রউফুল আলম: আমি কেন দেশ ছেড়েছিলাম? আগের একটা পোস্টের সূত্রধরে, অনেকেই জিজ্ঞেস করেছেন। আমি দেশ ছেড়েছিলাম লাঞ্ছনা থেকে বাঁচতে। দেশ ছেড়েছিলাম মানসিক নির্যাতন থেকে বাঁচতে। সামাজিক অনাচার থেকে বাঁচতে। আমার এই লাঞ্ছনা ও মানসিক নির্যাতনের জন্য আমি দায়ী ছিলাম না। কিন্তু আমাকে শিকার হতে হয়েছে। কারণ আমি গ্রামের ছেলে ছিলাম। আমার আব্বা কোনো বড় পদের চাকরিজীবি ছিলেন না। তার তেমন অর্থ-কড়ি ছিলো না। তিনি সামান্য বেতনের চাকরি করতেন- টেনেটুনে সংসার চলতো। আমারও টাকাপয়সা ছিলো না।
আমার কোনো উচ্চপদস্থ আত্মীয় ছিলো না। আমার বাবার কোনো মুক্তিযোদ্ধা সনদ ছিলো না। কোনো রাজনৈতিক লবিং ছিলো না। সবচেয়ে বড়ো কথা, কাউকে ধরে সাঁকো পাড়ি দেওয়ার মানসিকতা, জন্মগতভাবেই ছিলো না। আমি বুঝেছিলাম, এগুলো আমাদের দেশের জন্য একটা যোগ্যতা। যদি এগুলো না থাকে, তাহলে আপনাকে পুড়তে হবে। আপনাকে ভুগতে হবে।
প্রত্যেকটা কাজের জন্য হেনস্তা হতে হতো। ব্যাংক, থানা, হাসপাতাল, ভূমি অফিস, পার্সপোর্ট অফিস, চাকরির ইন্টারিভিউ, টিউশনি-এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে গিয়ে মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়নি। সামাজিক আরও কতো অনাচার তো ছিলোই! আমি জেদ ধরে ঘুষ দিইনি বলে ছয় মাসেও আমার পাসপোর্টের কাজ হয়নি। ভেরিফিকেশন রিপোর্ট আটকে রেখেছিলো। তারপর আমি এসপির কাছে গিয়েও অভিযোগ করেছিলাম। লাভ হয়নি। পরে আমাকে ঘুষ দিয়েই পাসপোর্ট করতে হয়েছে। এ শুধু একটা উদাহরণ! চাকরির ইন্টারভিউগুলোর অভিজ্ঞতা লিখলে মহাকাব্য হবে!
গত বারো বছর আমি ইউরোপ এবং আমেরিকায় কাটিয়েছি। তাদের ভাষার সাথে আমার ভাষার মিল নেই। ধর্মের মিল নেই। চেহারার মিল নেই। সংস্কৃতি, আচার, খাবারের মিল নেই। অথচ, অবাক করা বিষয় হলো, আমাকে একটিবারও এগুলো নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি। কেউ কোনোদিন আমার বাবার পরিচয় জানতে চায়নি। ধর্ম জানতে চায়নি। ঘুষ চায়নি। আমি কি টাকাওয়ালা নাকি রাস্তার ফকির- সেটা জিজ্ঞেস করেনি। এমনকি আমার প্রফেসরগণ, যাদের সঙ্গে ছয়-সাত বছর একটানা কাজ করেছি, তারা পর্যন্ত জানতে চায়নি-আমার বাবা কি করে কিংবা আমার ধর্ম কি!
কোথাও চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করিনি, আমার তো লোক নেই। আমার তো টাকা নেই। গত বারো বছরে আমার প্রতিটি কাজের জন্য রিওয়ার্ডের পর রিওয়ার্ড এসেছে। আর্থিক হোক, সম্মান হোক কিংবা সনদ হোক! কখনো সেটার জন্য কাউকে গিয়ে বলতে হয়নি। কেউ না কেউ আমার ঘাড়ের ওপর কাজের মূল্যায়ন করছে। আমি একবারও ভাবিনি, আমার কলিগ তো আমেরিকান কিংবা জার্মান কিংবা রাশিয়ান। তারা তো আমাকে বাংলাদেশি বলে উঠতে দেবে না। আমাকে কেউ পেছন থেকে টেনে ধরেনি। কেউ ল্যাং মারেনি।
কাউকে আমার কখনো কেয়ার করতে হয়নি। কোনো নেতা, অফিসার, বস-কারো ভয়ে আমাকে চুপ থাকতে হয়নি। তটস্থ থাকতে হয়নি। সহমত, জ্বি স্যার করে করে দিন কাটাতে হয়নি। কাউকে উপহার দিয়ে, বাসায় দাওয়াত দিয়ে সন্তুষ্ট রাখতে হয়নি। আমার প্রফেসর, সহকর্মী, বস, ম্যানেজার কাউকে এ পর্যন্ত আমি এক টাকার গিফ্ট দিইনি। উল্টো ভেবেছি, উপহার দিলে ওরা মাইন্ড করবে!
কারো পরিচয় দিয়ে কোনো কাজ করতে হয়নি। কে অফিসার, কে উলোট-পালট কর্মকর্তা- কেউ কাউকে কেয়ার করে বসে থাকে না। যে যার কাজ করে যাচ্ছে। ক্ষমতার অপব্যবহারকে ওরা শূন্যের কোঠায় রাখার চেষ্টা করে প্রতিনিয়ত। অথচ দেশে দেখেছি, কোথাকার কোন ওয়ার্ডের নেতা, সে পরিচয়ও গাড়িতে লাগিয়ে রেখেছে। অর্থাৎ তার জন্য রাস্তা ছেড়ে দাঁড়াও! নোংরা, ইতর! ক্ষমতার এবিউজের দিক দিয়ে, নাম্বার ওয়ান দেশ হলো বাংলাদেশ। একটা সামান্য কেরানি যেই ভাব নিয়ে থাকে, মনে হয় ফেরাউন এসেও তাকে নড়াতে পারবে না!
আমি এমন একটা বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি যেখানে একজন মানুষকে তার জন্ম নিয়ে, জন্মস্থান নিয়ে, জেলা নিয়ে, ধর্ম নিয়ে, গায়ের রং নিয়ে, উচ্চতা নিয়ে, বাপের পরিচয় নিয়ে, বাপের টাকা নিয়ে ভাবতে হবে না। রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে ভাবতে না হয়। নেতা-ফেতার পরিচয় দিতে হবে না। কেউ যেন কারও কাছে ক্ষমতা দেখাতে না হয়। নেতা-বস, ওমুক-তুমুকের সঙ্গে সহমত আর চামচামি করে বাঁচতে হবে না। প্রত্যেকটা মানুষ একজন নাগরিক হিসেবে তার অধিকারটুকু পাবে। সর্বত্র। থানা, আদালত, অফিস, ব্যাংক, অধিদফতর-সব জায়গায়! নেতার কাজ আগে হবে, টাকাওয়ালার কাজ আগে হবে, অফিসার, সেলিব্রেটি, ইউটিউবারের কাজ আগে হবে-এসব নোংরামি, ইতরামি যেন না থাকে। একজন মানুষ যেনো আত্মপরিচয়ে, কর্ম দিয়ে সবর্ত্র মূল্যায়িত হয়। তাকে যেনো কেউ আর কোনো কিছু দিয়ে যাচাই না করে। আমি এমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। সেই স্বপ্ন নিয়ে বলে যাই! ফেসবুক থেকে