শিরোনাম
◈ ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এডিপির আকার ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা  ◈ মার্কিন শুল্কে আতঙ্ক নয়, সুযোগ দেখার পরামর্শ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের ◈ সচিবালয় অভিমুখে লংমার্চে পুলিশের বাধা, নগর ভবনের সামনে পুনরায় অবস্থান নিলেন ইশরাক সমর্থকরা ◈ বৈদেশিক আয় পাঠাতে খরচ বেড়েছে তিনগুণ: সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশি শ্রমিকরা ◈ সাবেক এমপি জেবুন্নেসা আফরোজ গ্রেফতার ◈ ভারত সরকারের কড়া অবস্থানে বিপাকে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ নেতারা ◈ গভীর রাতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বাসার সামনে নুরুল হক নুর লাইভে এসে যা বললেন ◈ অবৈধ ভারতীয়দের নিয়ম মেনে ফেরত পাঠাবে বাংলাদেশ: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ◈ মসজিদভিত্তিক শিক্ষা প্রকল্প: বকেয়া বেতন না পেলে সরব না, দুই ঘণ্টার আল্টিমেটাম ◈ ছয় শিল্প গ্রুপের সম্পদের সন্ধান আরব আমিরাতে: অর্থ ফেরাতে সরকারের জোরালো কূটনৈতিক ও আইনি পদক্ষেপ

প্রকাশিত : ১৭ মে, ২০২৫, ০৪:০৬ দুপুর
আপডেট : ১৭ মে, ২০২৫, ০৫:৩৭ বিকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বৈদেশিক আয় পাঠাতে খরচ বেড়েছে তিনগুণ: সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশি শ্রমিকরা

সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ার মতো দেশে চাকরির খোঁজে গেলে বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের ব্যয় অন্য দক্ষিণ এশীয় দেশের তুলনায় অনেক বেশি পড়ে। এমনকি এই ব্যয় নেপাল, ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায়ও অনেক বেশি। শুধু নিয়োগপ্রক্রিয়াতেই নয়, বিদেশে উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠাতে গিয়েও তাদের গুণতে হয় অতিরিক্ত টাকা।

বিদেশে কঠিন পরিবেশে দীর্ঘ সময় খাটাখাটির পর, এসব শ্রমিক পরিবার চালানো, খাদ্য, শিক্ষা বা ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে দেশে টাকা পাঠান। কিন্তু রেমিট্যান্স পাঠাতে খরচ বেশি হওয়ায় তাদের উপার্জনের একটি বড় অংশ নষ্ট হয়ে যায়।

২০২৪ সালে ১০০ ডলার দেশে পাঠাতে গড়ে খরচ হয়েছে ৯ ডলার ৪০ সেন্ট—যা তিন বছর আগের তুলনায় প্রায় তিনগুণ। এর মধ্যে লেনদেন ফি ছিল গড়ে ৩ ডলার, আর বাকি ৬ ডলার ৩০ সেন্ট গেছে প্রতিকূল বিনিময় হারের কারণে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ সবচেয়ে বেশি। একই পরিমাণ অর্থ পাঠাতে ভারতে গড় খরচ ২ ডলার ৮০ সেন্ট, পাকিস্তানে ৫ ডলার ১০ সেন্ট, আর বৈশ্বিক গড় ৬ ডলার ৫০ সেন্টের চেয়েও বাংলাদেশের হার বেশি।

এই উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে পরিচালিত একটি গবেষণায়, যা পরিচালনা করেছেন বিশ্বব্যাংকের পরামর্শদাতা ও বাংলাদেশি গবেষক হুসেইন সামাদ। গবেষণায় বিশ্বব্যাংকের রেমিট্যান্স প্রাইসেস ওয়ার্ল্ডওয়াইড (আরপিডব্লিউ) ডেটাবেইজ ব্যবহার করা হয়েছে, যা ৪৮টি প্রেরণকারী ও ১০৫টি গ্রহণকারী দেশের ৩৬৭টি করিডোরে রেমিট্যান্স খরচ পর্যবেক্ষণ করে। এসব তথ্য বাংলাদেশের জন্য এক অস্বস্তিকর বাস্তবতা তুলে ধরেছে।

