শিরোনাম
◈ তরুণ ক্রিকেটার তানভীরের ফাইফারে সিরিজ সমতায় বাংলাদেশ ◈ 'শিক্ষা ও স্বাস্থ্য দখল করেছে জামায়াত': গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ◈ ১৪ হাজার কোটি রুপি কেলেঙ্কারি, যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেপ্তার ভারতের নেহাল মোদি (ভিডিও) ◈ মোবাইল চুরির অভিযোগকে কেন্দ্র করে গ্রাম্য সালিস থেকে রক্তাক্ত ট্র্যাজেডি ◈ জাতীয় নির্বাচনে বাধা দেওয়ার শক্তি কারো নেই: কেরানীগঞ্জে বিএনপি সমাবেশে সালাহ উদ্দিন আহমদের হুঁশিয়ারি ◈ তুর্কমেনিস্তানকে কাঁ‌পি‌য়ে দি‌লো বাংলা‌দেশ, এশিয়ান কাপে যাচ্ছে ঋতুপর্ণারা ◈ চী‌নে জু‌নিয়র হ‌কি‌তে একদিনে বাংলাদেশ পুরুষ ও নারী দ‌লের জয় ◈ কত টাকার বিনিময়ে মানববন্ধনে এসেছেন তারা, এদের পরিচয় কী? আরো যা জানাগেল (ভিডিও) ◈ ঠাকুরগাঁও সীমান্তে আবারো বিএসএফের ‘পুশ ইন’, ৬ বাংলাদেশিকে আটক করেছে বিজিবি ◈ বি‌সি‌বি ও বি‌সি‌সিআই সর্বসম্ম‌তিক্রমে সি‌রিজ স্থ‌গিত কর‌লো, আগ‌স্টে আস‌ছে না ভারত

প্রকাশিত : ১৯ অক্টোবর, ২০২১, ০১:১৭ দুপুর
আপডেট : ১৯ অক্টোবর, ২০২১, ০১:১৭ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

