শিরোনাম
◈ তরুণ ক্রিকেটার তানভীরের ফাইফারে সিরিজ সমতায় বাংলাদেশ ◈ 'শিক্ষা ও স্বাস্থ্য দখল করেছে জামায়াত': গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ◈ ১৪ হাজার কোটি রুপি কেলেঙ্কারি, যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেপ্তার ভারতের নেহাল মোদি (ভিডিও) ◈ মোবাইল চুরির অভিযোগকে কেন্দ্র করে গ্রাম্য সালিস থেকে রক্তাক্ত ট্র্যাজেডি ◈ জাতীয় নির্বাচনে বাধা দেওয়ার শক্তি কারো নেই: কেরানীগঞ্জে বিএনপি সমাবেশে সালাহ উদ্দিন আহমদের হুঁশিয়ারি ◈ তুর্কমেনিস্তানকে কাঁ‌পি‌য়ে দি‌লো বাংলা‌দেশ, এশিয়ান কাপে যাচ্ছে ঋতুপর্ণারা ◈ চী‌নে জু‌নিয়র হ‌কি‌তে একদিনে বাংলাদেশ পুরুষ ও নারী দ‌লের জয় ◈ কত টাকার বিনিময়ে মানববন্ধনে এসেছেন তারা, এদের পরিচয় কী? আরো যা জানাগেল (ভিডিও) ◈ ঠাকুরগাঁও সীমান্তে আবারো বিএসএফের ‘পুশ ইন’, ৬ বাংলাদেশিকে আটক করেছে বিজিবি ◈ বি‌সি‌বি ও বি‌সি‌সিআই সর্বসম্ম‌তিক্রমে সি‌রিজ স্থ‌গিত কর‌লো, আগ‌স্টে আস‌ছে না ভারত

প্রকাশিত : ০৬ জুন, ২০২১, ০৬:৪৬ সকাল
আপডেট : ০৬ জুন, ২০২১, ০৬:৪৬ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান : হেফাজত-জামায়াতের ‘ট্রিপল মিউট্যান্ট’ ভ্যারিয়েন্ট!

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান : গত মার্চ-এপ্রিল মাসের ঘটনা প্রবাহ পর্যালোচনা করে এটা নিশ্চিত বলা যায়, যারা ধর্মকে বাদ দিয়েও ধর্মীয় একটি সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি করতে পেরেছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হচ্ছে ‘হেফাজতে ইসলাম’। দুই মাসের দাঙ্গা-হাঙ্গামা, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ভিডিও ফুটেজগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, জঙ্গি-জানোয়ারদের (ঘোড়ার পিঠে তলোয়ার হাতে) সঙ্গে প্রচুর সংখ্যক ধর্মের সমর্থক গোষ্ঠীও ছিলো। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা এবং নারায়ণগঞ্জের রয়েল রিসোর্ট কাণ্ডের পর সহিংসতার বিরুদ্ধে সরকার কঠিন অবস্থানে গিয়েছে। কয়েকজন রাজনৈতিক হেফাজতিকে গ্রেপ্তার করেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কিছু রাজনৈতিক হেফাজতির গ্রেফতার বা শাস্তি দিয়ে (যদিও শেষ পর্যন্ত এসব কিছু না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি বলেই কেউ কেউ মনে করেন) অথবা গণমাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে এসব রাজনৈতিক ইসলামাবাদীদের দমন করা যাবে কিনা এ ব্যাপারে সন্দেহ আছে। যেমনটা মাদকবিরোধী (নেশা বিরোধী) কম্বিং অপারেশন করে পৃথিবীর কোথাও মাদক নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। অপারেশন করে আসক্তি দূর করা যাবে না। আশক্তির মূল উৎস বন্ধ না করে কম্বিং অপারেশন অনেকটা জিও ব্যাগ দিয়ে সাময়িকভাবে নদীর ভাঙন বিলম্বিত করার মতো। আসলে এই দিয়ে প্রকৃত ভাঙন রোধ করা যায় না। ভাঙন রোধের জন্য স্থায়ী বাঁধ তৈরির কোনো বিকল্প নেই।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বড় হুজুরের নির্দেশে ছোট ছোট শিশুদের (তালেবে এলেম) সহিংসতায় অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। তাদের অধিকাংশই এতিমখানা থেকে আগত। এতিমদের হাফেজ খানা থেকেই তারা এসেছে। এতিমদের মা-বাবা নেই, হুজুর যা বলবে তারা তাই করবে। প্রশ্ন হচ্ছে এতো এতিম হুজুরদের জিম্বায় গেলো কেন? অন্য কোনো উপায় কী ছিলো না? দেশের জন্য ৫ লাখ কোটি টাকার বাজেট হচ্ছে। এর মধ্যে অতি ক্ষুদ্র একটি অংশও কি আমরা এতিমদের জন্য রেখেছি? ঐতিহাসিকভাবেই এতিমদের ঠিকানা কওমি মাদ্রাসা সংশ্লিষ্ট এতিমখানা। এতো ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, বড় বড় সেতু সবই করলাম কিন্তু প্রত্যেক উপজেলায় একটা মডেল এতিমখানা তৈরি করতে পারলাম না, যেখানে আধুনিক হোস্টেল থাকবে, ভালো মানের স্কুল, কারিগরি স্কুল থাকবে। এতিমদের সকলকে মাদ্রাসায় পড়তে হবে কেন? ৪৬০টি মডেল মসজিদ তৈরি করছি, ভালো উদ্যোগ। একইসঙ্গে যদি ৪৬০টি মডেল শিশু পল্লী তৈরি করতে পারতাম। এতিম এবং অতি দরিদ্র পরিবারের শিশুরা যেখানে থাকবে এবং ভালো স্কুলে পড়বে। (বর্তমানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় অধীনে এ ধরনের কিছু প্রতিষ্ঠান চললেও এগুলো প্রয়োজনের তুলনায় এক শতাংশও না। এছাড়া ও অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির আকর এ সকল প্রতিষ্ঠান)।