এটা শুধু পরিসংখ্যান নয়। ২০২৪ সালেই অতিরিক্ত লেনদেন ফি ও বিনিময় হারের কারণে বাংলাদেশি অভিবাসীরা হারিয়েছেন প্রায় ১৫ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা, অর্থাৎ ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। এই টাকায় কুমিল্লার কোনো পরিবারের খরচ মেটানো যেত, বা চাঁপাইনবাবগঞ্জে কারও স্কুলের খরচ দেওয়া যেত। কিন্তু সেটি নষ্ট হয়েছে অদক্ষ ও সুবিধাবাদী মূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থার কারণে।

এই ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত ব্যয় করেছেন প্রায় ৬৫ লাখ প্রবাসী শ্রমিক—যদি প্রত্যেকে গড়ে মাত্র ২০০ ডলার করে পাঠিয়ে থাকেন। এই অঙ্ক বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বৈদেশিক আয়ের উৎস সৌদি আরব থেকে তিন মাসে আসা রেমিট্যান্সের সমান। লেনদেন ফি ও প্রতিকূল বিনিময় হারের মাধ্যমে কার্যত এই অর্থ দেশের বাইরে চলে গেছে, যার প্রভাব পড়েছে দেশের বিনিয়োগ, সঞ্চয় এবং প্রাপক পরিবারের দৈনন্দিন খরচে।

এটা হঠাৎ কোনো ঘটনা নয়। ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশি অভিবাসীরা অতিরিক্ত ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স ফি দিয়েছেন—যা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনাল নির্মাণ ব্যয়ের চেয়েও বেশি।

ব্যয় বৃদ্ধির কারণ

বিশ্বব্যাংকের আরপিডব্লিউ তথ্য বলছে, রেমিট্যান্স খরচ প্রধানত দুইভাবে নির্ধারিত হয়: লেনদেন ফি ও বৈদেশিক মুদ্রার মার্জিন। এই মার্জিন নির্ধারিত হয় সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত বিনিময় হার ও সরকার ঘোষিত হারের পার্থক্য থেকে।

আরপিডব্লিউ-এর ত্রৈমাসিক তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত লেনদেন ফি মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল—গড়ে ৩ শতাংশের মতো। কিন্তু খরচ বৃদ্ধির মূল কারণ হলো বৈদেশিক মুদ্রার মার্জিন, যা ২০২১ সালে ছিল মাত্র ০ দশমিক ৯ শতাংশ, কিন্তু ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৩ শতাংশে। এতে মোট রেমিট্যান্স খরচ ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।

গবেষণায় উৎস দেশের ভিত্তিতে খরচের তারতম্যের কথাও বলা হয়েছে। বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহের শীর্ষ পাঁচ দেশ—সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র; যারা ২০২৪ অর্থবছরে মোট রেমিট্যান্সের ৬০ শতাংশের বেশি পাঠিয়েছে—তাদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে রেমিট্যান্স খরচে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে।

সৌদি আরবে লেনদেন ফি সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। ২০২১ সালে যেখানে এই ফি ছিল ২.৪ শতাংশ, ২০২৪ সালে তা বেড়ে ৪.২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এর বিপরীতে, যুক্তরাজ্যে লেনদেন ফি কিছুটা কমেছে—২.২ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১.৪ শতাংশে। অন্য উৎস দেশগুলোতে লেনদেন ফিতে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি।

গবেষণায় বলা হয়েছে, 'সব উৎস দেশেই বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের মার্জিন অনেক বেড়েছে। এর মধ্যে মালয়েশিয়া ও সৌদি আরবের অবস্থান শীর্ষে। মালয়েশিয়ায় এই মার্জিন বেড়েছে ৭.৭ শতাংশীয় পয়েন্ট এবং সৌদি আরবে ৬.৭ শতাংশীয় পয়েন্ট। সব মিলিয়ে সৌদি আরব থেকেই রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে—২০২১ সালের ১ শতাংশ থেকে তা ২০২৪ সালে পৌঁছেছে প্রায় ১১.৯ শতাংশে। ফলে এটি এখন অভিবাসী কর্মীদের জন্য সবচেয়ে ব্যয়বহুল রেমিট্যান্স উৎস দেশ। মালয়েশিয়ায় খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০.৮ শতাংশ এবং যুক্তরাষ্ট্র ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রায় ১০ শতাংশ।'

