এম. এমরান পাটোয়ারী, ফেনী: [২] আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফেনীর তিনটি আসনের মনোনয়নপত্র বৈধ হওয়া প্রার্থীদের মধ্যে আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত তিন প্রার্থী। তবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অন্য শরীকদের মাঝে আসন ভাগাভাগীসহ নানা কারণে আলোচনা রয়েছেন আরও ৫ প্রার্থী। ২১ জনের মধ্যে অন্য ১৩ জনেরই রাজনীতিতে তেমন পরিচিতি নেই। বেশির ভাগ সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীকে ভোটাররা চেনেন না।
[৩] সচেতন ভোটারদের অনেকেই এমন মন্তব্য করেন। কারণ হিসেবে অনেকেই মনে করছেন, যারা বিভিন্ন দলের প্রার্থী হয়েছেন, তারা বেশিভাগই জনসম্পৃক্ত নয়। অনেকেই নিজ এলাকায় থাকেনও না। একারণে এসব প্রার্থীদের তাদের নির্বাচনী এলাকার সাধারণ মানুষজন চেনেই না।
[৪] সরকার দলীয় সূত্র জানান, বিগত সময়ে রেকর্ড সংখ্যক উন্নয়নের কারণে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীরাই বিজয়ী হবেন তা অনেকটা নিশ্চিত ধারণা করা হচ্ছে। তবে অপর একটি সূত্র জানান, মহাজোটের আসন ভাগাভাগীতে যদি ছাড় দেওয়া হয় সে হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন জাতীয় পার্টি ও জাসদ’র প্রার্থীরা।
[৫] সূত্র জানায়, বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফেনী—১ আসনটি মহাজোটের শরীক জাসদ (ইনু) সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতারকে ছাড় দেওয়া হয়। এর আগের নির্বাচনেও তিনি এ আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন। তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাথে বরাবরই তার দূরত্ব চলে আসছে। এ আসনে তৃণমুল আওয়ামী লীগের নেতা—কর্মীরা নৌকার প্রার্থী দাবি করে আসছে দীর্ঘদিন যাবত। অবশেষে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। নৌকার প্রার্থী পেয়ে তৃণমুল পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতা—কর্মীরা তাঁকে বিজয়ী করতে কোমর বেঁধে নেমেছেন। ইতোমধ্যে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে বর্ধিতসভা করে নৌকার প্রার্থীকে বিজয়ী করে ঘরে ফেরার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন অনুষ্ঠিত বর্ধিত সভায়।
[৬] এছাড়াও ফেনী—৩ নির্বাচনী আসনে বিগত সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য লে.জে.(অব) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী হাজী রহিম উল্যাহ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে দুটি নির্বাচনেই প্রাথমিকভাবে আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য বায়রা’র সভাপতি আবুল বাশারকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিলো। পরবর্তীতে জাতীয় পার্টির সাথে আসন সমঝোতায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে প্রত্যাহার করে জাতীয় পার্টিকে আসনটি ছাড় দেওয়া হয়েছিলো। প্রার্থী আবুল বাশারও দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে তখন প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নেন। এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য বায়রা’র সভাপতি আবুল বাশার। তিনি মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচনী এলাকার উপজেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় অংশ নিচ্ছেন।
[৭] এসব সভায় নেতা—কর্মীদের দাবি উঠেছে বিগত নির্বাচনগুলোতে জাতীয় পার্টিকে ছাড় দেওয়া হলে সংসদ সদস্যরা নির্বাচনী এলাকায় তেমন ছিলেন না এবং উন্নয়নেও আশানুরুপ ভূমিকা রাখেননি। তাই এবার আর ছাড় দিতে রাজি নয় নেতা—কর্মীরা। তাঁরা নৌকার মনোনীত প্রার্থীকে যে কোন মূল্যে বিজয়ী করে বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। দাগনভূঞা উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা মোজাম্মেল হক মিন্টু বলেন, দীর্ঘদিন পর নৌকার প্রার্থী পেয়ে তৃণমুল নেতা—কর্মীরা বেশ খুশি। আর কোন ছাড় দিতে রাজি নয় নেতা—কর্মীরা। আমরা প্রত্যশা করি শেষ পর্যন্ত যেন নৌকার প্রার্থী আবুল বাশারকে নির্বাচনে রাখা হয়।
[৮] নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন ফেনী—১ আসনে জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী শাহরিয়ার ইকবাল, ফেনী—২ আসনে জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী খোন্দকার নজরুল ইসলাম ও ফেনী—৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী হাজি রহিম উল্যাহ। জাতীয় পার্টির নেতা—কর্মীদের দাবি শেষ পর্যন্ত যদি নির্বাচনী পরিবেশ গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু থাকে এবং জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা নির্বাচনে থাকে তাহলে জনগণের রায় জাপা প্রার্থীরাই বিজয়ী হবেন ইনশা আল্লাহ।
