আহসান হাবিব: অনেক মানুষ প্রেমকে কাম থেকে বিযুক্ত করে একটি ‘পবিত্র’ স্থানে দেখতে চায়। যেন প্রেম শরীর বহির্ভূত একটা অস্তিত্ব, যেমন আত্মা। এটা সেই বিতর্ক- ভাববাদ বনাম বস্তুবাদ। প্রকৃত প্রস্তাবে ফুলের সুবাস একটি অনু, আমাদের নাকে এসে বিঁধে, আমাদের ঘ্রাণেন্দ্রিয় তাকে সঠিক শনাক্ত করে এবং চিত্তে আনন্দ জাগায়। এখন যদি ফুলটি না থাকে, বাতাসে কে ছড়াবে অনু আর নাকে এসে বিঁধবে অমন পাগল করা সুবাস।
আমাদের মনে যখন প্রেমের অনুভূতি জাগ্রত হয়, কী ঘটে? একটি অনির্বচনীয় ভালো লাগার অনুভূতির উদ্রেক হয়, যেমন আমরা ফুলকে দেখে মুগ্ধ হই। ফুল ছেড়ে যদি আমরা মানব প্রেমে আসি, দেখবো একজন নারী যখন কোনো পুরুষকে কিংবা বিপরীত, দেখে প্রেমাসক্ত হয়, ফুলের যেমন সুবাস নিতে চাই, হাতে নিয়ে নাকের কাছে নিতে চাই, ঠিক তেমনি প্রেমাস্পদকে ছুঁয়ে দেখতে চাই, গন্ধ নিতে চাই। এই আকাক্সক্ষা আমাদের মনের ভেতরে জাগ্রত হয়। যদি এই জাগরণ না ঘটে, বুঝতে হবে প্রেমানুভূতির স্ফুরণ ঘটেনি। আর যদি জাগে, আমরা যেহেতু মানুষ, সভ্য হয়ে ওঠা আমাদের অন্বিষ্ট, আমরা সেই জেগে ওঠা ভাব গোপন রেখে আমরা চোখ দিয়ে, না ছুঁয়ে শরীরী ভাষা দিয়ে বুঝিয়ে দিই- আমি মুগ্ধ ।
এই যে আমরা আমাদের ইচ্ছাকে দমন করলাম, এটা সভ্যতার দান কিংবা বলি। কিন্তু আমাদের মনের ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে প্রেমাস্পদকে ছুঁয়ে দেখার অপ্রতিহত কামনা। এটা প্রেমের প্রথম পর্ব। না ছুঁয়ে ভাললাগার অনুপম প্রকাশ। সময় যতো যেতে থাকে আমাদের মুগ্ধতা বেড়ে চলে, আমরা কাছাকাছি হই, আমরা ছুঁয়ে দেখি। এই ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছাকেই আমরা বলছি যৌনতা। যৌনতা যদি একটি ফুল হয়, তবে তার সুবাস হচ্ছে ছুঁয়ে দেখা কিংবা তাকিয়ে থাকা কিংবা ভাবা। কিন্তু আমরা যেহেতু সভ্য হয়ে উঠছি, নির্মাণ করেছি সংস্কৃতি, আমাদের এই ইচ্ছা প্রকাশের তাই থাকে একটি নান্দনিকতা। আমরা আমাদের যৌনতা কেন্দ্রিক আকাক্সক্ষাগুলো প্রকাশ করি সবচাইতে সুন্দর রূপে- আড়ালে, একান্তে, কাব্যে সংগীতে।
কোথা থেকে আসে এই যৌনতার আকাক্সক্ষা? ফুলের মধ্যে যেমন ধারিত থাকে সুবাস, দল মেলে ফুটে গেলে ছড়িয়ে পড়তে চায়, একসময় বাতাস ছড়িয়ে দেয়, আমরা পাই, ঠিক তেমনি শরীর প্রস্তুত হয়ে গেলে সেও প্রকাশিত হতে চায়। শরীর নিঃসরণ করে বিশেষ একটি হরমোন-টেস্টোস্টেরন। এটা এমনি এক বস্তু যা আমাদের যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা সাড়া দিই। এটা প্রকৃতির একটি মহান অভিপ্রায় এবং উদ্দেশ্য। আমরা আমাদের ইচ্ছানিরপেক্ষভাবে সেই উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়নে তৎপর হয়ে উঠি। এটাই স্বাভাবিক এবং সুন্দর। এটা আমরা করি আমাদের প্রেমাস্পদককে ঘিরে। আমরা যখন পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হই, কাছাকাছি আসি, ভেতরে ফল্গুধারার মতো বয়ে চলা আকাক্সক্ষা আমাদের চালিত করে এক অপরকে ছুঁয়ে দেখতে, আমরা ছুঁই, আনন্দে উদ্ভাসিত হই। খুব স্বাভাবিক এই ক্রিয়া।
কিন্তু এই স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। প্রেমের অপরূপ প্রকাশ যৌনতার প্রতি নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করে একে ‘ঠিক’ ‘বেঠিক’ ‘পবিত্র’ ‘অপবিত্র’ ইত্যাদি নানাভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। নৈতিকতার ধুয়া তুলে মানুষের ভেতর জাগিয়ে তোলা হয়েছে নানা বিকৃতি। এর পেছনে কাজ করেছে মূলত ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ এবং রাজনীতি। ধর্ম এর প্রধান হোতা। এই রাজনীতির প্রধান কথা হলো অধীনস্ত করা। একটি অলৌকিক শক্তির কথা বলে ভীতির সঞ্চার করা। আশ্চর্যের বিষয় তারা সফল এই কাজে। তাই দেখি প্রেমের কথা উঠলেই এরা নাক সিটকায়, কামের সঙ্গে একে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে চেয়ে জোর খাটায়। মানুষ বিভ্রান্ত হয়, নিজের প্রকৃতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়, অবদমিত হয় এবং একটি ভুল ধারণা নিয়ে অন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রেম একটি স্বাভাবিক মানসিক আকাক্সক্ষার প্রকাশ, যৌনতা তার প্রেষণা, কামক্রিয়া তার অনুপম পরিসমাপ্তি। এটি চলমান। প্রেম মানেই কাম, কামহীন প্রেম অপ্রাকৃতিক, অসুন্দর, অনভিপ্রেত। লেখক: ঔপন্যাসিক