এল আর বাদল : ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকার ভোটার সোনিয়া আক্তার। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তিনি যখন যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজে ভোটকেন্দ্রে ঢোকেন, তখন ভোটকক্ষ থেকে জানানো হয় তার ভোট দেওয়া হয়ে গেছে।
কিন্তু তিনি তার হাতের আঙুলে কালি না থাকাসহ নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে তিনি ভোট দেননি। তবে ব্যর্থ হয়ে ভোট দেওয়ার সুযোগ না পেয়ে কেন্দ্র থেকে বাসায় ফিরে আসতে হয় তাকে। -------- বিবিসি বাংলা
গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে নির্বাচনে জালভোট, আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তির মতো নানা অনিয়ম-কারচুপির ঘটনা-অভিযোগ সংবাদ মাধ্যমে উঠে এসেছে। ফলে মিজ আক্তারের মতো অনেককে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট না দিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে।
তবে কেন্দ্রে গিয়ে যদি কোনো ভোটার দেখেন যে তার ভোট অন্য কেউ দিয়ে গেছে, তাহলে তার প্রতিকারও রয়েছে বাংলাদেশের নির্বাচনী আইনে।
এক্ষেত্রে ভোটার যদি নিজের পরিচয় দেন এবং তিনি ভোট দেননি এই বিষয়টি ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে বোঝাতে সক্ষম হন, তাহলে তিনি ভোট দেওয়ার সুযোগ পান। আইনের ভাষায় এই ভোটটিকে বলা হয় 'টেন্ডার্ড ভোট'।
বাংলাদেশের নির্বাচনী আইনে এই টেন্ডার্ড ভোটের বিধান থাকলেও সেটি সম্পর্কে ভোটারদের যেমন খুব একটা ধারণা নেই, তেমনি এই ভোটের রীতিও চালু নেই।
নির্বাচন বিশ্লেষক ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলীম বিবিসি বাংলাকে বলেন, "কোনো ভোটার যদি দেখেন তার ভোট অন্য কেউ দিয়ে গেছে, তখন তিনি যে ভোট দেননি সেটি নিশ্চিত করতে পারলে তাকে ভোট দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হলে সেই ভোটটিকে বলে টেন্ডার্ড ভোট"।
কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- টেন্ডার্ড ভোটের মাধ্যমে ভোটার ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলেও সেটিকে রাখা হয় না ব্যালট বাক্সে, কিংবা গণনাও করা হয় না। যে কারণে এই ভোটটিকে একদিকে 'সান্ত্বনামূলক', অন্যদিকে 'প্রতারণামূলক' ভোট বলেও আখ্যা দিয়েছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা।
টেন্ডার্ড ভোট দেওয়ার নিয়ম কী?
বাংলাদেশের নির্বাচনী আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিওতেই এই টেন্ডার্ড ভোটের বিধান যুক্ত রয়েছে।
আরপিওর ৩২ এর (১) অনুচ্ছেদে বলা আছে–– 'যদি কোনো ব্যক্তি ব্যালট পেপারের জন্য আবেদন করিয়া অবগত হন যে, অন্য কোনো ব্যক্তি ইতঃপূর্বে নিজেকে উক্ত ভোটার হিসাবে ঘোষণা করিয়া আবেদনকারীর নামে ভোট প্রদান করিয়াছেন, তাহা হইলে তিনি অন্য যে কোনো ভোটারের ন্যায় একই পদ্ধতিতে এই অনুচ্ছেদের বিধান সাপেক্ষে, একটি ব্যালট পেপার (অতঃপর "টেন্ডার্ড ব্যালট পেপার" বলিয়া উল্লিখিত) পাইবার অধিকারী হইবেন"।
আরপিওতে বলা আছে- টেন্ডার্ড ব্যালট পেপার পাওয়ার পর ভোটার ওই ব্যালটে ভোট দেবেন। কিন্তু ভোট দেওয়ার পর ভোটার ওই ব্যালট পেপারটি নির্দিষ্ট ব্যালট বাক্সে না ফেলে সেটি প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে জমা দেবেন।
প্রিসাইডিং অফিসার ওই ব্যালটটিকে আলাদা একটি খামে রেখে সেখানে ওই ভোটারের নাম ও ভোটার নম্বর লিপিবদ্ধ করে রাখবেন।
শুধু বাংলাদেশের নয়, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্বাচনের ক্ষেত্রে টেন্ডার্ড ভোটের বিধান চালু রয়েছে বলেও জানান নির্বাচন বিশ্লেষকরা।
নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী বিবিসি বাংলাকে বলেন, "কোনো ভোটার ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখে তার ভোটটা অন্য কেউ দিয়ে চলে গেছে তখন স্বাভাবিকভাবে তিনি প্রতিবাদ কিংবা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তখন তাকে সান্ত্বনাস্বরুপ এই ভোটটি দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়"।
তার মতে, এমনসব পরিস্থিতিতে ভোটকেন্দ্রে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকেই তখন আইনপ্রণেতারা এই টেন্ডার্ড ভোটের বিধান চালু করেছিল। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ভোটারকে সান্ত্বনা দেওয়া।
প্রতারণামূলক ভোট?
