মো. কামরুল ইসলাম, নবীনগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি: আজ ৬ সেপ্টেম্বর শনিবার, বিশ্বের সঙ্গীত জগতে ‘সুর সম্রাট’ খ্যাত ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র ৫৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৮৬২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবার নাম সুদু খাঁ এবং মায়ের নাম সুন্দরী বেগম। ১৯৭২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের মাইহারের মদিনা ভবনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
এই উপলক্ষে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে দোয়া মাহফিল, মিলাদ ও স্মৃতিচারণমূলক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
শৈশবে বড় ভাই ফকির (তাপস) আফতাব উদ্দিন খাঁ’র কাছে সঙ্গীতের হাতেখড়ি হয় আলাউদ্দিন খাঁ’র। কিশোর বয়সে সুরের সন্ধানে তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাত্রাদলের সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেন এবং জারি, সারি, বাউল, ভাটিয়ালী, কীর্তনসহ নানা ধারার গানের সঙ্গে পরিচিত হন। পরবর্তীতে তিনি সঙ্গীতে উচ্চতর দীক্ষা নিতে কলকাতায় পাড়ি জমান।
১৯১৮ সালের পর থেকে তিনি ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ব্রিটিশ সরকারের খেতাবসহ ভারতের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পান। এর মধ্যে রয়েছে—১৯৫২ সালে ভারতের সঙ্গীত একাডেমি পুরস্কার, ১৯৫৪ সালে একাডেমির ফেলোশিপ, ১৯৫৮ সালে ‘পদ্মভূষণ’, ১৯৬১ সালে বিশ্বভারতী কর্তৃক ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি, এবং ১৯৭১ সালে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কারগুলোর একটি ‘পদ্মবিভূষণ’।
বাঁশি, সেতার, ম্যান্ডোলিন, ব্যাঞ্জো, সানাই, তবলা, সরোদসহ অসংখ্য বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন তিনি। দীর্ঘ ত্রিশ বছরের সাধনায় ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁ, ননো গোপাল, অমৃত লাল দত্ত, ওস্তাদ আহম্মদ আলী খাঁ, ওস্তাদ ওয়াজির খাঁসহ বিখ্যাত গুরুশিষ্য পরম্পরার কাছ থেকে সঙ্গীতের নানা কলা-কৌশল শিখেছেন। তার কাছে শিক্ষা নিয়েছেন ছেলে আলী আকবর খাঁ, মেয়ে অন্নপূর্ণা দেবী, জামাতা পণ্ডিত রবি শঙ্করসহ অনেক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী।
শিবপুরে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র পরিবার থেকে জন্ম নিয়েছেন আরও বহু সঙ্গীত সাধক, যেমন—ফকির তাপস আফতাব উদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, সুরকার শেখ সাদী খান, রাজা হোসেন খান, সরোদ শিল্পী ওস্তাদ শাহাদাৎ হোসেন খান প্রমুখ।
বর্তমানে তার পৈত্রিক ভিটায় বসবাস করছেন ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁ’র বংশধরেরা। সেখানে রয়েছে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র নিজ হাতে তৈরি একটি মসজিদ (১৮৯৮ সালে নির্মিত), একটি পুকুর, বড় ভাই আফতাব উদ্দিন খাঁ’র মাজার, তার মা-বাবার কবর ও ঐতিহাসিক পৈত্রিক বাড়ি। অতীতের কিছু উদ্যোগে তার বাড়ি ও কবর সংস্কার এবং একটি মুরাল স্থাপন করা হলেও বড় প্রকল্প এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
আশির দশকে কুমিল্লার তৎকালীন জেলা প্রশাসক শিবপুরে এসে দেশি-বিদেশি সঙ্গীতপিপাসুদের জন্য ‘আলাউদ্দিন পল্লী’ প্রকল্পের ঘোষণা দেন। এর মধ্যে ছিল—ফকির আফতাব উদ্দিনের মাজার, সুর সম্রাটের নামে মিউজিয়াম, সঙ্গীত একাডেমি, পাঠাগার, মিলনায়তন, মুক্তমঞ্চ, পিকনিক কর্নার ও অতিথিশালা নির্মাণের পরিকল্পনা। পরিবারের পক্ষ থেকে ২২ শতক জমি জেলা প্রশাসকের নামে দলিল করা হলেও আজও সেই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি।
স্থানীয়রা নবীনগর-শিবপুর সড়কের নাম পরিবর্তন করে ‘ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সড়ক’ রাখার দাবি জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় শিবপুরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সুর সম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ ডিগ্রি কলেজ।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজীব চৌধুরী জানান, "এই গুণীজনের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণে যেসব পরিকল্পনা রয়েছে, যেমন যাদুঘর ও সংগীত একাডেমি, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হবে।"