বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা এমনই ঘনিষ্ঠ ছিলেন যে তাদের একজন থেকে আরেকজনকে আলাদা করা যায় না। একেবারে ছোটবেলায় তাদের বিয়ে হয়েছিলো। বঙ্গমাতা তখন একেবারেই শিশু। তার ডাক নাম রেনু। বঙ্গবন্ধুর বয়সও তখন মাত্র ১৩ বছর ছিলো। সেই সময় থেকে একদম মৃত্যু পর্যন্ত একসঙ্গে ছিলেন তারা। সেইদিক থেকে বলা যায়, বঙ্গমাতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জীবন-মরণের সাথী। জীবনের প্রতিটি বাঁকে তাকে যেমন তিনি পেয়েছেন সুসময়ে-দুঃসময়ে, একদম মৃত্যুর সঙ্গেও আলিঙ্গণ করেছেন একইসঙ্গে। ১৫ আগস্ট তাদের দুজনেরই একসঙ্গে পৃথিবী থেকে শারীরিকভাবে চলে যাওয়া। মানসিকভাবে তারা দুজনেই আমাদের সঙ্গে আছেন। বঙ্গমাতা সম্পর্কে কিছু বলার আগে আমি বঙ্গবন্ধুর মুখ দিয়েই তার সম্বন্ধে কিছু বলি। ১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এলেন। তার দেড় মাস পরেই ২৬ মার্চ ১৯৭২ সালে তিনি আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন জাতীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থা আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে। সেখানে মেয়েরা কুচকাওয়াচ করেছে। সেটা দেখে তিনি খুব সন্তুষ্ট হয়েছিলেন, তখন নারীর ভূমিকার ওপর বেশকিছু কথা বলেছেন। সেই কথা বলবার সময় বঙ্গমাতা সম্বন্ধে কিছু কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘ঘরের আলোর একটা অংশ নারী। আমি দেখেছি আমার জীবনে, যে নারী তার স্বামীকে এগিয়ে দেয় নাই সেই স্বামী জীবনে বড় হতে পারে নাই। আপনারা এমনভাবে গড়ে উঠুন যে, আপনারা এমন মা হবেন, এমন বোন হবেন যা আপনাদের আদর, আপনাদের ভালোবাসা, আপনাদের মনে যে স্বতস্ফূর্ততা তা দিয়ে ভবিষ্যৎ বংশধরদের গড়ে তুলবেন। আমি জীবনে অনেক দেখেছি যে গুলির সামনে আমি এগিয়ে গেলেও কোনোদিন আমার স্ত্রী আমাকে বাধা দেয় নাই। এমনও আমি দেখেছি যে, অনেকবার, আমার জীবনে ১০-১১ বছর আমি জেলই খেটেছি। জীবনে কোনোদনি মুখ কালা করে প্রতিবাদ করে নাই। তাহলে আমার জীবনে অনেক বাধা আসতো। এমন সময়ও আমি দেখেছি যে, আমি যখন জেলে গিয়েছি, আমি এক আনা পয়সাও দিয়ে যেতে পারি নাই আমার ছেলেমেয়ের জন্য। আমার জীবনে তার অনেক অবদান রয়েছে। পুরুষের নামে ইতিহাসে অনেক লেখা হয়। মহিলাদের নাম লেখা হয় না। সেজন্য আইজকা আপনাদের কাছে একটা ব্যক্তিগত কথা বললাম। যাতে পুরুষ ভাইরা কোনোরকমের সংগ্রাম করে নেতা হন বা দেশের কর্ণধার হন। তাদের মনে রাখা উচিত তাদের মহিলাদেরও যথেষ্ট দাম রয়েছে এবং তাদের স্থান দিতে হবে। এজন্যই আজ আপনাদের আন্তরিক ধন্যবাদ দিচ্ছি।’এই যে স্বীকৃতি। এই কথাগুলোর মাধ্যমে বঙ্গমাতা যে বঙ্গবন্ধুর জীবনে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন সেটার একটা স্বীকৃতি তার মুখ থেকেই আমরা জানতে পারলাম।