[৯] অপরদিকে স্থানীয় ২০/২৫ জন ভোটারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এবার নির্বাচনে অংশ নেওয়া ১৪ প্রার্থী ফেনীতে নতুন। তাদেরকে তেমন কেউ চেনেন না। তাদের অনেকেই আগে রাজনীতির মাঠে দেখা যায়নি নামও শোনা যায়নি। তাঁদের নেতা কর্মীদের কায্যর্ক্রম কখনই চোখে পড়েনি। তাদের অধিকাংশেরই স্থানীয় রাজনীতিতে পরিচিতি নেই।
[১০] হঠাৎ করে তাঁরা কেন নির্বাচনে আগ্রহী হলেন এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলেও অনেক প্রার্থীর কাছ থেকে সঠিক কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।
এর মধ্যে ফেনী—১ আসনে (পরশুরাম—ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া) আসনে মনোনয়নপত্র বৈধ হয় আওয়ামী লীগ প্রার্থী আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম, জাসদ প্রার্থী শিরীন আখতার, জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী শাহরিয়ার ইকবাল, জাকের পার্টি প্রার্থী রহিম উল্যাহ ভূইয়া, বাংলাদেশ ইসলামীক ফ্রন্ট প্রার্থী কাজী মো. নুরুল আলম, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তি জোট প্রার্থী মাহবুব মোর্শেদ মজুমদার, তৃণমূল বিএনপি প্রার্থী মো. শাহজাহান সাজু।
[১১] ফেনী—২ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী নিজাম উদ্দিন হাজারী, জাতীয় পার্টির প্রার্থী খন্দকার নজরুল ইসলাম, তৃণমূল বিএনপির আমজাদ হোসেন সবুজ, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তি জোটের মো. নুরুল ইসলাম ভূইয়া, জাকের পার্টির নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশ ইসলামীক ফ্রন্টের মাওলানা নুরুল ইসলাম, বাংলাদেশ কংগ্রেস মোহাম্মদ হোসেন, খেলাফত আন্দোলন আবুল হোসেন।
[১২] ফেনী—৩ (দাগনভূঞা ও সোনাগাজী) আসনে জাতীয় পাটির লে. জে. (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, আওয়ামী লীগের মো. আবুল বাশার, স্বতন্ত্র প্রার্থী ১ হাজী রহিম উল্যাহ, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি তবারক হোসেন, জাকের পার্টি আবুল হোসেন, ইসলামীক ফ্রন্ট বাংলাদেশ মো. আবু নাসির, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট নিজাম উদ্দিনের মনোনয়নপত্র বৈধ হয়।
[১৩] পর্যবেক্ষকদের মতে, আওয়ামীলীগ, জাতীয় পার্টি, জাসদ ছাড়া অন্য কোন সংগঠনের রাজনৈতিক কর্মকান্ড তেমন চোখে পড়েনি। নির্বাচনের সময় বিভিন্ন নাম ব্যবহার করে প্রার্থী হন অনেকে। এমন একাধিক প্রার্থীর সঙ্গে কথা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে ১শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষরসহ নানারকম আইনী জটিলতা থাকায় নির্বাচনে অংশ নিতে তারা নামস্বর্বস্ব নিবন্ধনপ্রাপ্ত দলের মনোনয়ন নেন। এসব দলের জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে উল্লেখ করার মতো তৎপরতা চোখে পড়েনি। হঠাৎ করে নির্বাচনকে ঘিরে তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তি জোট সহ বিভিন্ন দলের নাম শোনা যাচেছ।
[১৪] ফেনী—২ আসনের তৃণমূল বিএনপির আমজাদ হোসেন সবুজ বলেন, দীর্ঘদিন যুক্তর্রাষ্ট্র প্রবাসে থাকায় অনেক নতুন ভোটার নাও চিনতে পারেন। তবে প্রবাসে থাকলেও এলাকার উন্নয়নে কাজ করার চেষ্ঠা করেছি। বিজয়ের ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে তিনি ভবিষ্যতে ফেনীর উন্নয়নে কাজ করবেন বলে জানান। ফেনী—৩ আসনের প্রার্থী জাকের পার্টি আবুল হোসেন এখনো প্রচারনা শুরু না করায় ভোটাররা চিনেন না বলে জানান।
[১৫] নতুন ভোটার শাহরিয়ার আহমেদ বলেন, জীবনের প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পেলেও মনে কোনো উৎসাহ নেই। যাঁরা এমপি প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অনেককেই চিনি না, জানি না। ফেনী—২ এ শহরের ভোটার হাফিজ আল আসাদ বলেন, এবার আমাদের আসনে ১০ জন প্রার্থীর মধ্যে অনেককেই আমি চিনি না। শুধু আমি নয়,ফেনী শহরের বেশির ভাগ সাধারণ ভোটার তাঁদের চেনেন না।
[১৬] এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, কয়েকটি বড় রাজনৈতিক দল নির্বাচনে আসেনি। সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকলে নামসর্বস্ব পার্টিগুলোর প্রার্থীর আবির্ভাব ঘটেছে। এবারের নির্বাচনে অপরিচিত কয়েকটি দল প্রার্থী দিয়েছে। যারা প্রার্থী হয়েছে, তাদের অধিকাংশই জেলার অপরিচিত মুখ। এসব দল বা প্রার্থী জনগণের মাঝে কোনো সাড়া জাগাতে পারবে না। সম্পাদনা: ইস্রাফিল ফকির
প্রতিনিধি/আইএফ