রেমিট্যান্স খরচ বাড়ার পেছনে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অস্থিরতাকেও আংশিকভাবে দায়ী করেছেন গবেষক হুসেন সামাদ। তিনি জানান, ২০২১ সালে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৪ সালে অর্ধেকে নেমে আসে। একই সময় মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৪১ শতাংশ—যার মধ্যে শুধু ২০২৪ সালের ৮ মে একদিনেই টাকার মান পড়ে যায় ৬ শতাংশ।

হুসেন সামাদ বলেন, 'বিনিময় হারের ওঠানামা নিয়ন্ত্রণে রাখতে রেমিট্যান্স সেবা প্রদানকারীরা অতিরিক্ত ফি নেয়, কারণ হঠাৎ পরিবর্তনের ঝুঁকি তাদেরই বহন করতে হয়।' তবে তিনি এ-ও বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও অর্থনৈতিক চাপ থাকলেও তাদের রেমিট্যান্স খরচে তেমন প্রভাব পড়েনি। উদাহরণ হিসেবে, ভারতের রুপির মান ২৪ শতাংশ কমলেও দেশটির রিজার্ভ বেড়েছে ৫০ শতাংশ, যা রেমিট্যান্স ব্যয় নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করেছে।

সামাদ আরও কিছু অন্তর্নিহিত সমস্যার কথাও তুলে ধরেন। যেমন—বিনিময় হারের ভেতরে লুকানো অতিরিক্ত ফি, আন্তর্জাতিক নির্দেশনার পরও খরচের স্বচ্ছতার ঘাটতি এবং একচেটিয়া চুক্তির কারণে প্রতিযোগিতার অভাব। তিনি সতর্ক করে বলেন, সরকারের ২.৫ শতাংশ রেমিট্যান্স প্রণোদনা অনেক সময় কিছু সেবা প্রদানকারীকে তাদের মার্জিন বাড়াতে উৎসাহিত করতে পারে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি এক্সচেঞ্জ হাউসে কর্মরত অভিজ্ঞ রেমিট্যান্স বিশেষজ্ঞ মুন্সি মো. আশফাকুল আলম ২০২২ সালের বিনিময় হারের অস্থিরতা বিষয়ে গবেষকের বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি আরও দুটি বিষয় তুলে ধরেন—বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের জন্য এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোর অতিরিক্ত ব্যয় এবং অনিবন্ধিত অভিবাসীদের আনুষ্ঠানিক রেমিট্যান্স চ্যানেল ব্যবহার করতে না পারা। তার মতে, শুধু সৌদি আরবেই ১০ থেকে ১২ লাখ বাংলাদেশি অনিবন্ধিতভাবে অবস্থান করছেন।

সমস্যার সমাধানে...
বিশ্বজুড়ে রেমিট্যান্স ফি পুরোপুরি তুলে দেওয়া এখনো কঠিন, তবে কিছু দেশ নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে তা কমাতে বা বাতিল করতে সফল হয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে পাকিস্তানের 'পিআরআই' (পাকিস্তান রেমিট্যান্স ইনিশিয়েটিভ) কর্মসূচির কথা বলা যায়, যেখানে ১০০ ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠালে কোনও ফি লাগে না। আলম জানান, এই উদ্যোগ রেমিট্যান্স পাঠানো সহজ করেছে, খরচ কমিয়েছে এবং হুন্ডির মতো অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের ব্যবহার অনেক কমিয়ে দিয়েছে।

নিজ গবেষণা প্রতিবেদনে হুসেন সামাদ বাংলাদেশেও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন, লেনদেন ফি ও বৈদেশিক মুদ্রা মার্জিনসহ রেমিট্যান্সের মোট খরচ সীমিত রাখার জন্য একটি নির্দিষ্ট সীমানা নির্ধারণ করতে। তিনি আরও প্রস্তাব করেছেন, বিদেশে থাকা বাংলাদেশি দূতাবাসগুলো যেন অভিবাসী কর্মীদের সাশ্রয়ী রেমিট্যান্স সেবার দিকনির্দেশনা দেয় এবং প্রস্থান-পূর্ব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অভিবাসীদের এই খরচ সম্পর্কে সচেতন ও দক্ষ করে তোলে। উৎস: বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়