অয়েলপ্রাইসডটকম অবলম্বনে: ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর প্রেক্ষাপটে উপসাগরীয় অঞ্চল দিয়ে জ্বালানিসহ অন্যান্য পণ্য পরিবহন এখন আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় অঞ্চলটি দিয়ে পণ্য পরিবহনের জন্য নতুন বুকিং নেয়া এখন প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন জাহাজ ও ট্যাংকার মালিকরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বুকিং নেয়া হলেও এর জন্য হাঁকা হচ্ছে উচ্চমূল্য। যদিও জ্বালানি পণ্যের চাহিদা পূরণের জন্য অঞ্চলটির ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের দেশ। এ অবস্থায় বৈশ্বিক জ্বালানি পণ্যের বাজারদর আবার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার পাশাপাশি পণ্যটির সরবরাহ চেইন ধসে পড়ারও জোর ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
চলমান উত্তেজনার মধ্যে এখনো হরমুজ প্রণালি দিয়ে জাহাজ চলাচল বন্ধের আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা আসেনি। যদিও এর আগেই এ বিষয়ে জোরদার ও সতর্ক অবস্থান নিয়েছে বৈশ্বিক ট্যাংকার অপারেটর ও শিপিং কর্তৃপক্ষগুলো। নানা বিবৃতি, পথ পরিবর্তনের ঘোষণা ও ঝুঁকি পুনর্মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে এসব অপারেটর ও কর্তৃপক্ষ এখন পণ্য পরিবহনের সময়, বীমা প্রিমিয়াম, সর্বোপরি জ্বালানি পণ্যের বাজারে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ ভাবনার ওপর প্রভাব ফেলছে।
দুই দেশের সংঘাত শুরুর প্রেক্ষাপটে চলতি সপ্তাহেই জ্বালানি তেলের দাম দিনে এক ধাক্কায় ৭ শতাংশের বেশি বাড়তে দেখা গেছে। যদিও পরে বাজার কিছুটা সংশোধন হয়ে আসে, তবু পণ্যটির মূল্য পরিস্থিতি এখনো অনেকটাই উচ্চমাত্রায় অস্থিতিশীল রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রয়টার্সে সোমবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, গত শুক্রবারের পর থেকে ওইদিন পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্য থেকে এশিয়ার অন্যান্য দেশে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিবহনের জন্য বড় আয়তনের ট্যাংকার বুকিংয়ে বড় ধরনের ধস নেমেছে। যদিও এ সময় পরিবহন ভাড়া বেড়েছে ২০ শতাংশেরও বেশি। ট্যাংকার মালিকদের অনেকেই পণ্য পরিবহনের বুকিং নেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করছেন। আর্থিক তথ্যসেবা প্রতিষ্ঠান এলএসইজির বিশ্লেষকদের এক নোটে উঠে এসেছে, উপসাগরীয় অঞ্চলে পণ্য পরিবহনের জন্য কিছু জাহাজ রয়েছে ঠিকই, কিন্তু এগুলো ভাড়া করার জন্য চুক্তি সম্পাদন এক প্রকার বন্ধ হয়ে গেছে।
অয়েলপ্রাইসডটকমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ছোট ছোট জাহাজের মালিকরাও এখন নৌযান ভাড়া দেয়া থেকে বিরত থাকছেন। ঝুঁকিসংক্রান্ত শর্তগুলো সমন্বয় না করা পর্যন্ত উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে পণ্য রফতানির জন্য কোনো জাহাজ ভাড়া করা যাচ্ছে না। অপরিশোধিতের মতো পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রেও ট্যাংকারের ভাড়া ব্যাপক মাত্রায় বাড়ছে। একসময় এ ধরনের জাহাজগুলোর ক্ষেত্রে গড়ে প্রতি যাত্রায় ভাড়ার পরিমাণ পড়ত ৩৩-৩৫ লাখ ডলার। আর ফ্রেইট ব্রোকাররা এখন ভাড়া হাঁকছেন গড়ে ৪৫ লাখ ডলারের কাছাকাছি।
