অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন: অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্থক্য হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়া হয় না, গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান সৃষ্টিও করা হয়। এই কাজটির গুরুত্ব অপরিসীম। ইনফ্যাক্ট জগতের সকল ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে গবেষক হিসেকে প্রার্থী কেমন এই বিচারেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয়। একজন প্রার্থী গবেষক হিসেবে কতো ভালো সেটাই হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ এবং তদপরবর্তী প্রমোশনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। অথচ আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই গবেষণাকেই সবচেয়ে বেশি অবহেলা করা হয়। শিক্ষকদের কর্মঘণ্টা নির্ধারণে গবেষণাকে হিসেবেই ধরা হয় না। প্রমোশনে কারও যদি ন্যূনতম গবেষণা পত্রের সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি গবেষণা পত্র থাকে তাকে বিশেষ বিবেচনায় শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাকে ডিঙিয়ে উচ্চতর পদে প্রমোশন দেওয়া হয় না। গার্বেজ জার্নাল আর নেচারে প্রকাশনা এক পাল্লায় মাপা।
এসব যেই বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় সেই বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে ভালো করবে? সমস্যাটা কোথায়? সমস্যা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতন্ত্র। গণতন্ত্রে মিডিওক্রেসির জয়জয়কার। একাডেমিয়াতে গণতন্ত্রের স্থান নেই। এখানে যুক্তি। ১০ জনও যদি যুক্তি সম্মত কথা বলে আর ৯০ জন অযৌক্তিক কথা বলে সেই দশ জনের কথাই মেনে নিতে হবে। সমস্যা হলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নেতৃত্বে যারা তাদের প্রায় কেউই ভালো গবেষক নয়। ইন ফ্যাক্ট, আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকই গবেষণায় সম্পৃক্ত না। ফলে শিক্ষক সিমিতির মাধ্যমে শিক্ষক প্রমোশন নীতিমালার বার দিন দিন নিচে নামিয়েছে। অথচ একটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পূর্ব শর্ত হলো নিয়োগ ও প্রমোশন নীতিমালার বার উপরে তোলা। আমরা কেন নিচে নামিয়েছি কারণ নির্বাচন মানেই তুষ্টিকরণ। অধিকাংশকে তুষ্ট করতে হলে এটাই করতে হবে। অথচ উচিত হলো বার যেমন উপরে তোলা একই সঙ্গে বেতন সুবিধাদি বাড়ানো।
একটা সময় ছিলো যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন বেশি ছিলো। আর আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনের তিনভাগের এক ভাগের সামান্য বেশি। অথচ কলকাতায় জীবন যাপনের ব্যয় ঢাকা থেকে কম। কলকাতায় কি শুধুই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন বেশি? না। প্রাথমিক থেকে শুরু করে সকল স্তরের শিক্ষকদের বেতন পশ্চিমবঙ্গে ঢাকা থেকে বেশি। ইনফ্যাক্ট, শিক্ষকদের বেতনের কথা বললে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন তলানির দিকে। শুধুই কি বেতন কম? না অন্যান্য সুবিধাও কম। আবার যাতনা সবচেয়ে বেশি। শিক্ষায় গুরুত্ব না দিলে এই দেশ কোনোদিন উন্নত হবে না। এই কথাটা বুঝতে না পারাও প্রমাণ করে আমাদের নীতিনির্ধারকরা কতোটা অজ্ঞ। লেখক: শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়