এটা একদিনে গড়ে উঠেনি। আমরা বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী থেকে জানতে পারি। ছোটবেলা থেকেই বঙ্গমাতা তার জন্য অনেক করতেন। শুধু ব্যক্তিগত জীবন নয়, জাতির পিতার রাজনৈতিক জীবনেও নানাভাবে বঙ্গমাতার অবদান রয়েছে। আমরা জানি, ১৯৫৮ সালে যখন বঙ্গবন্ধু জেলে যান সেই সময় ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জীবনে নেমে এসেছিলো এক বিরাট দুর্ভোগ। এই দুর্ভোগ তাকে অবশ্য বরাবরই পোহাতে হয়েছে। জীবনের বেশির ভাগ সময় সেই সময়ের শেখ মুজিবুর রহমান এবং আজকের বঙ্গবন্ধু রাজপথে, সভাসমাবেশে, মিটিংয়ে-মিছিলে, জেলে কাটিয়েছেন। তার জীবনসঙ্গীনী শুধু তার প্রতিক্ষায় প্রহর গুনেছেন। একইসঙ্গে সামলেছেন তার নিজের সংসার এবং ব্যাপক পরিসরে দলীয় সংসার। তিনি রাজনৈতিক সংসারটাও বঙ্গবন্ধুর হয়ে পরিচালনা করেছেন। দলের কর্মীদের ছিলেন তিনি বড় আশ্রয়দাত্রী। সন্তানদের গড়ে তোলার পাশাপাশি দলকে দেখভালের কাজেও তিনি ছিলেন সমান সক্রিয়। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু অবশ্যই তার স্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ করতেন। তাই ফজিলাতুন নেছা হয়েছেন বঙ্গমাতা। স্বদেশকে তিনি তার সন্তানের মতোই ভালোবেসেছেন। বঙ্গবন্ধুর জীবনে শেখ ফজিলাতুন নেছার অবদানের কথা তাই বলে শেষ করা যাবে না।
সেই ছোট্ট বয়সেই বিয়ে হয়েছিলো তাদের। তারপর কলেজে উঠেই শেখ মুজিব কলকাতা পড়তে গেলেন। দেশভাগের পর ঢাকায় এসে শুরু করলেন সার্বক্ষণিক রাজনীতি। সারা প্রদেশ চষে বেড়াচ্ছিলেন তখন। একদণ্ড সময় নেই স্ত্রী-সন্তানদের জন্য। বাকিটা সময় জেলেই কাটিয়েছেন। জেলই ছিলো তার দ্বিতীয় বাড়ি, এটা আমরা সবাই জানি। ১৯৫৪ সালে বঙ্গবন্ধু প্রথমবার মন্ত্রী হওয়ার সময় বেগম মুজিব এসেছিলেন ঢাকায় সংসার পাতবেন বলে। কিন্তু সেই মন্ত্রিত্ব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। মাত্র কয়েকদিন তিনি মন্ত্রী ছিলেন। এক দুর্যোগপূর্ণ সময়ে তিনি মন্ত্রিত্বের শপথ নিয়েছিলেন। শপথগ্রহণ করে তিনি গভর্নর ভবন থেকেই চলে গিয়েছিলেন আদমজিতে। কারণ সেখানে পাকিস্তানি চক্রের ষড়যন্ত্রে বাঙালি-অবাঙালিদের দাঙ্গা শুরু হয়েগিয়েছিলো। সন্ধার পর ঢাকা শহরে ফিরেও তিনি দেখলেন যে বাঙালি-অবাঙালির দাঙ্গা চলছে। তিনি তাই দৌঁড়ে বেড়াচ্ছিলেন নানা জায়গাতে। এর কিছুদিন পরই মন্ত্রিসভা বাতিল হয়ে গেলো। মন্ত্রিসভা বাতিল হওয়ার আগে তিনি করাচি গিয়েছিলেন তখনকার মুখ্যমন্ত্রী শের-ই বাংলা একে ফজলুল হককে নিয়ে। করাচিতে গিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন যে এই সরকারের বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র হচ্ছে এবং যেকোনো সময় সরকারের পতন হবে। তিনি ফিরে এসে দেখলেন তার স্ত্রী তখনো ভালো করে সংসার পাততে পারেনি। তাই তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, পৃষ্ঠা ২৭০ এ - ‘আর বোধহয় দরকার হবে না, কারণ মন্ত্রিসভা ভেঙে দেবে, আর আমাকেও গ্রেপ্তার করবে। ঢাকায় কোথায় থাকবা? বোধহয় বাড়িই চলে যেতে হবে। আমার কাছে থাকবা বলে এসেছিলা। ঢাকায় ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ হবে, তা বোধহয় হলো না। নিজের হাতের টাকা পয়সাগুলোও খরচ করে ফেলেছো।’