এ পরিবর্তনের কেন্দ্রে রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম জ্বালানি তেল পরিবাহী কোম্পানি ফ্রন্টলাইন। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী লার্স বারস্টাড ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে জানিয়েছেন যে ফ্রন্টলাইন এখন মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় অঞ্চলে যাত্রার জন্য নতুন কোনো বুকিং নেয়া একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন উপসাগরীয় অঞ্চল দিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো নতুন চুক্তি করছি না। আর এ অঞ্চলে এখন যেসব জাহাজ অবস্থান করছে, সেগুলো এ অঞ্চল ত্যাগ করবে কড়া নৌ-প্রহরায়।’
তার ভাষ্যমতে, এ ব্যবসা এখন আরো ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে। আর নিরাপত্তার একটা মূল্য তো অবশ্যই দিতে হয়।
ব্লুমবার্গে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, অন্যান্য প্রধান ট্যাংকার কোম্পানিও এখন উপসাগরীয় অঞ্চলের চুক্তি বাতিল করছে। ইরান ও ইসরায়েলের সংঘাত আরো তীব্রতর হয়ে ওঠার আশঙ্কা থেকে এমন পদক্ষেপ নিচ্ছে কোম্পানিগুলো। ফলে গ্রাহক ও চার্টারারদের জন্য ট্যাংকারের প্রাপ্যতা সংকুচিত হয়ে এসেছে। এমন প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে জ্বালানি মূল্য নিয়ে বাণিজ্য খাতে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বীমার বাজারেও এখন এ পরিবহন সংকোচনের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। উপসাগরীয় অঞ্চলের জলপথ দিয়ে চলাচলকারী প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের জন্য এখন যুদ্ধঝুঁকি বীমা বাবদ অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে ৩ থেকে ৮ ডলার। এতে পরিবহন খরচও এখন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়ে চলেছে। ফলে বদলে যাচ্ছে বৈশ্বিক জ্বালানি তেল বাণিজ্যের অর্থনীতি। ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠছে পণ্যটির প্রাইসিং বা মূল্য নির্ধারণী মডেল।
বর্তমানে এ অঞ্চল দিয়ে নৌযান পরিবহনে বিভিন্ন দেশের সরকারি কর্তৃপক্ষ থেকেও নেয়া হচ্ছে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। গ্রিসের নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় দেশটির পতাকাবাহী জাহাজগুলো এডেন উপসাগর বা হরমুজ প্রণালির মতো উচ্চঝুঁকির অঞ্চলে প্রবেশ করলে তা বিস্তারিতভাবে জানানোর নির্দেশনা দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের মেরিটাইম ট্রেড অপারেশন্স পরামর্শ দিয়েছে, যাতে ডেকে কর্মী সংখ্যা কমিয়ে আনা হয় এবং কঠোর রিপোর্টিং প্রটোকল মেনে চলা হয়। সমুদ্র নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অঞ্চলে নৌ-চলাচলে শুধু প্রচলিত নয়, অপ্রচলিত হুমকিও বাড়ছে।
সম্প্রতি সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম সিকিউরিটির (সিআইএমএসইসি) জন্য করা এক বিশ্লেষণে মরিশাসভিত্তিক রিজিওনাল মেরিটাইম ইনফরমেশন ফিউশন সেন্টারের (আরএমআইএফসি) ক্যাপ্টেন হারিফিদি এ. অ্যালেক্স রালাইয়ারিভনি উল্লেখ করেছেন, ভারত মহাসাগরের পশ্চিমাঞ্চলীয় নৌপথ এখন গোপন নজরদারি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইলেকট্রনিক জ্যামিংয়ের কৌশলের মতো নানামুখী হুমকির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ ক্রমবর্ধমান হুমকি মোকাবেলায় আরো বিস্তৃত ও জোরদার পদক্ষেপ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, জটিল নিরাপত্তা ঝুঁকিজনিত পরিস্থিতিতে জাহাজ কোম্পানিগুলোই প্রথম প্রতিক্রিয়া দেখায়।
এছাড়া জিপিএস স্পুফিং ও নেভিগেশনে হস্তক্ষেপের সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনাকে এলএসইজির বিশ্লেষকরা মিসাইলের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এ ধরনের ‘ইলেকট্রনিক অ্যাম্বুশের’ ঘটনা শিপিং ব্যবসায়ী ও বীমা কোম্পানিগুলোর উদ্বেগকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে।
