মহসিন কবির: লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যকার বৈঠকের পর বিএনপি নির্বাচন নিয়ে অনেকটা নিশ্চুপ।তারা ধরেই নিছে আগামী ফেব্রুযারি মাসে নির্বাচন হবে। সে লক্ষ্যে দলের প্রস্তুতিও নিচ্ছে দলটি। এদিকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সিইসির বৈঠকের পর যদিও খিছু জানা যায়নি, তারপরও ধারণা করা হচ্ছে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
লন্ডনের বৈঠকের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বার্তা পাননি, পেলে বুঝতে পারবেন। এর মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তিনি একান্তে কথা বলেছেন। আবার সামনে অপেক্ষমাণ জুলাই সনদ, যার সঙ্গে নির্বাচনের অনুষ্ঠানের সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। ফলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে শিগগিরই একটি কর্মপরিকল্পনা (রোডম্যাপ) ঘোষণা করতে পারে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে আবারও সরব হয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান বৃহস্পতিবার দলের এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অবশ্যই আমরা প্রয়োজনীয় সংস্কার চাই। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আমরা স্থানীয় সরকারের নির্বাচন চাই।’ একই অবস্থান জানিয়ে আসছে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি)। তাই ইসি কি জাতীয় নির্বাচন নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ দেবে তা নিয়েও চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা।
লন্ডনের বৈঠকের পর বিএনপির পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, যেহেতু ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোট করার কথা সরকার বলেছে, তাই এখনই রোডম্যাপ ঘোষণা করা উচিত। নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের ধারণা, যেহেতু বিশেষ পরিস্থিতিতে এবার নির্বাচন, তাই জুলাই সনদের ওপর সবকিছু নির্ভর করছে। ইসিও দেখতে চায়, জুলাই সনদ অনুসারে কী কী সংস্কার করতে হবে এবং কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে। এসব দেখার পর সেভাবেই রোডম্যাপ ঘোষণা করবে। চলতি সপ্তাহে শুরু হচ্ছে জুলাই মাস। তাই খুব শিগগিরই নির্বাচনী রোডম্যাপ বা ইসির কর্মপরিকল্পনা পাওয়া যাবে- এমন ধারণা করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এই বাস্তবতায় বৃহস্পতিবার বিকালে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন। প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় দুজনের মধ্যে ওয়ান টু ওয়ান বৈঠক হয়েছে। সেই বৈঠকের পর সরকার বা নির্বাচন কমিশন কোনো পক্ষই কিছু বলেনি। ফলে বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে তা জানা সম্ভব হয়নি। তবে নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করতে যাবেন সেখানে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হওয়াটাই স্বাভাবিক। হয়েছেও তাই। এই বৈঠকে সিইসি হয়তো তাদের কর্মপরিকল্পনা প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করেছেন। আবার প্রধান উপদেষ্টাও ইসির প্রস্তুতি জানতে চাইতে পারেন বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাই বৃহস্পতিবারের বৈঠকটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই ধারণা করছেন, সিইসি সরকারের মনোভাব বুঝে এরপর হয়তো কমিশন বৈঠকে আলাপ আলোচনা করে একটা রোডম্যাপ বা কর্মপরিকল্পনা জাতির সামনে তুলে ধরতে পারেন। চলতি সপ্তাহে কমিশন বৈঠক হলে এই বৈঠকের ফলাফল বোঝা যেতে পারে বলেও জানা গেছে। ইসির পক্ষ থেকে ঘোষণা না দিলেও তাদের তৎপরতা দেখেও রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের হাওয়া বোঝার চেষ্টা করবে।
এ বিষয়ে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. মো. আব্দুল আলীম গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। সেখানে নির্বাচন নিয়েই আলোচনা হওয়া উচিত; তাই হয়তো হয়েছে। এই সাক্ষাৎকারে কমিশন তাদের কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরতে পারেন। সরকারের পক্ষ থেকেও ইসির প্রস্তুতি জানতে চাওয়া হতে পারে।
