মনজুর এ আজিজ : মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনাকেই এবারের বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে অন্তবর্তী সরকার দেখছে বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেছেন, ৯ শতাংশের কাছাকাছি থাকা মূল্যস্ফীতি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ৭ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হব আমরা। সেই সঙ্গে স্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার সব রকম চেষ্টাও এই চালানো হবে বলে জানান তিনি। সোমবার ২ জুন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট ঘোষণার প্রাক্কালে গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তিনি।
এবারের বাজেটের চ্যালেঞ্জ ও তা মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপের বিষয়ে অর্থ উপেদষ্টা বলেন, বৈশ্বিক অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ফলে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতেও বেশ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। আমরা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর ঋণের বোঝায় জর্জরিত ভঙ্গুর একটা অর্থনীতি পেয়েছিলাম।
সেখান থেকে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন বা উন্নয়ন আমরা করতে পেরেছি। আর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কাজ চলছে। আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি পণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করা। সরবরাহ গতিশীল রাখতে দেশের বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের একটি অংশ নানা কায়দায় চাঁদা আদায় করে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করে। এরাই আবার বাজারে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করে বাজার অস্থিতিশীল করে তোলে। এদের দৌরাত্ম্য বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করা অর্থনীতির ব্যাপার নয়। ‘অর্থনৈতিক স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখতে হলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশও অনুকূল রাখা দরকার। কিছু একটা হলেই লোকজন কাজ ফেলে রাস্তায় বসে যায়। সব দাবিদাওয়া পূরণ করা তো সরকারের পক্ষে একবারেই সম্ভব নয়। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কথা শুনলে তখন বেসরকারি যারা আছেন তারাও বলবেন, আমরা কী দোষ করেছি? আমাদের প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে একটা স্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। দাবিদাওয়ার বিষয় আসতে পারে। কিন্তু কাজকর্ম ফেলে রাস্তা বন্ধ করে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা, অর্থনীতির ওপরও বড় রকমের বিরূপ প্রভাব ফেলে।’
২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের বাজেটের প্রকৃতি কেমন হবে গণমাধ্যমকর্মীদের এমন জিজ্ঞাসায় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, এবারের বাজেট হবে বাস্তবসম্মত ও বাস্তবায়নযোগ্য। অর্থাৎ এবারের বাজেট বরাবরের মতো গতানুগতিক হবে না। ঋণনির্ভরতা যথাসম্ভব কমিয়ে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বাড়ানোর মাধ্যমে সক্ষমতা বৃদ্ধির একটা উদ্যোগ থাকবে এবারের বাজেটে। একই সঙ্গে বাজেটে অযাচিত ব্যয়হ্রাস বা অপচয় রোধেরও একটা প্রচেষ্টা থাকবে। তবে এবারের বাজেটের মূল লক্ষ্যই থাকবে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন। ইতোপূর্বে ৭ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা বলা হলেও সাধারণ মানুষ কার্যত এর সুফল পায়নি। কাজেই এবারের বাজেটে জনগণের জীবনমান উন্নয়নের বাস্তবায়নযোগ্য একটা প্রচেষ্টা থাকবে।
এবারের বাজেটের খাতভিত্তিক অগ্রাধিকার প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, এবারের বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষায় বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হবে। এছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, মানুষের জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। দেশের স্বাস্থ্য খাত সবসময়ই অবহেলিত থাকে। যদিও স্বাস্থ্যসেবায় টাকা কম দেওয়া হয়, তা নয়। কিন্তু এর সঠিক বাস্তবায়ন সেভাবে দেখা যায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যন্ত্রপাতি পড়ে থাকে অথবা নষ্ট হয়, অর্থাৎ সেগুলোর যথাযথ ব্যবহার হয় না। এবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু মৌলিক বিষয় পরিচালনা ব্যয় বাজেটে নিয়ে আসার একটা সিদ্ধান্ত হয়েছে। সার্বিকভাবে প্রকল্পনির্ভর না হয়ে এবার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিচালনায় বাজেট বরাদ্দ বেশি হবে। শিক্ষা ও জনকল্যাণে বাজেট বরাদ্দ বাড়বে। তবে রাতারাতি সব ক্ষেত্রেই বরাদ্দ বাড়ানো সম্ভব নয়। সবকিছুর সঙ্গে একটা সমন্বয় করেই এবারের বাজেট তৈরি করা হবে।
