) লক্ষণ হতে পারে। এর সাথে হঠাৎ করে বিভ্রান্তি, স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া, চেনা জায়গা বা মানুষকে চিনতে না পারা বা মেজাজের আকস্মিক পরিবর্তনও দেখা যেতে পারে।
কেন এটি সতর্ক সংকেত: মস্তিষ্কের রক্তনালী ছিঁড়ে গেলে এই ধরনের অসহ্য মাথাব্যথা হয়। অন্যদিকে, মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব হলে মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতা এবং মানসিক স্থিতিও প্রভাবিত হয়।
স্ট্রোকের লক্ষণগুলো দ্রুত শনাক্ত করতে বিশ্বজুড়ে F.A.S.T. পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়:
F (Face Drooping): মুখ কি একপাশে ঝুলে পড়েছে? ব্যক্তিকে হাসতে বলুন।
A (Arm Weakness): একটি হাত কি দুর্বল বা অবশ? ব্যক্তিকে উভয় হাত তুলতে বলুন।
S (Speech Difficulty): কথা কি জড়িয়ে যাচ্ছে? ব্যক্তিকে একটি সহজ বাক্য বলতে বলুন।
T (Time to call emergency): উপরের যেকোনো একটি লক্ষণ দেখা দিলে সময় নষ্ট না করে দ্রুত হাসপাতালে বা অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করুন।
এই লক্ষণগুলোর কোনো একটিও যদি ক্ষণিকের জন্য দেখা দেয়, তবে তাকে অবহেলা না করে অবশ্যই একজন নিউরোলজিস্ট বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। একটি মিনি-স্ট্রোক বা TIA হওয়ার পর বড় স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
ঝুঁকি এড়াতে করণীয়:
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: লবণ ও চর্বিযুক্ত খাবার কমিয়ে ফল ও শাকসবজি বেশি করে খান।
নিয়মিত ব্যায়াম: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা বা হালকা ব্যায়াম করুন।
ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ: ধূমপান রক্তনালীকে শক্ত ও সংকুচিত করে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
ওজন নিয়ন্ত্রণ: শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমানো স্ট্রোক প্রতিরোধের জন্য জরুরি।
তথ্যসূত্র:
World Health Organization (WHO)
American Stroke Association (ASA)
Centers for Disease Control and Prevention (CDC)
National Health Service (NHS), UK