যেহেতু একান্ত বৈঠক হয়েছে, তাই কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে সেটা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও ধারণা করা যায়, নির্বাচন নিয়েই আলোচনা হয়েছে। ইসি চাইলে কালকেও রোডম্যপ ঘোষণা করতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে ইসি তাদের কাজ শুরু করছে। ভোটার তালিকা প্রস্তুত, সীমানা পুনর্নির্ধারণ, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, কেন্দ্র প্রস্তুতি এবং নির্বাচনী সরঞ্জাম কেনাকাটার কাজও হাতে নিয়েছে। তাই ধরেই নেওয়া যায়, নির্বাচন প্রস্তুতি পুরোদমে শুরু করেছে ইসি।’
প্রধান উপদেষ্টা ও সিইসির বৃহস্পতিবারের বৈঠকের বিষয়ে ইসির কোনো কোনো কর্মকর্তা ধারণা করছেন নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি সাবেক দুই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের গ্রেপ্তার নিয়ে কমিশনের ভেতরে এক ধরনের অস্বস্তি বিরাজ করছে। এই বিষয়ও তুলে ধরতে পারেন সিইসি।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর সিইসি এএমএম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বে পুনর্গঠিত কমিশন শুরু থেকেই নির্বাচন নিয়ে কাজ করছে। ইসির প্রধান এজেন্ডা এখন নির্বাচন। তাই ইসির সব দাপ্তরিক কার্যক্রমও নির্বাচনকেন্দ্রিক বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির সচিব। জাতীয় নির্বাচনের আগে হালনাগাদ পূর্ণাঙ্গ ভোটার তালিকা, ভোটকেন্দ্রের প্রস্তুতি, নির্বাচনী সামগ্রী কেনাকাটা, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, সীমানা পুনর্নির্ধারণ এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মতো বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে ইসি। এর মধ্যে অধিকাংশ কাজই চলমান, কোনটি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের যখন বৈঠক চলছিল তখন কয়েকটি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ। সেখানে তিনি জানান, আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে নির্বাচনসংক্রান্ত মালামাল ক্রয়সম্পন্ন করবে ইসি। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনসামগ্রী ক্রয় করার ব্যাপারে আমরা টেন্ডার আহ্বান করেছি। একটি টেন্ডার রি-টেন্ডার হবে।
আমরা চেষ্টা করছি সেপ্টেম্বরের মধ্যে নির্বাচনসংক্রান্ত মালামাল ক্রয়সম্পন্ন করতে।’ নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের সব দাপ্তরিক আলোচনাই এখন নির্বাচন প্রস্তুতি সম্পর্কিত। প্রস্তুতি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটাকে কোনো একটি টাইমলাইনে ফিট করলে ভুল হবে।’
ইসি সূত্রে জানা গেছে, ভোটের প্রস্তুতি হিসেবে ইসিতে যেসব কাজ চলমান রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ভোটার তালিকা আইন সংশোধন করার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তাতে নির্বাচনের আগে কোন সময় পর্যন্ত ভোটার তালিকায় ভোটারের নাম অন্তর্ভুক্ত করা যাবে, তা ‘যৌক্তিক বিবেচনায়’ নির্বাচন কমিশন ঠিক করবে, এমন বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ইসি সচিব জানান, যৌক্তিক বিবেচনাটা কীসের ভিত্তিতে হবে, এটা কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে। তবে স্বাভাবিকভাবে নির্বাচন কবে হবে, এর আগে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা- এ বিষয়গুলো বিবেচনা করে কাট অব পয়েন্ট (নির্বাচনের আগে ভোটার হওয়ার শেষ সময়) ঠিক করা হবে।
সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজটিও করছে ইসি। এখন পর্যন্ত ৭৬টি আসনের বিষয়ে ইসি আবেদন পেয়েছে। এর মধ্যে একই আসনে বর্তমান সীমানা রাখার পক্ষে-বিপক্ষে একাধিক আবেদনও আছে। এগুলো পর্যালোচনা করে জনসংখ্যা, ভৌগোলিক অবস্থান, প্রশাসনিক সীমানা এগুলো বিবেচনায় নিয়ে যেগুলো যৌক্তিক মনে হবে, ইসি সেটাই করবে। এ ছাড়া রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের জন্য ১৪৭টি আবেদন পেয়েছে ইসি। আবেদনগুলো এখন যাচাই-বাছাই চলছে।