সেদিন দুপর বেলায় তিনটা সময় টেলিফোন এলো যে ৯২ এর ‘ক’ ধারায় পূর্ব বাঙলার মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। রাতে ফিরে এলেন, সন্তানরা ঘুমিয়ে পরেছে। তখন পুলিশ এসে গেছে তাকে গ্রেপ্তার করতে। তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে ফোন করে গাড়ি পাঠাতে বলনেন। গাড়ি এলো। বাচ্চাদের ঘুম থেকে ওঠাতে দিলেন না। স্ত্রীকে শুধু বললেন, ‘তোমাকে কী বলে যাবো। যা ভালো বুঝ, করো। তবে ঢাকায় থাকলে কষ্ট হবে। তার চেয়ে ভালো বাড়ি চলে যাও।’ কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সেই অনুরোধ বঙ্গমাতা রাখতে পারেনি। কারণ বঙ্গমাতা চাইতেন তার ছেলেমেয়ের ঢাকাতেই পড়াশোনা করাতে। বঙ্গবন্ধু তার বন্ধু ইয়ার মোহাম্মদ খানকে তার স্ত্রী যদি বাড়িতে যেতে না চান তাহলে তাকে একটা বাড়ি ভাড়া করে দিতে। সেটা তিনি করেছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর বেগম মুজিবকে নিয়ে তিনি যখন জেলগেটে গিয়েছিলেন তখন তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। তখন আতাউর রহমান খানের সঙ্গে বেগম মুজিব দেখা করেন এবং জেলখানায় গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন। গোয়েন্দা প্রতিবেদনের চতুর্থ খণ্ডে বলা হচ্ছে, বঙ্গমাতাকে বঙ্গবন্ধুকে বলছেন, ‘তুমি এতো কষ্ট করছো ঢাকায়, তুমি বরং গ্রামেই চলে যাও।’ বঙ্গমাতা বলেছেন, ‘ না। ঢাকা যতো কষ্টই হোক, আমি ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঢাকাই থাকবো।’
এরপর শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৬ সালে আবার মন্ত্রী হয়েছিলেন দ্বিতীয় দফায়। ছেলেমেয়েদের নিয়ে খানিকটা স্বস্তিতে সংসার পেতেছিলেন। কিন্তু সেটাও খুব বেশি এগোয়নি। তারপর মার্শাল ল’ এলো। তিনি মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিলেন এবং তারপরে তাকে গ্রেপ্তার করা হলো। সেই গ্রেপ্তারের পর আমরা জেনেছি যে কীভাবে, কী কষ্ট করে তিনি সংসার চালিয়েছেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং কারাগারের রোজনামচাতে বঙ্গবন্ধু নিজেই লিখেছেন তার প্রিয় রেনুর কথা। এই দুটি গ্রন্থ পাঠ করলে বুঝা যায় কতোটা গভীর ছিলো তাদের সম্পর্ক। বঙ্গমাতাই বঙ্গন্ধুর জন্য খাতা কিনে নিয়ে যেতেন জেলখানাতে। সেই খাতাগুলো দিয়ে তাকে বলতেন, তোমার যা মনে আসে তাই তুমি লিখবে। সেই লেখাগুলো আবার সংগ্রহ করে আনতেন। খাতাগুলো ভাগ্যক্রমে হারিয়ে যায়নি। একাত্তরে বাড়ি আক্রান্ত হওয়ার পরও তার বড় কন্যা শেখ হাসিনার হাতে সে লেখাগুলো এসেছিলো এবং সেই লেখাগুলো এসেছিলো বলেই আমরা অজানা ইতিহাস জানতে পারি। অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং অন্যান্য প্রকাশনাগুলো দেখতে পাচ্ছি। এই মহিয়সী নারীর অসামান্য অবদানের কথা তাই আমরা কী করে ভুলে যাই। দু’বার মন্ত্রী হওয়া ছাড়াও বঙ্গবন্ধু বীমা অফিসে চাকরি নিয়েছিলেন। ষাটের দশকের শুরুতে যখন আইয়ুব খানের জেল থেকে বের হয়ে আসেন। রাজনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ড তিনি করতে পারতেন না। বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। তখন তিনি একটি বীমা কোম্পানিতে চাকরি নিলেন এবং সেই সময়টায় কিছুটা স্বস্তি এসেছিলো।
বঙ্গবন্ধু সবসময় তার পিতা এবং স্ত্রী- এই দুজনের কাছে অর্থ পেতেন। যেটা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও লেখেছেন। ‘আমার কোনো টাকার প্রয়োজন হলে আমাকে রেনু টাকা দিতো। রেনু যা কিছু যোগাড় করতো, বাড়ি গেলে আমাকেই দিতো, কোনোদিন আপত্তি করেনি। নিজে মোটেও খরচ করতো না। গ্রামের বাড়িতে থাকতো। আমরা জন্যই রাখতো।’ গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও বলা আছে, পিতা ও স্ত্রীর সম্পত্তি থেকে যে আয় আসে তা থেকে শেখ মুজিবুর রহমান মাসিক একটা ভাতা পান। তা দিয়েই তিনি চলেন। এতোটাই স্বচ্ছ ছিলো বঙ্গবন্ধুর জীবন। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতির অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ তিনিই দিতেন। ১৯৫৮ সালে বঙ্গবন্ধু সামরিক আইনে গ্রেপ্তার হলে, বঙ্গমাতা সেগুনবাগিচায় ছোট্ট একটা বাসা বাড়া নেন। ১৯৬১ সালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি মূলত তিনিই গড়েছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর, রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তিনি কখনোই বঙ্গভবনে যাননি। নিজের হাতে গড়া এই বাড়িটিতেই পুরো পরিবার নিয়ে স্বামীর সঙ্গে শেষ পর্যন্ত তিনি ছিলেন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন। সুতরাং সেই অর্থে তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জীবন মরণের সাথী।
রাজনৈতিক জীবনে শেখ মুজিবুর রহমান যখন জেলে ছিলেন, বেগম ফজিলাতুন্নেছা তখন ছেলেমেয়েদের নিয়ে প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন এবং সেইসব কথা বঙ্গবন্ধু তার কারাগারের রোজনামচায় লিখেছেন। সেগুলো বিমর্ষতায় ভরা। ১৯৬৭ সালে জেলে থাকার সময় তিনি লিখেছেন, ‘১১ তারিখ রেনু এসেছে ছেলেমেয়েদের নিয়ে দেখা করতে। আগামী ১৩ তারিখে ঈদের নামাজ। ছেলেমেয়েরা ঈদের কাপড় নেবে না, ঈদ করবে না, কারণ আমি জেলে। এদের বললাম তোমরা ঈদ উদযাপন করা। এই ঈদটা আমি ছেলেমেয়ে নিয়ে আমি আমার আব্বা ও মায়ের কাছেই পরে থাকবো। ছোটো ভাই খুলনা থেকে এসেছিলো আমাকে নিয়ে বাড়ি যাবে। কারণ কারও কাছে শুনেছিলো ঈদের পূর্বেই আমাকে ছেড়ে দেবে। ছেলেমেয়েদের মুখে হাসি নাই। ওরা বুঝতে শিখেছে। রাসেল ছোট্ট তাই এখনো বুঝতে শিখে নাই। শরীর ভালো না। কিছুদিন ভুগছে। দেখা করতে এলে রাসেল আমাকে মাঝে মাঝে ছাড়তে চায় না। তার কাছ থেকে বিদায় নিতে কষ্ট হয়। আমিও বেশি আলাপ করতে পারলাম না। শুধু বললাম, চিন্তা করিও না। জীবনে বহু ঈদ এই কারগারে আমাকে কাটাতে হয়েছে। আরও কতো কাটাতে হয় ঠিক নাই। তবে কোনো আগাতেই আমাকে হটাতে পারবে না। খোদা সহায় আছে। ওদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় রেনুকে বললাম, বাচ্চাদের সবকিছু কিনে দিও, ভালো করে ঈদ করিও, না হলে ওদের মনে ছুটো হয়ে যাবে।’ এমন দুঃখেই শেখ মুজিবের জীবন কেটেছে জেলখানায়। আর তার সমগ্র দুঃখের ভাগিদার ছিলেন তার প্রিয় রেনু।
বঙ্গবন্ধু যখন জেলে ছিলেন বেগম ফজিলাতুন নেছা যে চাইলেই তার সঙ্গে দেখা করতে পারতেন তা নয়। জেল কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখতে হতো। কখনো সেই আবদেন বাতিলও হয়ে যেতো। তখন আবার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে তিনি চিঠি লিখতেন। গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলো দেখলে চোখে জল এসে যায়। স্বামীর সঙ্গে দেখা করবার জন্য কতোই কাঠখড় তাকে পোড়াতে হয়েছে। আমরা আরও লক্ষ্য করেছি। অনেক সময় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে লিখছেন বঙ্গমাতা, ‘আপনার অনুমতি ক্রমেই তো কারাগারে আমার বন্দী স্বামীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ আছে কিন্তু তাকে নিরাপত্তা বন্দী বলে আমরা সাথে দেখা করতে দেয় না’।
এরকম প্রতিবেদন আমরা অনেক দেখেছি। ৭ মার্চ বঙ্গমাতা যে ভূমিকা পালন করেছিলেন সেটির মাধ্যমেই বোঝা যায় আমাদের জাতীয় জীবনে তিনি কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। ৭ মার্চ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা এসে তাকে পরামর্শ দিচ্ছিলেন যে, কী করতে হবে। তিনি সবার পরামর্শ শুনছিলেন কিন্তু নিজে কিছু বলেননি। ৭ মার্চ সকালটায় তিনি চুপচাপ ছিলেন। তার কন্যা শেখ রেহানা একটি বইয়ে তার মায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন ৭ মার্চের কথা, সেখানে বঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধুকে বলছেন, ‘তুমি নিজে যেটা ভালো মনে করবে, সেই কথাই আজ বলবে। কারও পরামর্শে কিছু বলবে না। মনে রেখো মানুষ আজ অনেক আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে। তাদের তুমি নিরাশ করো না।’ নিঃসন্দেহে তাদের তিনি নিরাশ করেননি এবং তারপর শেখ রেহানা আবার বলছেন, ‘মানুষের মনের কথা আজ তিনি উচ্চারণ করলেন। আমার মায়ের মুখে হাসি দেখেছিলাম। স্নিগ্ধতার, শুভ্রতার হাসি।’ মানুষের কল্যানে বেগম মুজিব ভাবতেন এবং স্বামীকে উৎসাহ দিতেন। একই ঘটনা আমরা দেখি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময়। শেষদিকে এসে আইয়ুব খান একটি ফাঁদ পাতলেন। বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্তি দিয়ে তারা আলোচনায় নিয়ে যাবেন। এই কথা শোনার পর বঙ্গমাতা তাড়াতাড়ি নোটিশ পাঠালেন বঙ্গবন্ধুকে ‘কোনো অবস্থাতেই প্যারোলে মুক্তি নেওয়া যাবে না। আজ নিঃস্বর্থভাবে মুক্তি পেলেই তুমি মুক্তি নেবে। জনগণ তোমার সাথেই আছে।’ তারপরে বঙ্গবন্ধু সেটিই করেছিলেন। শেষপর্যন্ত জেল থেকে বের হয়ে বঙ্গবন্ধু হয়েছিলেন। এরকম অসংখ্য ঘটনার কথা আমি বলতে পারি। আমরা গবেষণা করতে যেয়ে দেখেছি যে বঙ্গবন্ধু যখন কলকাত, বিহার বিভিন্ন অঞ্চলে দাঙ্গার পরিণতিতে মহাজের ওপরে কাজ করবার সময় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন ত্রাণ শিবিরে। ফিরে এসে কলকাতায় তার বোনের বাসায় ছিলেন। সেখানে বঙ্গমাতা গিয়ে উপস্থিত হয়ে তার সেবা করেছেন এবং পরীক্ষার সময় তাকে সহযোগিতা করেছেন। ১৯৫২ সালে অনশন শেষ করে যখন তিনি ফেব্রুয়ারি মাসের শেষদিকে মুক্তি পেলেন এবং বাড়িতে গেলেন তখনও তার সেবা শুশ্রুষা করে তাকে সুস্থ করেছিলেন। তিনি বেশিদিন বাড়িতে থাকেলন না। অল্পকিছুদিন পরেই তিনি ঢাকা চলে এলেন এবং করাচি গেলেন এবং আবার রাজনীতির মধ্যে জড়িয়ে পড়লেন। কোনোদিন বেগম মুজিব কোনো অভিযোগ করেননি। বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছেন, ‘কখনোই আমাকে বাধা দেয় নাই আমার স্ত্রী। আমাকে সব সময় উৎসাহ দিয়েছেন এবং তার উৎসাহের কারনেই বঙ্গবন্ধু স্বস্তির সঙ্গে রাজনীতি করতে পেরেছেন। সুতরাং বাংলাদেশের ইতিহাস লিখতে হলে বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি বঙ্গমাতাকে সমান গুরুত্ব দিয়ে স্মরণ করবো এবং তারা জীবনে একই অঙ্গে দুটি রূপ বলে আমরা জানবো।
পরিচিতি : বঙ্গবন্ধু গবেষক ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক। সাক্ষাৎকার : আমিরুল ইসলাম