বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন।। চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসা ঘিরে শনিবার রাতে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ও জশনে জুলুসে অংশগ্রহণকারী মধ্যে সংঘর্ষের পর সেখানে এখন থমথমে পরিস্থিতি রয়েছে। দুই পক্ষকে নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন বৈঠক করলেও এখনো দুই পক্ষের মধ্যে এই নিয়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে।
শনিবার রাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে উপজেলায় ১৪৪ ধারাও জারি করে উপজেলা প্রশাসন। পরে সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশ চেষ্টা চালিয়ে শেষ রাতের দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
ওই সংঘর্ষে শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে রোববার বিকেলে উভয় পক্ষের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠকে বসার কথা জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, "প্রথম থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চেষ্টা করেও সংঘর্ষ থামাতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ভোর রাতে কিছুটা স্বাভাবিক হয় পরিস্থিতি"।
মূলত ঈদে মিলাদুন্নবি উপলক্ষ্যে প্রতিবছর চট্টগ্রাম শহরে অনুষ্ঠিত জশনে জুলুসে অংশ নিতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে শহরে আসেন আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত অনুসারীরা, যারা নিজেদের সুন্নি আকিদার অনুসারী বলে বর্ণনা করে থাকেন।
জুলুসে যাওয়ার পথে তাদের বহনকরী গাড়ি বহর থেকে হাটহাজারি কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের লক্ষ্য করে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য ও অশালীন ভঙ্গি করা হয়েছে বলে অভিযোগ তোলে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে পাল্টা অভিযোগে সুন্নি আকিদার অনুসারীরা বলেছেন, তাদের দিকে আগে কওমি মাদ্রাসা থেকে পানি ছুড়ে মারা হয়েছিল।
সন্ধ্যা থেকে এই সংঘর্ষে শতাধিক মানুষ আহতের খবর পাওয়া গেছে। আহতদেরকে হাটহাজারি উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। আর গুরুতর আহত তিনজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে
শনিবার রাতের ওই ঘটনা নিয়ে হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসনের সাথে কথা বলে ঘটনার কারণ জানার চেষ্টা করেছে বিবিসি বাংলা।
মূলত সুন্নি মুসলিম হলেও, চট্টগ্রামে কওমি মাদ্রাসার অনুসারীদের সাথে মাজার ও আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত অনুসারীদের বা জশনে জুলুসে যাওয়া অনুসারীদের মধ্যে কিছু দ্বন্দ্ব আছে দীর্ঘদিন ধরে।
ফলে বিভিন্ন সময়ে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন, ইজতেমা বা মাহফিল আয়োজন ঘিরে উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনাও তৈরি হয়।
পুলিশ ও স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরা জানিয়েছেন, অন্যান্য বছরের মতো এবারো মিলাদুন্নবী উপলক্ষে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বা সুন্নি আকিদা অনুসারীরা এবারো চট্টগ্রামের জশনে জুলুসের আয়োজন করে।
জশনে জুলুসে যাওয়া ব্যক্তিদের বহনকারী বাস হাটহাজারি মাদ্রাসার সামনে থেকে যাচ্ছিল।
পুলিশ ও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গাড়িবহরের একজন তরুণ হাটহাজারী মসজিদ লক্ষ্য করে আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি করে একটি ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করেন। ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়লে হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা এর প্রতিবাদ জানায়।
হাটহাজারী মাদ্রাসা হিসেবে পরিচিতি পেলেও এই মাদ্রাসাটির নাম দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী বড় মাদ্রাসা।
এই মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক ও সহকারী পরিচালক জসীম উদ্দিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, "তারা সকাল থেকে সারাদিন মাদ্রাসার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় বিশ্রী স্লোগান ও আঙুল দেখিয়ে যে সব কার্যকলাপ করেছে, এতে ছাত্ররা ক্ষেপে যায়"।
একপর্যায়ে ভিডিও পোস্ট করা ওই তরুণকে আটক করে পুলিশ।
অন্যদিকে সুন্নি আকিদার অনুসারীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা তাদের বাসে গরম পানি ছুড়ে মেরেছিল।
হাটহাজারী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাজী মুহাম্মদ তারেক আজিজ বিবিসি বাংলাকে বলেন, "দুই পক্ষই একে একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছে। একপক্ষ বলছে তাদেরকে পানি মারা হয়েছে। অন্য পক্ষ বলছে তাদের অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি দেখানো হয়েছে। এখন কোনটা আগে হয়েছে কোনটা পরে হয়েছে এটা এখনো আমরা নিশ্চিত নই"।
সন্ধ্যার পর ছড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষ
ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে সন্ধ্যার পর থেকেই হাটহাজারী মাদ্রাসা এলাকার পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতি হতে থাকে। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে।
ওই সময়কার বেশ কিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেখা যায় মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা শ্লোগান দিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। ওই এলাকায় ব্যাপক ভাঙচুরও চলতে দেখা যায় এসব ভিডিওতে।
এমন একটি ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে হাটহাজারি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীকে বলতে শোনা যায়, 'ওরা প্রথমে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি দেখাইছে, তখনও আমরা কিছু বলি নাই। পরে আমাদের ওস্তাদ আহমেদ শফি, বাবুনগরী হুজুরদের কবরে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়েছে। যখন আমাদের ওলামায়ে ইকরামের কবরে আঘাত করা হয়েছে তখন আমরা আর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারি নাই"।
পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন জানায়, এ নিয়ে সন্ধ্যার পর দুই পক্ষের মধ্যে কয়েক দফায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও ঢিল-ছোড়াছুড়ির ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে শিক্ষার্থী ও কওমি অনুসারীরা হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে।
পরে মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের রাস্তা ছেড়ে মাদ্রাসার ভেতরে চলে আসতে মাইকে ঘোষণা দেন। পরে কওমি শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসার সামনে অবস্থান নেয়।
হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষক জসীম উদ্দিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, "সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের সময় নামাজের জন্য গেট খোলা হয়। সেই সময় এখানে ছাত্ররা বের হয়েছে। তখন ছাত্রদের ওপর হামলা করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়"।
অপরদিকে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত অনুসারীরা অবস্থান নেয় হাটহাজারীর কাচারি সড়কে। দুইটি পক্ষই এ সময় রাস্তায় টায়ার জালিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে ও একে অপরের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে থাকে।
সুন্নি আকিদা অনুসারীদের সংগঠন আঞ্জুমান এ রহমানিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের সহসভাপতি মঞ্জুর আলম বিবিসি বাংলাকে বলেন, "জুলুস থেকে যারা গেছে তাদের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে বলে আমি জানতে পারছি। আমাদের পক্ষ থেকে তাদের নির্দেশ দেওয়া ছিল তারা যেন সেখান থেকে চলে আসে, কোনও ধরনের ফ্যাসাদে না জড়ায়। কারণ এটা আমাদের আকিদার মধ্যে পড়ে না"।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ছিল সন্ধ্যা থেকেই। কিন্তু দুই পক্ষের মারমুখী অবস্থানের মধ্যে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে শুরু করে।
দুই পক্ষের মধ্যে ইটপাটকেল ও ঢিল-ছোড়াছুড়িতে দেড়শোরও বেশি মানুষ আহত হয়। আহতদের প্রাথমিকভাবে হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয় বলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সর অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে জানানো হয়।
এই সংঘর্ষ কেন শুরুতেই নিয়ন্ত্রণ করা গেলো না, কিংবা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও নানা প্রশ্ন ওঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, "আমরা সার্বক্ষণিক মাঠেই ছিলাম। দুই পক্ষের সাথে কথা বলেছি। তারপরও শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় নি। দুই পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে"।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৪৪ ধারা জারি
এমন পরিস্থিতির মধ্যে রাত ১১টার দিকে দুই পক্ষকে নিয়ে বৈঠকে বসে পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসন। সেখানে সুন্নি অনুসারীদের পক্ষ থেকে আটককৃত যুবককে ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানানো হয়।
অপরদিকে কওমি শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে আটককৃত ও ব্যক্তিকে শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানানো হয়।
দুই পক্ষের এমন অনড় অবস্থানের মধ্যেই থেমে থেমে সংঘর্ষ, ইট পাটকেল ছোড়াছুড়ি চলতে থাকে। এক পর্যায়ে ঘটনাস্থলে আসে সেনাবাহিনী।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন ওই এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে।
উপজেলা প্রশাসনের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, জনসাধারণের জীবন ও সম্পদ রক্ষা এবং শান্তিশৃঙ্খলা স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে উপজেলার মীরের হাট থেকে এগারো মাইল সাবস্টেশন পর্যন্ত এবং উপজেলা গেইট থেকে কৃষি প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে শনিবার রাত ১০টা থেকে পরদিন (রোববার) বিকেল তিনটা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার এই আদেশে এই সময়ের মধ্যে যে কোন ধরনের সভা, সমাবেশ, মিছিল, জমায়েত বন্ধ ও পাঁচ জনের বেশি একত্রে চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়।
১৪৪ ধারা জারির পর থেকে ওই এলাকায় সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল অভিযান শুরু হয়।
হাটহাজারী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাজী মুহাম্মদ তারেক আজিজ বিবিসি বাংলাকে বলেন, "রাত দেড়টার মধ্যেই দুই পক্ষকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হই। পুলিশসহ সবাই মাঠে ছিল। দেড়টার দিকে পরিস্থিতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হই আমরা"।
আহতরা হাসপাতালে, প্রশাসনের বৈঠক
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত এই সংঘর্ষের একশোরও বেশি মানুষ আহত হয়েছে। কোনও কোনও গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে আহতের সংখ্যা দেড়শোরও বেশি।
সংঘর্ষ শুরু হলে রোববার সন্ধ্যার পর থেকে একের পর এক আহতরা হাসপাতালে ভর্তি হতে শুরু করে।
শনিবার রাতে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে জানানো হয়, চট্টগ্রামের হাটহাজারি এলাকায় মাদ্রাসা ও সুন্নি সমর্থকদের সংঘর্ষে আহত অন্তত ৮০ জনকে হাটহাজারি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।
গুরুতর আহতদের মধ্যে তিনজকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলেও জানিয়েছে সিভিল সার্জন অফিস।
আগেরদিন সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুরের কারণে রোববার ভোর থেকে হাটহাজারী এলাকার পরিস্থিতি থমথমে ছিল।
রোববার সকাল দশটার পর থেকে পরিস্থিতি একটু একটু করে স্বাভাবিক হতে শুরু করে। কিন্তু রাস্তায় যানবাহন ও মানুষজনের উপস্থিতি ছিল একেবারেই কম।
বেলা বাড়ার সাথে সাথে কিছু দোকান পাট খুলতে শুরু করে। হাটহাজারী থেকে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি যাওয়ার সড়কেও যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
রোববার বিকেলে সুন্নি আকিদা অনুসারী ও হাটহাজারী মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের সাথে বৈঠকে বসে এই ঘটনা নিয়ে। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বৈঠকটি চলছিল।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, আমরা আশা করছি দুই পক্ষের সাথেই কথা বলে ঘটনাটির সমাধান করা যাবে।