ড. সেলিম জাহান: আমি দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি বরিশালের শঙ্করমঠ বিদ্যালয়ে। সেটি ছিলো কলেজ রোডের মূল রাস্তার পাড়ে, নতুন বাজার আর বি.এম. কলেজের মাঝামাঝি জায়গায়। মূল রাস্তা থেকে নেমে গিয়ে একটি পায়ে চলা পথ ধরে একটি মাঠ এবং ছোট পুকুর পেরিয়ে তবে সে স্কুল। সে পায়ে চলা পথের শুরুতে রিকশা থেকে নামলে মূল রাস্তার উল্টো দিকেই ছিলো মহসীন ভাইদের বাড়ি, যিনি পরে বি.এম. কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি হয়েছিলেন। পায়ে চলা পথের শেষ প্রান্তে ছিলো শঙ্করমঠটি। উচ্চতায় আকাশছোঁয়া এবং পার্শ্বে বিস্তৃত। হলুদ রঙের বাড়িটি, যার মেঝেটি টকটকে লাল। পুরো দরদালানটি পেঁচিয়ে খোলা বারান্দা। সিঁড়ি দিয়ে ওঠেই বারান্দার ওপারেই পূজা ও প্রার্থনাগৃহ। প্রতিমার অধিষ্ঠান ছিলো সে বড় ঘরে। মঠের চারপাশে বড় বড় গাছ, সেখানে মাঝে মাঝে পাখিদের কলরব ও হুটোপুটি। সেসব গাছের মধ্যেই প্রথম হরিতকীর গাছ দেখেছিলাম। হরিতকী (আমরা বলতাম হর্ত্তুকি) খেয়ে জল খেলে মিষ্টি লাগতো। মঠের পেছনে ঘন বনজঙ্গল আর খাল। লাল ঠান্ডা মেঝে, লম্বা গাছেদের ছায়া আর চারদিকের নিস্তব্ধতা মিলে কী যে এক শান্ত সমাহিত চারপাশ।
মঠের সামনের মাঠের বাঁদিকে ছিলো মঠের সেবাইতের বাড়ি। সেখানে মাঝে মাঝে আমরা জল খেতে যেতাম। আর মাঠের ডানদিকেই আমাদের একচালার স্কুল ঘর। একটাই বড় ঘর তার নানা জায়গায় নানা শ্রেণি প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি। ঘরের মধ্যে বিভাজন ছিলো না কোনো তাই এক শ্রেণিতে যখন সুর করে নামতা শেখানো হচ্ছে, অন্য ক্লাসে তখন ইতিহাস পড়ানো হচ্ছে। কিন্তু কোথাও কোনো হট্টগোল নেই। স্কুলে শিক্ষক ছিলেন সর্ব সাকুল্যে তিনজন। হেড স্যার টুনু সোম, সেকেন্ড স্যার অমূল্য বাবু, আর থার্ড স্যার অতুল বাবু। ছোটোখাটো সেকেন্ড স্যার অমূল্য বাবু সারা স্কুলে পরিচিত ছিলেন তার বেতের জন্য। ছাত্রদের কাছে তিনি ছিলেন এক মূর্তিমান বিভীষিকার মতো। থার্ড স্যার অতুল বাবু ছিলেন নরম মনের ভারি শান্ত এক ব্যক্তিত্ব ছাত্ররা তাকে ভারি ভালেবাসতো। পরবর্তী জীবনে তিনি বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। অতুল বাবুকে নিয়ে আমি অন্যত্র লিখেছি। হেড স্যার টুনু সোম ছিলেন পাতলা ছিপছিপে। ভাঙা মুখে বসন্তের দাগ পান চিবুতেন সর্বদাই। সাদা ধুতি আর তার ওপরে সাদা পুরো হাতের জামা। সে হাতা তিনি গুটিয়ে নিতেন কনুই পর্যন্ত। তার জামা-কাপড় ছিলো পাট-ভাঙা।