শিশু সংগঠন কি এখন বাংলাদেশে আছে? খেলাঘর, শাপলা কুড়ির আসর, ফুলকুঁড়ি আসর, মুকুল ফৌজ এগুলোর অস্তিত্ব কি টের পাওয়া যাচ্ছে? কোথাও কোনো কর্মকাণ্ড নেই। এতো দূরাবস্থা পাকিস্তানি আমলেও ছিলো না। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, খেলাধুলা, কোনো অনুষ্ঠান নেই। যেটা নিয়মিত হচ্ছে সেটা হচ্ছে ‘ওয়াজ’। অনেক জৌলুষপূর্ণ ওয়াজ মাহফিল। ব্যয়বহুল প্যান্ডেল, আলোক ঝলমল মঞ্চ, এলইডি লাইট, ফেসবুক লাইভ (সরাসরি সম্প্রচার) ইউটিউব সবই আছে। ওয়াজের হুজুর হেলিকপ্টারে আসছেন, বিভিন্ন গান শোনাচ্ছেন, জিকির করছেন। জিকিরের তালে তালে ধর্মের সমর্থক গোষ্ঠীও নাচছেন। জিন্সের প্যান্ট ও কেডস পরিহিত ধর্মের সমর্থকরা এটাকে এখন তাদের সংস্কৃতি অন্যতম অনুষ্ঠান হিসেবে দেখছে। হুজুরের সম্মোহনী বক্তৃতার (বেশিরভাগই কোরআন হাদিস বর্জিত কল্পকাহিনি ও রাজনীতি) কারণে ধর্মের সমর্থক গোষ্ঠীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অন্তত ফেসবুক কমেন্টের সঙ্গে প্রোফাইল পিকচার দেখে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়। অবশ্য এর বিপরীতে কিছু কিছু হাক্কানি আলেম ঈমানের কথা, ভালো কাজের কথা মানুষদের সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলছেন এবং তাদের কথামতো অনেকে আমলও করছে।

গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে নব্বইয়ের দশকের শেষ পর্যন্ত, এমনকি বলা যায় ২০০৭ সাল পর্যন্ত জামায়াত ইসলাম বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমনভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলো যে একসময় এটাকে অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মন্তব্য করেছিলেন। যুদ্ধ অপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় জামায়াত এখন ম্রিয়মাণ। এতো জামায়াত-শিবির গেলো কোথায়? আমি তো মনে করি আজকের হেফাজতে ইসলাম হচ্ছে জামায়াতের ট্রিপল মিউট্যান্ট ভেরিয়েন্ট। ১৯৪০-এর দশকে ইসলামপন্থী রাজনীতির যেসব তাত্ত্বিক সবচেয়ে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তারা হলেন আবুল আলা মওদুদী (১৯০৩-১৯৭৯), সাঈয়িদ কুতুব (১৯০৬-১৯৬৬), হাসান আল বান্না (১৯০৬-১৯৪৯)। কুতুব ও বান্না মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিষ্ঠাতা এবং বিকাশের সঙ্গে যুক্ত। কৌশল বদলালেও জামায়াতের আদর্শ থেকে সরে আসেনি। তিউনিসিয়ার রাশিদ ঘানুশি জামায়াতের বিপরীতে নতুন তথ্য উপস্থাপন করেছে যা মওদুদীর সঙ্গে আকাশ পাতাল পার্থক্য। কুতুব, বান্না ও মওদুদী ঐশ্বরিক সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী। আইন প্রণয়নের অধিকার শুধু আল্লাহর। মানুষ হচ্ছে তার প্রতিনিধি (যেমনটি পাকিস্তান নামক অপরাষ্ট্রটির প্রথম সংবিধানের প্রথম লাইনে লেখা ছিলো)। তার বিপরীতে ইজতিহাদের (যুক্তিক আলোচনা) আলোকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার ইসলাম মানুষের ওপর অর্পণ করেছে, এই যুক্তিতে রাশিদ ঘানুশি ঐশ্বরিক সার্বভৌমত্বের ব্যাখ্যাকে নাকচ করে দেন। ঘানুশি শরিয়া ভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিপরীতে সেকুলারিজমের পক্ষে অবস্থান নেন। বাংলাদেশের হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে মওদুদীবাদের শতভাগ মিল থাকায় এটা যে সম্পূর্ণভাবে জামায়াত ইসলামের নতুন সংস্করণ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তারা লিংকনের গণতন্ত্র মানে না, রাষ্ট্রপতি মানেনা, প্রধানমন্ত্রী মানে না, তারা আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ভেঙে মধ্যযুগে নিয়ে যেতে চায়।

কওমি মাদ্রাসাকে বিরাজনীতিকরণের কথা কেউ কেউ বলছেন। কওমি মাদ্রাসাগুলোর সর্বোচ্চ সংস্থা আল-হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া, বাংলাদেশের চেয়ারম্যান আল্লামা মাহমুদুল হাসান, কওমি মাদ্রাসাগুলোকে রাজনীতি মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। আমি মনে করি এটা আরেকটা মিউট্যান্ট। এটা কোনোদিন সম্ভব হবে না। রাজনীতির মধ্য দিয়েই কওমিদের জন্ম। গণভবনে মাওলানা আহমদ শফীর নেতৃত্বে ওলামাদের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কওমি মাদ্রাসাগুলোর দাওরায়ে হাদিসকে কওমিদের দীর্ঘদিনের দাবি অনুযায়ী (জিয়া-এরশাদ এবং খালেদা যে দাবি পূরণ করেনি) মাস্টার্সের সমমানের সনদ প্রদানের ঘোষণা করার সময় দারুল উলুম দেওবন্দের আদলেই এই ডিগ্রি প্রদানের ঘোষণা দেন। দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবুল কাশেমের ছাত্র মাহমুদ আল হাসান ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা ছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে ১৯২০ সালে আল হাসান গ্রেপ্তার হন এবং মাল্টায় নির্বাসিত হন। মাহমুদ আল হাসানের ছাত্র হাসান আহমদ মাদানী ভারত বিভাগে মুসলিম লীগের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন।

১৯২৯ সালে তার প্রতিষ্ঠিত দল মজলিস-ই-আহরার-উল-ইসলাম কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বদ্ধ হয়ে জিন্নাহর দেশ-বিভাগের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। হাসান মাদানী ধর্মীয় স্বাধীনতা, সহনশীলতা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিলেন। অখন্ড ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে দেওবন্দের ভূমিকা ছিলো অত্যন্ত অগ্রণী। ১৯৬৯ সালে ভারতে বেড়াতে এসে সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গাফফার খান দেওবন্দে এসে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন এখানে বসেই মাহমুদুল হাসানকে নিয়ে ব্রিটিশবিরোধী অনেক পরিকল্পনা করেছেন। অতএব জন্মই যার রাজনীতির মধ্য দিয়ে সেই প্রতিষ্ঠান রাজনীতি ছাড়বে এটা বিশ্বাস করা যায় না। বিগত দিনের অভিজ্ঞতায় এটা নিশ্চিত বলা যায় হেফাজতিরা রাজনীতি করবেই। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ তাদের যতো ছাড় দিক না কেন হেফাজতীরা কখনো নৌকায় উঠবে না। হেফাজতের সঙ্গে জামায়াত যুক্ত হওয়ায় আদর্শিক কারণেই বিএনপির সঙ্গে থাকবে। জামায়াতের সঙ্গে আলাদা করে যাওয়ার দরকার নেই হেফাজত নিজেই জামায়াতের মিউট্যান্ট ভার্সন।

সংক্ষিপ্ত।

লেখক : অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়