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের নির্বাচনগুলোয় নানা অনিয়মের ঘটনা ঘটলেও নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, টেন্ডার্ড ভোট নিয়ে প্রচারণা না থাকার কারণে অনেক ভোটারই এই ভোট সম্পর্কে জানেন না।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাক্ষর করে ভোট দেওয়ার পরও টেন্ডার্ড ভোট গণনা করা হয় না, এর মাধ্যমে ভোটারদের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা করা হয়।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলীম বিবিসি বাংলাকে বলেন, "এই ভোটটা কখনই গণনা করা হয় না। এটা একদিক থেকে চিন্তা করলে ভোটারের সঙ্গে প্রতারণা। ভোটার জানতে পারছেন তার ভোট নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু তিনি জানতে পারছেন না তার ভোট গণনা করা হচ্ছে কি না। যারা অসচেতন তারা বুঝতে পারবেন না গণনা করা হচ্ছে কি হচ্ছে না। কাজেই ওনাকে একভাবে প্রতারিত করা হচ্ছে"।
যে ভোট গণনাই করা হয় না, সেই ভোটের বিধান কেন আইনে যুক্ত করা হয়েছে এই প্রশ্নও সামনে আসছে। জবাবে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি এই ভোট গণনায় ধরা হয় তাহলে এটি নিয়ে বড় ধরনের সংকটও তৈরি হতে পারে।
২০১৮ সালে বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশে নানা প্রশ্ন ছিল। ওই নির্বাচনে সারাদেশের ১৯৭টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছিল।
নির্বাচন বিশ্লেষক জেসমিন টুলী বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, "ধরেন একটা কেন্দ্রে শতভাগ ভোটার ভোট দিয়েছে। অন্যদিকে কয়েকজন টেন্ডার ভোটও দিয়েছে। ওই ভোটটিকে যদি তখন গণনা করা হয় তখন দেখা যাবে যে ভোটের হার শতভাগের বেশি হয়েছে। সেটি হলে আইন অনুযায়ী কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না। যে কারণে টেন্ডার ভোটটিকে গণনা করা হয় না"।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি কোনো নির্বাচনে দুইজন প্রার্থীর ভোট সংখ্যা সমান হয় তখন প্রার্থীদের অনুরোধে এই টেন্ডার্ড ভোট গণনার বিধানও রয়েছে। সেটি শুধু আদালতের নির্দেশেই গণনা করা হয় বলেও জানান তারা।
১০০ টাকা মুচলেকায় আপত্তি ভোট
টেন্ডার্ড ভোটের মতোই আরেক ধরনের ভোট রয়েছে যেটিকে বলা হয় 'আপত্তিকৃত ভোট'।
এক্ষেত্রে কোনো ভোটার কেন্দ্রে প্রবেশ করে ব্যালট পেপার নেওয়ার সময় কোনো প্রার্থী বা তার পোলিং এজেন্ট ওই ভোটারকে চ্যালেঞ্জ করেন যে- সেই ভোটার একই কেন্দ্রে বা অন্য কোনো কেন্দ্রে আগেই ভোট দিয়েছেন, তাহলে ভোটারও আপত্তি তুলতে পারেন।
আরপিও অনুযায়ী- ভোটার যদি চ্যালেঞ্জ করেন যে তিনি এই কেন্দ্রে বা অন্য কোনো কেন্দ্রে ভোট দেননি, সেক্ষেত্রে প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে ১০০ টাকা মুচলেকা দিয়ে ব্যালট সংগ্রহ করে ভোট দিতে পারবেন। এই ধরনের ভোটিং পদ্ধতিকে বলা হয় আপত্তিকৃত ভোট।
আপত্তিকৃত ভোট দেওয়ার জন্য প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ওই ভোটারের নাম-ঠিকানা একটি আলাদা তালিকায় যুক্ত করবেন। একই সাথে ব্যালট পেপারের মুড়িপত্রে ওই ভোটারের স্বাক্ষর বা টিপসই গ্রহণ করবেন।
নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম বলছিলেন, এই ভোটটি দেওয়ার জন্য ভোটারকেই মুচলেকা বা জরিমানার টাকা দিতে হবে। তারপরই প্রিসাইডিং অফিসার তাকে ভোট দেওয়ার সুযোগ দেবেন।
নির্বাচন কমিশন বলছে, আপত্তিকৃত ভোট দেওয়ার পর সেই ভোট টেন্ডার ভোটের মতো আলাদা খামে রাখবেন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা।
তবে, ভোট গণনার সময় এই আপত্তিকৃত ভোট গণনা করা হবে এবং গণনা শেষে আবার সেগুলোকে আলাদা খামে রাখবেন প্রিসাইডিং অফিসার।
টেন্ডার্ড ভোট আর আপত্তিকৃত ভোটের মূল পার্থক্য হলো টেন্ডার ভোট গণনা না হলেও আপত্তি ভোট গণনা করা হয় এবং সেটি কোনো প্রার্থীর জয় পরাজয়ে ভূমিকা রাখতে পারে।
অন্যদিকে টেন্ডার্ড ভোটের ক্ষেত্রে ভোটারকে কোনো ধরনের মুচলেকা দিতে না হলেও আপত্তি ভোটের ক্ষেত্রে ভোটারকেই মুচলেকা দিয়ে ভোট দিতে হয়।