এবারের বাজেট আকারে ছোট করা নিয়ে সরকারের অবস্থান তুলে ধরে তিনি বলেন, বাজেট খুব বড় হচ্ছে অথবা খুব ছোট হচ্ছে ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাতকে আমরা প্রাধান্য দিচ্ছি। অন্যদিকে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্পের নামে কালক্ষেপণ, ভোগান্তি, অপচয় রোধে অর্থাৎ অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে আমরা কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছি। আমরা ঋণনির্ভরতা কমিয়ে এনে অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিচ্ছি।
বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে আসন্ন বাজেটে প্রণোদনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এবারের বাজেটে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হবে। তবে কর্মসংস্থান বলতে আমি বলব শুধু চাকরি নয়, তরুণ উদ্যোক্তা তৈরিতে আমরা গুরুত্ব দেব। এছাড়া আমাদের মূল লক্ষ্য দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও ব্যবসাবান্ধব একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা। দেশে তরুণদের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য আরও সম্প্রসারিত করা হবে। মানুষকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার একটা প্রচেষ্টা থাকবে। এটি করা গেলে প্রত্যেক মানুষ স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার পাশাপাশি বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পাবে। সে ক্ষেত্রে আমরা তরুণদের জন্য স্টার্টআপ ফান্ড ব্যবস্থা করেছি। ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সহায়তায় বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিল আছে। প্রয়োজনে তহবিল আরও বাড়ানো হবে।
বহুল জিজ্ঞাসিত ‘কালো টাকা সাদা করার’ কোনো সুযোগ এই বাজেটে থাকবে কি না, তা স্পষ্ট করে তিনি বলেন, বাজেটে কালো টাকা সাদা করার কোনো সুযোগ নেই। এসব উৎস বন্ধে আমরা কার্যকর পদক্ষেপ নেব। একটা উদাহরণ দিয়ে আমি বলি- যে দামে জমি কেনাবেচা হয়, সে দামে জমির দলিল হয় না। ৪-৫ কোটি টাকার জমি দেখা যায় দলিলপত্রে ৭০ লাখ দেখানো হয়। আমরা বলেছি, যে দামে বিক্রি হবে সে দামেই জমির নিবন্ধন বা দলিল হবে। সেটা না হলে কেনাবেচায় দুই পক্ষই বিপদে পড়ে। অনেকে আবার দেখেছি ঘুষটুষ দিয়ে এখান থেকে পার পেয়ে যায়। এসবের মারপ্যাঁচে নানা রকম সমস্যা হয়। এ প্রবণতা বন্ধ করতে ইতোমধ্যেই আমি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলেছি।
বাজেটে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও নীতি প্রণয়নে দুটি আলাদা বিভাগ প্রতিষ্ঠা ও নতুন আইন হয়েছে। এ নিয়ে নানা রকম হইচইও হয়েছে। ইতোমধ্যে আমানতকারীদের বহু টাকা বেহাত হয়েছে। দেশ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। এতে আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের অর্থ কীভাবে পরিশোধ করা যায়, সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু পরিকল্পনা নিয়েছে। ইতোমধ্যে ছয়টি ব্যাংকের প্রকৃত খেলাপি ঋণ নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাকিগুলোও একে একে করা হচ্ছে। সমস্যা সমাধানে সরকার আলাদা তহবিল গঠন করবে। অনেকেই না বুঝে সমালোচনায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে। আমরা তো বুঝেশুনেই কাজগুলো করছি।
ভঙ্গুর ব্যাংকিং খাত ও পুঁজিবাজারে সরকারের পদক্ষেপের বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, নেতৃত্বের সংকট ছিল অধিকাংশ ব্যাংকে। সেটা ধীরে ধীরে আস্থার জায়গায় ফিরে আসছে। আমরা বেশ কিছু ব্যাংকের এমডি-চেয়ারম্যানকে সরিয়ে নতুন লোক দিয়েছি। ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ হয়েছে। এটা ভালো কাজে দেবে। ব্যাংক খাতের কয়েকটা দিক নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। একটা হচ্ছে সম্পদ উদ্ধার। সেজন্য একটা বিশেষ তহবিলও করা হচ্ছে। টাকা ফেরতের পাশাপাশি এ তহবিল থেকে জনহিতকর কাজ করা হবে। পাচার হওয়া বিপুল অঙ্কের অর্থ ইতোমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো ফিরিয়ে নিয়ে আসাও বেশ কঠিন কাজ। এসব কাজে কিছু জটিলতা থাকে। তবে আমরা ইতোমধ্যেই আইনি পদক্ষেপ নিয়েছি। ব্যাংকগুলোর প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে আমরা কাজ করছি। ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশকে কাজে লাগানো হবে। তবে একটা কথা বলতে পারি যে, আমানতের টাকা সবাই ফেরত পাবেন। সেজন্য সময় লাগবে এবং ধৈর্য ধরতে হবে।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের জেনে বুঝে বিনিয়োগ করতে হবে। একটা ট্রেন্ড চলে এসেছিল স্টক একচেঞ্জে বিনিয়োগকারীরা ব্যবসার লভ্যাংশ নয় বরং শেয়ার বেচাকেনার একটা গেম প্ল্যান শুরু করেছিল। ইতোমধ্যে আমি ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) কে ৩ হাজার কোটি টাকা দিয়েছি। তারা সেখান থেকে একটি অংশ ইন্টারেস্ট বাবদ ও একটি অংশ বাজারে বিনিয়োগ করবে। আমি আশাবাদী শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে পুঁজিবাজারেও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসবে।