শিরোনাম
◈ তরুণ ক্রিকেটার তানভীরের ফাইফারে সিরিজ সমতায় বাংলাদেশ ◈ 'শিক্ষা ও স্বাস্থ্য দখল করেছে জামায়াত': গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ◈ ১৪ হাজার কোটি রুপি কেলেঙ্কারি, যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেপ্তার ভারতের নেহাল মোদি (ভিডিও) ◈ মোবাইল চুরির অভিযোগকে কেন্দ্র করে গ্রাম্য সালিস থেকে রক্তাক্ত ট্র্যাজেডি ◈ জাতীয় নির্বাচনে বাধা দেওয়ার শক্তি কারো নেই: কেরানীগঞ্জে বিএনপি সমাবেশে সালাহ উদ্দিন আহমদের হুঁশিয়ারি ◈ তুর্কমেনিস্তানকে কাঁ‌পি‌য়ে দি‌লো বাংলা‌দেশ, এশিয়ান কাপে যাচ্ছে ঋতুপর্ণারা ◈ চী‌নে জু‌নিয়র হ‌কি‌তে একদিনে বাংলাদেশ পুরুষ ও নারী দ‌লের জয় ◈ কত টাকার বিনিময়ে মানববন্ধনে এসেছেন তারা, এদের পরিচয় কী? আরো যা জানাগেল (ভিডিও) ◈ ঠাকুরগাঁও সীমান্তে আবারো বিএসএফের ‘পুশ ইন’, ৬ বাংলাদেশিকে আটক করেছে বিজিবি ◈ বি‌সি‌বি ও বি‌সি‌সিআই সর্বসম্ম‌তিক্রমে সি‌রিজ স্থ‌গিত কর‌লো, আগ‌স্টে আস‌ছে না ভারত

প্রকাশিত : ০৩ নভেম্বর, ২০২১, ০৬:৪৯ সকাল
আপডেট : ০৩ নভেম্বর, ২০২১, ০৬:৪৯ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী: ৩ নভেম্বর এবং ১৫ আগস্ট একই সূত্রে গাঁথা

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে গভীর রাতে একইরুমে জড়ো করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিলো। যারা হত্যায় অংশ নিয়েছিলো তারা ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু, শেখ মনি ও আব্দুর রউফ সেরনিয়াবাতের পরিবারের হত্যাকা সঙ্গে যুক্ত ছিলো। জেলের ভেতরে তাদের প্রবেশের কোনো অনুমতি থাকার কথা নয়। কিন্তু তারা বিশেষ ক্ষমতায় জেলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিলো। এমনকি তারা জোর করেও প্রবেশ করেনি। তাদের প্রবেশের অনুমতি দিতে বাধ্য করেছিলেন অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী ‘রাষ্ট্রপতি’ খন্দকার মোশতাক আহমেদ। কারা কর্তৃপক্ষকে টেলিফোনের মাধ্যমে প্রবেশকারীরা যা করতে চায় তা করতে বাধা না দিতে না বলা হয়। এমন বর্বোচিত বেআইনি কাজ আধুনিক বিশে^র কোথাও ঘটে না। কিন্তু বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টে যেমন ঘটেছিলো ৩ নভেম্বর জেলের অভ্যন্তরেও ঘাতকরা সংঘটিত করেছিলো। দুঃখজনক অভিজ্ঞতা হলো ১৫ আগস্টের হত্যাকাÐ এবং পরবর্তী সময়ে সরকার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিবর্তন নিয়ে যারা মনে মনে খুশি ছিলো সমর্থন দিয়েছিলো এবং এখনো সেই হত্যাকাÐের বিরুদ্ধে নয় বরং পক্ষে ওকালতি করছেন তাদের মানসিকতা এবং রাজনৈতিক মানবতাবিরোধী বটেই, রাষ্ট্র সভ্যতার বিপক্ষেও। সুতরাং তাদের মুখে বহুদলীয় গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সুখ-সমৃদ্ধির কথা প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। ৩ নভেম্বর জেলের অভ্যন্তরে কারাবন্দি নেতৃবৃন্দকে হত্যা কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিলো না।

এটি ছিলো ১৫ আগস্টের হত্যাকা আরেক পর্ব, যার লক্ষ্য উদ্দেশ্য পরিকল্পনাকারী এবং প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অংশগ্রহণকারীরা একই ছিলো। উদ্দেশ্য ছিলো বাংলাদেশকে শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বশূন্যই করা নয় কিংবা নিজেরা রাষ্ট্রক্ষমতায় বসাই নয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, ১৯৭২-এর সংবিধান এবং বঙ্গবন্ধু কর্তৃক রাষ্ট্র নির্মাণের ধারা থেকে সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করা, নিজেদের ডিজাইনে বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবাদর্শে ফিরিয়ে নেওয়া। দেশের অভ্যন্তরে অতি ডান, অতি বাম, স্বাধীনতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী, সাম্প্রদায়িক, সুবিধাবাদী এবং আদর্শহীনদের একটি একচ্ছত্র রাজনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠা করা। একইসঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ধারক-বাহক ব্যক্তি ও রাজনীতি যাতে আর কোনোকালে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত না হতে পারে সেই ব্যবস্থা চিরস্থায়ী করা। সেটি করার জন্যই প্রথমে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু, শেখ ফজলুল হক মনি এবং আব্দুল হক সেরনিয়াবাতকে ১৫ আগস্ট তারিখে ভোরবেলা আকস্মিভাবে হত্যা করে সামরিক বাহিনীর নি¤œ ও মধ্যস্তরেরর কিছু কর্মকর্তা। হত্যাকা সামরিক বাহিনীরই অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে।
হত্যাকা

এই পর্ব তাদের সফল হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারি রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার এবং কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। অনেকে এটিকে স্বাভাবিক কারা নিক্ষেপ হিসেবে দেখেছিলো। কিন্তু এর অন্তরালে ছিলো আরেকটি ছক। যেটি বাংলাদেশের তো নয়ই, বর্তমান বিশে^র কোনো দেশের অভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনৈতিক বন্দী ও কারা নিক্ষেপণের ইতিহাসে ঘটতে দেখা যায়নি। কিন্তু ১৯৭৫ সালে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক যেসব চক্র বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় পরিবর্তনকে নিশ্চিত করতে পরিকল্পনার অংশ কষেছিলো। তাদের যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের হিসাবই শুধু আলাদা ছিলো না। মানসিকতাও ছিলো চরম উগ্রতায় ভরা। সে কারণেই ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে একা নয়, শেখ মনি ও আব্দুর রউফ সেরনিয়াবাতকেও সপরিবারে নির্মূল করতে বদ্ধপরিকর ছিলো। তারা এই তিন পরিবারের শিশুদেরও বাঁচতে দিতে চায়নি। এটি কতো পৈশাচিক মনোবৃত্তি হতে পারে তা গভীরভাবে ভেবে দেখার বিষয়। অনেকেই হয়তো এ পর্যন্তই তাদের চিন্তার অবস্থানকে দেখার বেশি কল্পনা করতে পারেনি, কিন্তু ষড়যন্ত্রকারী দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক শক্তির পরিকল্পনা কতোটা সুদূরপ্রসারী ছিলো তা এখনো অনেকে হয়তো মিলিয়ে দেখতে পারছেন না। হত্যাকাÐের সমগ্রতাকে মিলিয়ে দেখলে আমার তো মনে হয় এখনো এর পর্ব শেষ হয়নি। অন্তত শেখ হাসিনাকে বারবার হত্যা করার নেপথ্যের শক্তির সঙ্গে ১৫ আগস্টের হত্যার যোগসূত্রতা আলাদা করে দেখার কিছু দেখি না। ভবিষ্যতে ওই হত্যাকাÐের ধারক, বাহক এবং উত্তরাধিকারীরা শুধু বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নয়, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সবকিছুকেই নির্মূল করার কাজে অব্যাহত থাকবে এটিই মনে হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকা পরিকল্পনাকারীদের প্রথম পর্ব ১৫ আগস্ট ‘সফল’ হওয়ার পর রাষ্ট্রকে পরিবর্তন করার সকল চেষ্টাই শুরু হয়েছিলো। সামরিক বাহিনীর ভেতর থেকে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, আবার রাজনৈতিক শক্তিও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। সেই অবস্থায় মূল পরিকল্পনাকারী ও হত্যাকারীরা তাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশকে দীর্ঘমেয়াদে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য হত্যাকাদ্বিতীয় ছক বাস্তবায়ন অনিবার্য করে। ২ ও ৩ নভেম্বর সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে ১৫ আগস্টের হত্যাকারী এবং ক্ষমতা দখলকারী মোশতাক সরকারকে উৎখাতের উদ্যোগ নেওয়া হলে ষড়যন্ত্রকারীরা দ্বিতীয় ছক বাস্তবায়নের জন্য এম এ জি ওসমানীর সহযোগিতা গ্রহণ করেন। তারা ওসমানীর মাধ্যমে দেশত্যাগের সুযোগ চায় নতুবা রক্তারক্তি ঘটবে এমন ধারণা প্রদান করে। বস্তুত এর আড়ালে তারা ৩ নভেম্বরের গভীর রাতে মোশতাকসহ সবাইকে অন্ধকারে রেখে কারাগারের অন্তরালে থাকা চার জাতীয় নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই হত্যাকাÐটি গোপন রাখা হয়েছিলো। তবে এম এ জি ওসমানীসহ সামরিক বাহিনীর দুই-তিনজন শীর্ষ কর্মকর্তার জানা ছিলো। তারা বিষয়টি গোপন রেখেছিলেন। ফলে মোশতাককে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা একত্রিত হলেও বিষয়টি তাদের জানা ছিলো না। তারা রাজনৈতিক কোনো অভিজ্ঞ মহলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি। পুরো ঘটনাটি তাদেরই বুদ্ধিমত্তা ও বাস্তবতা অনুযায়ী তারা বুঝতে ও কার্যকর করতে চেয়েছিলো। কিন্তু এখানে মূল ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনাকারীদের হিসাব-নিকাশে ওসমানী এবং শীর্ষ দুই-তিন সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন তাদের কাছে বিশ^াসযোগ্য। তাদের মাধ্যমেই ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরে জেলের অভ্যন্তরে হত্যায় অংশ নেওয়া ঘাতকদের সপরিবারে দেশ থেকে থাইল্যান্ডে চলে যাওয়ার ব্যাপারে মধ্যস্থতা করেছিলেন জেনারেল এম এ জি ওসমানী।

মোশতাক সরকারকে উচ্ছেদের জন্য জড়ো হওয়া কর্মকর্তারা রক্তপাত এড়ানোর উদ্দেশ্যে ওসমানীর মাধ্যমে দেওয়া ঘাতকদের শর্ত মেনে নেয়। ওই দিনই তারা বিমানযোগে দেশ ছেড়ে চলে যায়। তারা দেশত্যাগ করার পরেই কেবল জানাজানি হয় যে জেলের অভ্যন্তরে ঘাতকরা দ্বিতীয় হত্যাকাÐ সংঘটিত করেছে। এতে নির্মমভাবে নিহত হন মুক্তিযুদ্ধের চার জাতীয় নেতা। যারা বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তখন মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত করেছিলেন, এখন বেঁচে থাকলে নতুনভাবে নেতৃত্ব দিতে পারতেন। সেটি যেন না দিতে পারে সেজন্যই এ হত্যাকাÐ সংঘটিত করা হয়। ৪ তারিখ বিকেলে কেবল পরিবারের সদস্যরাই জানতে পারেন যে তাদের প্রিয়জনদের হত্যা করা হয়েছে। জাতি সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারেনি যে এমন চার নেতা আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছেন। যাদের অনুপস্থিতে আমাদের আর নেতৃত্ব দেওয়ার তেমন কেউ থাকবে না।

চার জাতীয় নেতা সমাহিত হলেন পরিবারের অশ্র পরিবেশে। তাদের দেওয়া হয়নি সামান্যতম সম্মান। অথচ তখন মোশতাকের ক্ষমতা ছিলো নড়বড়ে। সামরিক বাহিনীও সংহত হতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে চার জাতীয় নেতাকে আমরা হারিয়েছি কিন্তু বিদায় জানাতে পারিনি। ইতিহাসের এমন দুর্যোগময় মুহূর্ত আমাদের ভারাক্রান্ত করেছে। আমরা আজও এই নেতাদের ইতিহাস সৃষ্টির মূল্যায়ন করতে পারিনি। প্রতিবছর ৩ নভেম্বর আসে জেলহত্যা দিবস হিসেবে, চার জাতীয় নেতার হত্যার কথা গণমাধ্যমে আলোচিত হয়, লেখালেখি হয় কিন্তু তারা কতো বড় জাতীয় নেতা ছিলেন তাদের শূন্যস্থান পূরণ করার মতো আর কোনো নেতা কি তৈরি হবে? এই প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর আমরা এখনো খুঁজি না। তাদের শুধুই জাতীয় নেতা নামে অভহিত করি। এখনো তো অনেক জাতীয় নেতা আছে। তাদের আমরা ছোট করতে চাই না। কিন্তু সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, এম মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামানের মতো নেতা তৈরি হওয়ার দীর্ঘ সংগ্রামী ইতিহাস কেউ কোনোদিন পাবে না। বঙ্গবন্ধুর বিশ^স্ত এবং সহযোগী নেতা হিসেবে তারা সকলেই একেকজন সমগোত্রীয় এবং সমমানের নেতা হয়ে ওঠেছিলেন যারা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু যা করতে চেয়েছিলেন তার অনুপস্থিতিতে সেটি বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন। একটি মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করার মাধ্যমে তাদের মেধা, প্রজ্ঞা, দেশপ্রেম, নেতৃত্বের উচ্চতা, দূরদর্শিতা প্রমাণিত হয়েছিলো। এমন প্রমাণ রাখার যোগ্যতা তখন বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নেতাদের মধ্যে সমানভাবে বিচ্ছুরিত ছিলো। সেকারণেই তারাও ছিলেন স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার একেকজন দৃঢ়চিত্তের নেতা যারা কেবল ইতিহাসের একবারই তৈরি হতে পারেন। সেটি তৈরি হয়েছিলো বলেই বাংলাদেশ স্বাধীন হতে পেরেছিলো। সুতরাং তারা জাতীয় নেতা তবে ইতিহাসের বিরল জাতীয় নেতা। সেই নেতাদের মর্যাদা ও সম্মান এখনো আমরা যথাযথভাবে দিতে পারিনি। ৩ নভেম্বর শুধু জেলহত্যা দিবস নয়, এটি ছিলো মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ হত্যারও দিবস, যার প্রথম ছিলো ১৫ আগস্ট, দ্বিতীয় পর্ব ৩ নভেম্বর।
পরিচিতি : শিক্ষাবিদ। 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়