যুদ্ধের শুরুতে হঠাৎ বৃদ্ধির পর জ্বালানি তেলের বাজারদর এখন সংশোধন হয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। এতে প্রাথমিকভাবে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছিল তা প্রশমন হওয়ার ইঙ্গিত পাচ্ছেন বাজার পর্যবেক্ষকরা। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, এখনো জ্বালানি তেলবাহী কোনো ট্যাংকার সরাসরি লক্ষ্যবস্তু হয়নি এবং প্রধান শিপিং রুটগুলোও আপাতত খোলাও রয়েছে।
বর্তমানে যুদ্ধঝুঁকি ও মালিকদের মধ্যপ্রাচ্যগামী রুটে পণ্য পরিবহনে অনীহার কারণে উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে এশিয়ামুখী পরিশোধিত পেট্রোলিয়ামবাহী ট্যাংকারের ভাড়া প্রতি সফরে ৩৩-৩৫ লাখ থেকে বেড়ে প্রায় ৪৫ লাখ ডলারে পৌঁছেছে। এ অতিরিক্ত পরিবহন খরচ এখন পণ্যগুলোর সরবরাহ চেইনে সরাসরি প্রভাব ফেলছে। সংকুচিত হয়ে আসছে পরিশোধনাগারগুলোর মুনাফা মার্জিন। সর্বোপরি ভোক্তা পর্যায়ে আরো ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠছে জ্বালানি পণ্যের দাম।
এমনকি ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনও (আইএমও) মনে করছে, পরিস্থিতি এখন অত্যন্ত বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ হলো আন্তর্জাতিক নৌ-রুটে এখন আগের চেয়ে বেশি পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। জলদস্যুর ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও জাহাজগুলো লোহিত সাগর ও সুয়েজ খাল এড়িয়ে আফ্রিকার দক্ষিণ উপকূলঘেঁষে চলাচল করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যদি ইরান বা দেশটির মিত্ররা বিভিন্ন ট্যাংকার লক্ষ্য করে হামলা করতে শুরু করে, তাহলে এ খাত আরো মারাত্মক চাপে পড়ে যাবে। এরই মধ্যে মেডিটেরানিয়ান শিপিং কোম্পানি (এমএসসি) নামে একটি প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি ড্রোন হামলার হুমকি এড়াতে ভারত মহাসাগরের রুট থেকে তাদের কনটেইনার জাহাজগুলো সরিয়ে নিয়েছে। ফলে পণ্য পরিবহনের সময় ১০ থেকে ১৪ দিন বেড়ে গেছে। বাল্টিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম কাউন্সিলের (বিআইএমসিও) জ্যাকব লারসেন রয়টার্সকে জানিয়েছেন, পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জাহাজগুলো হয়তো পুরো উপসাগরীয় অঞ্চল এড়িয়ে চলতে পারে, ফলে পরিবহন সক্ষমতায় সংকট দেখা দিতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শিপিং কোম্পানিগুলোই সবসময় প্রথম প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে বহুল প্রচলিত নৌ-রুট থেকে অপারেটররা সরে যাওয়ার পাশাপাশি বীমা প্রিমিয়াম বেড়ে যায়। বড় পরিবর্তন দেখা যায় এইচপিসি ফ্রেইট সূচকে (নৌপথে পণ্য পরিবহন ও বন্দর সুবিধা নিয়ে হামবুর্গ পোর্ট কনসাল্টিং বা এইচপিসি প্রকাশিত সূচক)। এ ধরনের বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে আরো প্রকট হয়ে ওঠে গোটা খাতের কৌশলগত ঝুঁকিগুলো।
ভারত, চীন ও জ্বালানি পণ্য পরিশোধনে এগিয়ে থাকা অন্যান্য প্রধান দেশ এখন এ পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এখন সমুদ্রপথে অস্থিরতার নতুন কোনো সামান্যতম ইঙ্গিতও বাংকার প্রাইসকে (জ্বালানি মূল্যে ওঠানামাজনিত ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিপিং লাইন বা ক্যারিয়ারগুলোর আরোপিত অতিরিক্ত ফি) অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। অনুবাদ: বণিক বার্তা