একটু খ্যানখ্যানে গলার হেড স্যার বই পড়তে হলে চশমা পরতেন নইলে নয়। টুনু সোমের অনুজ ছিলেন সুখেন্দু সোম বাবার সহকর্মী বি.এম. কলেজে। অঙ্কের জাদুকর অধ্যাপক সুখেন্দু সোম পরবর্তী সময়ে বি.এম. কলেজে আমার শিক্ষক ছিলেন। খুব সহজ বাংলায় অংক ও বিজ্ঞানের ওপরে খুব রসালো ভাষায় প্রবন্ধ লিখতেন। বি.এম. কলেজের বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকা’ বিজ্ঞান সাময়িকী’র সম্পাদক ছিলেন তিনি বহুদিন। তার সব কিছুই ছিলো ঝড়ের গতিতে চলন-বলন সব। অংক করাতেন ঝড়ের গতিতে তাল রাখতে আমরা হিমশিম খেতাম। টুনু সোম ছিলেন সারাজীবন অকৃতদার। ষাটের দশকের শেষ পর্যন্ত সুখেন্দু সোমও ছিলেন তাই (পরে অবশ্য তিনি বেশ বয়সে এক সুন্দরী যুবতীর পাণিগ্রহণ করেছিলেন বলে শুনেছি)। দু’ভাইয়ে বেশ ভাব ছিলো একেবার বন্ধুর মতো। হাসিঠাট্টা করতেন নিজেদের মধ্যে আমাদের উপস্থিতিতেই। রোজ বিকেল বেলা দু’ভাই বেশ সেজেগুজে বেড়াতে বেরুতেন। আমরা জানতাম আড্ডা দিতে নিন্দুকেরা বলতো তারা যেতেন নিজ নিজ প্রেমিকার কাছে। তিনজন শিক্ষকের শঙ্করমঠ বিদ্যালয়ে সেকেন্ড স্যার অমূল্য বাবু আমাদের করাতেন অংক, অতুল বাবু পড়াতেন বাংলা।
হেড স্যার টুনু সোম সব ক্লাসে ইংরেজি পড়াতেন। অমূল্য বাবু অংক কষাতেন অত্যন্ত যান্ত্রিকভাবে, খুবই দরদ দিয়ে বাংলা পড়াতেন অতুল বাবু। হেড স্যার টুনু সোমের পড়ানোর দিকে একেবারেই মন ছিলো না। হেড স্যার ক্লাসে ঢুকেই গল্প করতে ভালোবাসতেন। না, তিনি নিজে গল্প বলতেন না ছাত্রদের গল্প শুনতে চাইতেন। এই যেমন, তাদের বাড়ি কেমন, পরিবারের কী অবস্থা, বাড়িতে কী রান্না হয়, ইদানীং বাড়িতে কোনো গণ্ডগোল হয়েছে কিনা এসব খুঁটিনাটি বৃত্তান্ত। তা ছাড়াও খুব অদ্ভুত অদ্ভুত বিষয়ে তার খুব আগ্রহ ছিলো এই যেমন আমরা কেউ কখনো ভূত দেখেছি কিনা, তান্ত্রিকদের পাল্লায় কখনো পড়েছি কিনা, নরপিচাশ বলে কিছু আছে কিনা এসব। প্রায়শই গল্প বলার জন্য তিনি বেছে নিতেন কাশীপুরের জুড়ান মুখার্জ্জীর পুত্র বাবুল কিংবা ওখান থেকেই আগত মিনুকে, অথবা আমাকে। বাবুলের পিতা জুড়ান মুখার্জ্জী জমিদার শ্রেণির লোক ছিলেন কাশীপুরে তার বিশাল ইমারত-বাগানবাড়ি ও বন-জঙ্গল ঘেরা।
সুতরাং ওই সবের ওপরে ভিত্তি করে বাবুল বেশ ভূত-প্রেতের গল্প জমিয়ে তুলতো। ফর্সা রঙের, নরম-শরম, ঘন কোঁকড়ানো চুলের মিনু বলতো তাদের বাড়ির ঘর-গেরস্থালীর গল্প। আর আমি বলতাম নানা বই থেকে পড়া গল্পের ওপরে ভিত্তি করে নানা বানানো গল্প। এমনি করেই হেড স্যার গড়ে তুলতেন তার ‘গল্প-দাদুর আসর’। বলতে দ্বিধা নেই, নানা বুদ্ধি-বৃত্তি বিষয়ে আমার ঘাটতি থাকলেও, কল্পনার খামতি আমার কখনো ছিলো না। হেড স্যারের সেই গল্প বলার আসর আমাকে ওই কল্পনার ফানুস নানা রঙে রঙিন করে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করলো। আমার বলন-লেখনের নানা দ্বিধা, নানা কমতি, নানা বাধা ওৎরাতে উৎসাহিত করলো। পরবর্তী জীবনে যেটুকু বলা বা লেখার ক্ষমতা অর্জন করেছি, তার সূতিকাগার কিন্তু ওই আসর। শঙ্করমঠ স্কুলে আমার প্রধান শিক্ষক টুনু সোমের কাছে তাই আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আজ তিনি আর নেই, কিন্তু কখনো কখনো তাকে বড় মায়াময়ভাবে আমার মনে পড়ে যায়। লেখক: অর্থনীতিবিদ