আহসান হাবিব : একটি নদীর নাম কী করে এতো সুন্দর হয়Ñ ‘মহানন্দা’। কে রেখেছিলো এই নাম নদীটির? নিশ্চয়ই কোনো এক মানুষ, কিংবা অনেক মানুষ মিলে। কিংবা যমুনা, বিশাল এই নদীটির নাম যখন উচ্চারিত হয়, তখন শুধু নদীর রূপ নয়, নামকরণের ধ্বনির মধ্যে যে সৌন্দর্য ফুটে ওঠে, তুলনা তার নাই। নামকরণের মধ্য দিয়ে মানুষের যে শিল্পচেতনা, যে নান্দনিক বোধ প্রকাশ হয়, আশ্চর্য হতে হয়। তখন ভাবতে বসি এই মানুষ কী করে খুনি হয়, কী করে ধর্ষক হয়, নিন্দুক হয়?
শৈশব থেকে শুনে আসছি বাংলাদেশ তেরশ নদীর দেশ। প্রকৃত প্রস্তাবে খাঁটি একটি নদীমাতৃক দেশ। এখন নাকি ছোট বড় মিলিয়ে আটশ নদ-নদী বয়ে চলেছে, দেশের প্রায় ২৪,১৪০ কিলোমিটার জায়গা দখল জুড়ে। নদী আমাদের জীবনে এমনভাবে জড়িয়ে আছে, ভুলে থাকার কোনো পথ নেই । নদীতে বাংলাদেশের কোনো মানুষ একবার স্নান করেনি, কিংবা মাছ ধরেনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার।
নদীর নাম এক একটি শিল্প, এক একটি কবিতার মতো। তার বয়ে চলার ছন্দ যেন এসব নামকরণের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠে। যখন উচ্চারণ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ হৃদয়ে ছন্দ দোল খায়, আবার যখন বলি ধানসিঁড়ি, জীবনানন্দ ভেসে ওঠে, ভেসে ওঠে একটি সিঁড়ি, যার ধাপ ক্রমশ নীচে নামতে নামতে নদীর জলে গিয়ে মিশেছে। মানুষ নামের আশ্চর্য শৈল্পিক এক প্রজাতি নদীর নাম রেখে নদীগুলোকে অমর করে রেখেছে। তার চেয়েও আশ্চর্য যখন দেখি এই মানুষ নদীকে নিজ হাতে খুন করছে, নদীর ওপর নির্মাণ করছে নানা স্থাপনা, তখন তার এই দ্বিমুখী সত্তায় মন বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
ধলেশ্বরী, আড়িয়াল খা, পুনর্ভবা, আত্রাই, কুশিয়ারা, পদ্মা, মেঘনা, বুড়িগঙ্গা, কর্ণফুলী, গড়াই, তিস্তা, তুরাগ, পাগলা, তোড়সা, ডাকাতিয়া, রূপসা, ইছামনি, কংস, ভৈরব, ব্রহ্মপুত্র, জলঢাকা, কপোতাক্ষ, বংশী, সুরমা, সোমেশ্বরী এমন থোকা থোকা নাম আমাদের নদীগুলির। ফুলের নাম, নদীর নাম, একটি স্থানের নাম, একটি নয়া আবিষ্কৃত নক্ষত্র কিংবা গ্রহের নামকরণে মানুষ যে সৌন্দর্যবোধের পরিচয় রাখে, আহা যদি সে সবকিছুতে এমন শৈল্পিক হতো, এই পৃথিবী হতো একটি শিল্পগ্রহ। লেখক : ঔপন্যাসিক