দীপক চৌধুরী: যত হতভম্বই হই না কেনো, সমস্যার সমাধান আমাদেরই করতে হবে

দীপক চৌধুরী: “বাংলাদেশ হবে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে, হিন্দু তার ধর্মপালন করবে। খ্রিস্টান তার ধর্ম এবং বৌদ্ধও তার ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নেই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে।” কথাগুলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলে গেছেন। কিন্তু এই গত কদিন ধরে যা দেখা গেলো, তাতে নানাপ্রশ্নের জন্ম হয়েছে। এদেশে বার বার সংখ্যালঘুদের ওপর, তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর, ব্যবসা বাণিজ্যের, দোকান-পাটের ওপর, বাড়িঘরের ওপর হামলা হবে কেনো? বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে এমনটা কী কখনো হওয়ার কথা ছিল? কুমিল্লা, সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মুন্সীগঞ্জ, খুলনা, দিনাজপুর, সাতক্ষীরা, ফেনী, নোয়াখালী, রংপুরসহ ২২টি জেলায় হিন্দু মন্দিরে হামলাসহ কিছু কিছু এলাকায় লুটপাট হয়েছে, হত্যা হয়েছে, ভাঙচুর-তাণ্ডব চলেছে। পীরগঞ্জে হিন্দু সম্প্রদায়ের গ্রাম জ¦ালিয়ে দেওয়া হয়েছে। হামলা-লুটপাট-ভাঙচুর-তাণ্ডব এসব শুধু একবারই নয় বহুদিন ধরে এটা চলছে। কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়েছে কী একটি ঘটনায় অপরাধীকেও? হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মন্দির ভাঙলে এটা দেবতাকে অবমাননা করা হয় না? নাকি হিন্দুদের প্রতিমা ভাঙচুরে অবমাননা হয় না বলে কোথাও লেখা আছে? কোন্টি? আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে হিন্দুদের মন্দিরে হামলা হবে, হিন্দুবসত গ্রাম জ¦ালিয়ে দেওয়া হবে এটা কী মেনে নেওয়া যায়? সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। শুনেছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে পীরগঞ্জের হিন্দুপল্লীর বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছেন। বাঙালিরাও দেখছেন, সরকার আন্তরিক। হিন্দুরাও দেখছেন সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে, ‘ভাস্কর্য স্থাপন করা যাবে না’ বলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে কীভাবে। এতোবড় দুঃসাহস ওরা পায় কোথায়? অশুভ শক্তির খুঁটির জোর কোথায়! দেশরত্ন শেখ হাসিনার সরকারকে বিব্রত করতে এবং বিশ^ব্যাপী বাংলাদেশের যে সুনাম অর্জন করেছেন তিনি এটা নষ্ট করতে অশুভচক্র সক্রিয়। সুতরাং পরিকল্পনাকারী ও চক্রান্তকারীদের শুধু চিহ্নিত করলেই হবে না এদের গ্রেপ্তার ও কঠিন বিচার করা সময়ের দাবি। এবার কুমিল্লা-চাঁদপুর-নোয়াখালি-ফেনীসহ বিভিন্ন জেলায় যা হয়েছে তাতে ভয়ংকর লজ্জা হয়। এ লজ্জা শুধু সরকারের একার নয়, আমাদের সবার। কুমিল্লায় গত বুধবার পবিত্র কোরআন অবমাননার খবরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুদের মন্দির, মণ্ডপ ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যেভাবে হামলার ঘটনা ঘটে তা তো এক জঘন্য খেলা। সর্বশেষ গত রোববার রাতে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়া গ্রামে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বসতিতে হামলার ঘটনা ঘটল। সেখানেও মাঝিপাড়া গ্রামের আরেক এলাকার এক কিশোর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননাকর পোস্ট দিয়েছে এমন অভিযোগ তোলা হয়। এলাকায় উত্তেজনা তৈরি হয়। ওই কিশোরের বাড়িসহ আশপাশে পুলিশ রোববার রাতে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। সেখানে যেতে না পেরে উত্তেজিত শত শত লোক পাশের বড় করিমপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের আরেক বসতিতে হামলা চালায়। হিন্দুদের ঘরে আগুন, ভাঙচুর, লুটপাট চলে। সারা রাত ধানখেতে ছিলেন নারী, পুরুষ ও শিশুরা। ফেসবুকে ধর্ম ‘অবমাননার দায়ে’ কিশোরকে ধরেছে পুলিশ। ৬৭ পরিবারের ওপর গত রোববার রাতে যে তাণ্ডব চালানো, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া, ভাঙচুর করা হয়েছে- এতে কার উপকার হয়েছে? এতে সরকারের ক্ষতি হয়েছে। লুট করা হয়েছে গবাদিপশু, টাকা, স্বর্ণালংকার, ইলেকট্রনিক সামগ্রীসহ অনেক কিছু। আগুন দেওয়া হয়েছে মন্দির, মুদিদোকান ও ব্যাটারিচালিত ভ্যানগাড়িতে। যদি কোনো একব্যক্তি অপরাধ করেই থাকে, যদি ঘটনা সত্যি বলেই প্রমাণ হয়- তাহলে চরম শাস্তি দেওয়া হোক তাকে। কিন্তু নিরীহ-নিরপরাধ গ্রামবাসীর অপরাধ কী? তাদের ওপর হামলা কেনো?
এখন নানাধরনের প্রশ্ন উঠেছে যে, যখন হিন্দু মন্দিরে হামলা চালাচ্ছিল দুস্কৃতকারীরা তখন তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা কোথায় ছিলেন? এতো যে একেকজন তৃণমূল নেতা বুক ফুলিয়ে বলেন, আমাদের তৃণমূল এখন অনেক শক্তিশালী। হিন্দু মন্দিরে ও গ্রামে হামলার সময় প্রতিরোধ তো দূরের কথা, শোনা যায়, তারা অনেকে সেসময় দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে দৃশ্যগুলো উপভোগ(!) করেছেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির সংস্কার ও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘এ ঘটনায় কয়েকজনকে ধরা হয়েছে, বাকিদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। পেছনে যে বা যারা জড়িত আছে আমরা তাদের খুঁজে বের করব। এ ঘটনার উদ্দেশ্য হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করা।’ যে ক্ষত হিন্দুদের মনে সৃষ্টি হয়েছে তা কী নতুন করে ঘর বেঁধে দিলেই সারবে? তারা তো একাত্তরে যুদ্ধ করেছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়বার জন্য। দেশে এমন নিন্দনীয় ঘটনার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে হিন্দুসম্প্রদায়ের এককিলোমিটার লম্বা মিছিল থেকে কী বার্তা পাওয়া গেলো!

এই হামলার উদ্দেশ্য কী সেটা আমরা জানি। প্রকৃত কারণ হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করা। কিন্তু এ সুযোগ আমরা কেনো দেবো? ওদের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছি আমরা। ওদের টেনে ঘরে ঢুকিয়ে রাস্তা চিনিয়ে দিচ্ছি। বিএনপি-জামায়াতের চরিত্র কী অজানা? ২০০১-এর অক্টোবরে কী হয়েছিল দেশে? আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জ¦ালিয়ে-পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল, লুট করা হয়েছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পদ। হিন্দু তরুণী, শিশু, নারী ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয়। কারা ঘটাচ্ছিল এটা কী অজানা কারো? কী অপরাধে হামলার শিকার হয়েছিল হিন্দুরা। সেইসব ভয়ংকর পর্বগুলো কেনো আমরা ভুলে গেলাম!

আসলে দীর্ঘদিন ধরে (একটানা ১৩ বছর) মানুষের আকাক্সিক্ষত জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এ সময়টায় কঠিন কোনো সমস্যার মুখে না পড়ায় দলের অনেকে নিজে ও আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে, দলের ভেতর জামায়াত- শিবির -বিএনপির অনুপ্রবেশ ঘটাকে তারা খেয়ালই করেননি। অথবা বিশেষ স্বার্থে এদের দলে প্রবেশের সুযোগ দিয়েছেন। এবং তারাই সুযোগ পেয়ে খেলাটি খেলছে। দোষ হলো কার? সরকারের। অনেকদিন আগের হলেও প্রাসঙ্গিক একটি বিষয় উল্লেখ না করে পারছি না এখানে।

১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণে বলেছেন, ‘কিছু কিছু লোক যখন মধু-মক্ষিকার গন্ধ পায় তখন তারা এসে আওয়ামী লীগে ভিড় জমায়। আওয়ামী লীগের নামে লুটতরাজ করে। পারমিট নিয়ে ব্যবসা করার চেষ্টা করে। আওয়ামী লীগ কর্মীরা আওয়ামী লীগ থেকে তাদের উৎখাত করে দিতে হবে। আওয়ামী লীগে থাকার তাদের অধিকার নাই। তাই বলছি, আত্ম-সমালোচনার প্রয়োজন আছে, আজ আত্মসংযমের প্রয়োজন আছে, আজ আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন আছে।’

২০২১-এ এসে মনে হচ্ছে, আসলে এটা কেনো আমরা ভাবি না, যে আগুনে হিন্দুদের সংসার পুড়েছে, পোষা পশু-প্রাণী লুণ্ঠন হয়েছে, পুড়িয়ে মারা হয়েছে, মনে দগ্ধ ঘা সৃষ্টি হয়েছে তা কী নতুন করে ঘর বেঁধে দিলেই সারবে? অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়বার কথা শুধু মুখে বললেই হবে না। অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়বার জন্য সর্বাগ্রে ও সংবিধানে বিশেষ কোনো ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম করা যাবে না। ১৯৮৮ সালে এরশাদ যে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেছিল, তা বাদ দিতে হবে। ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতে হবে। তৎকালীন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা করায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তিনি তখন ইসলামকে রাষ্ট্রীয়ধর্ম করার বিল উত্থাপনের প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, ‘ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম করার প্রয়োজন পড়ে না।’ ইসলামী সমমনাদলগুলো ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার প্রতিবাদ জানিয়েছিল। এমনকি জামায়াতও। অথচ এখন অনেকেই কথা ঘুরিয়ে বলছেন বা অস্বীকার করছেন সেসবের।

ইতিহাস থেকে আমরা পাই- জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘‘রাজনীতি করতে গেলে নীতি থাকতে হয়, সত্য কথা বলার সাহস থাকতে হয়। বুকে আর মুখে আলাদা না হওয়াই উচিৎ।” এসব কথাই বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির দর্শন।

বিভিন্ন মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর আমাদের বিবৃতিজীবীদের কোনো আওয়াজ পাইনি। অথচ যেদিন সূত্রপাত সন্ত্রাস-তাণ্ডবের সেদিনই এদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক সদস্যের আশা-অপেক্ষা ছিল তাদের পক্ষ থেকে কঠিন বিবৃতি আসবে। কিন্তু বাঙালি হিন্দু অবাক হয়েছে। একজন বিবৃতিজীবী তো লন্ডন থেকে নায়িকা পরীমনির গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন। আমরা খুশি হয়েছিলাম। উদার মানুষ তিনি। সরকার প্রধানকে নাকি টেলিফোনেও অনুরোধ করেন। কিছুদিন আগে পরীমনির জন্য কবিতাও লিখেছেন। অথচ এতোবড় ঘটনায় তিনি নীরব। জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী মিয়া সেপ্পো বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রতিক হামলার স্বাধীন তদন্তেরও আহ্বান জানিয়েছেন।

প্রকৃতপক্ষে দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা, মাঝেমাঝে জিইয়ে ওঠা এ সমস্যা শুধু কী হিন্দু-মুসলমান সমস্যা, নাকি কেবল সরকারের সমস্যা? আসলে এই সংকট সবার, সকল বাঙালির। সুতরাং এ সংকটের সমাধান আমাদেরই করতে হবে, অন্য কারো সমস্যা নয়।

লেখক : উপসম্পাদক, আমাদের অর্থনীতি, সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়